কাজী শাহরিন হক
১৯২০ সাল থেকেই ভিয়েতনামের চলচ্চিত্রের ইতিহাস শুরু হলেও চল্লিশ থেকে সত্তরের দীর্ঘ তিন দশকের যুদ্ধ ভিয়েতনামের চলচ্চিত্রকে ব্যাপকভাবে বদলে দেয়। সাইকেল (১৯৯৫), দ্য সেন্ট অব গ্রিন পাপায়া (১৯৯৩) ও দ্য ভারটিক্যাল রে অব দ্য সান (২০০০) এর মতো কিছু সুপরিচিত ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র, যার সবই ফ্রান্সে প্রশিক্ষিত প্রবাসী পরিচালক ত্রান আন হাং পরিচালিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র আধুনিকতর হয়ে ওঠার ও সরকারি প্রোপাগান্ডা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা শুরু করায় ভিয়েতনামি চলচ্চিত্রের দর্শক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র বাফেলো বয় (২০০৫), বার গার্লস (২০০৩) বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
শুরুর কথা
১৯২০ সালে কিছু ভিয়েতনামি বুদ্ধিজীবী হ্যানয়ে ‘হুয়ং কাই ফিল্ম কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানিটি সম্রাট খাই ডিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং বাও দাই এর অভিষেক অনুষ্ঠানের উপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে। এছাড়াও আ পেনি ফর আ হর্স (১৯২৪) নামক নির্বাক চলচ্চিত্র তৈরি হয়। প্রথম দিকের সবাক চলচ্চিত্র প্রযোজনা করে হ্যানয়ের এশিয়া ফিল্ম গ্রুপ। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে তৈরি এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল ট্রু টু লাভ (১৯৩৭), দ্য সং অব ট্রায়াম্ফস, ত্ৰোয়েত’স স্ক্যায়ার্ড অব ঘোস্টস । ত্রান তান গাউয়ের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম ফিল্ম গ্রুপ তৈরি করে অ্যান ইভিনিং অন দ্য মেকং রিভার এবং দ্য রেড-বিয়ার্ডেড সরসারার । ১৯৩৭ এবং ১৯৩৮ সালে হংকংয়ে ভিয়েতনামি অভিনয়শিল্পী ও সংলাপ সমৃদ্ধ দ্য ঘোস্ট ফিল্ড ও দ্য স্টর্ম নামক দুইটি চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়, কিন্তু উভয়ই ব্যবসায়িকভাবে অসফল ছিল।
১৯৪৫ সালে ভিয়েতনাম সরকারের তথ্য ও প্রচারণা মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রথম ইন্দোচিন যুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে। এর মধ্যে আছে মোক হোআ ব্যাটল (১৯৪৮), ডোঙ খে ব্যাটল (১৯৫০), নর্থ ওস্ট ভিক্টরি (১৯৫২), ভিয়েতনাম অন দ্যরোড টু ভিক্টরি (১৯৫৩) এবং দ্য ব্যাটল অব দিয়েন বিয়েন ফু (১৯৫৪)।
যুদ্ধের বছরগুলোতে
প্রথম ইন্দোচিন যুদ্ধশেষে ভিয়েতনাম উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে বিভক্ত হয়ে গেলে হ্যানয় ও সাইগনে দুটি ভিন্ন চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠে। হ্যানয়ে তৈরি হতে থাকে প্রোপাগান্ডা ভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং সাইগনে যুদ্ধ, সামাজিক ও কমেডিধর্মী চলচ্চিত্র বেশি তৈরি হতে থাকে।
১৯৫৬ সালে হ্যানয়ের ভিয়েতনাম ফিল্ম স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৬৯ সালে হ্যানয় ফিল্ম স্কুল চালু হয়। গণতন্ত্রী ভিয়েতনামে সর্বপ্রথম যে চলচ্চিত্রটি তৈরি হয় তা ছিল একটি জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র, গুয়েন হং গি পরিচালিত অন দ্য সেইম রিভার (১৯৫৯)। ১৯৬০ সালে আ জাস্ট পানিশমেন্ট ফর দ্য ফক্স নামক একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রও তৈরি হয়। সেই সময় হ্যানয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রগুলো পূর্ব ইউরোপে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করত। মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৫৯ সালে একই বছর নির্মিত ওয়াটার রিটার্নস টু বাক হুং হাই গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড এবং ফাম কি নাম পরিচালিত মিসেস তু হাউ (১৯৬৩) সিলভার অ্যাওয়ার্ড পায়। এতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ত্রা গিয়াং।
হ্যানয় নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধকে চিত্রিত করা। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে ৪৬৩টি নিউজরিল, ৩০৭টি প্রামাণ্যচিত্র ও ১৭১টি বিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়, বিপরীতে ৩৬টি চলচ্চিত্র ও ২৩টি কার্টুন নির্মিতহয়েছিল । এই সময়ের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের ফুটেজ সম্বলিত প্রামাণ্যচিত্র চু চি গেরিলাজ (১৯৬৭) ও ভিন লিন স্ট্রিট র্যাম্পার্ট (১৯৭০)। অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যেও রোড টু দ্য ফ্রন্ট (১৯৬৯) ও দ্য হান্টারস অন দি দাক-সাও মাউন্টেন (১৯৭১) ছিল ডকু-ড্রামা। এছাড়াও এই সময়ের ফিচার ফিল্মগুলোর মধ্যে রয়েছে নগুয়েন ভান ত্রই (১৯৬৬), রোড ব্যাক টু মাদার (১৯৭১), দ্য স্টোরি অব আন রুক (১৯৭১) এবং ইয়ং গার্ল ফ্রম হ্যানয় (১৯৭৪)।
সাইগনে এ সময়ে প্রচুর প্রামাণ্যচিত্র, গণতথ্যমূলক চলচ্চিত্রের সঙ্গে ফিচার ফিল্মও নির্মিত হতো। সবচেয়ে বেশি আলোচিত চলচ্চিত্রটি ৫০ দশকের শেষ দিকে নির্মিত উই ওয়ান্ট টু লিভ যা উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের দ্বারা সংঘটিত রক্তাক্ত বিপ্লবের ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সাদা-কালো চলচ্চিত্রগুলো ছিল যুদ্ধভিত্তিক। পরের দিকের রঙিন চলচ্চিত্রগুলো ছিল যুদ্ধবিদ্ধস্ত সমাজে পরিবার ও ব্যক্তিগত টানাপোড়েন নিয়ে। যেমন, ফেইসলেস লাভার (১৯৭০), ডার্ক হাইওয়ে, রোডসাইড শ্যাডে৷। কমেডি চলচ্চিত্রগুলো সাধারণত ভিয়েতনামি নববর্ষ ‘টেট’ উপলক্ষ্যে তৈরি হতো। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় রম্যাভিনেতা থান ভিয়েত অভিনীত দ্য রিলাকটেন্ট মিলিওনিয়ার (১৯৭৩)। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ লেখক গ্রাহাম গ্রিন রচিত উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে জোসেফ ম্যাকেনজি পরিচালিত দ্য কোয়ায়েট আমেরিকান (১৯৫৮) চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ করা হয় সাইগনের ভিতরে এবং আশেপাশে।
পুনঃএকত্রিত ভিয়েতনাম
দুই অংশ এক হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ ভিয়েতনামের স্টুডিওগুলো আবার ‘সোশ্যাল রিয়ালিজম’ এর দিকে ফিরে যায়। ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র তৈরির হারও বেড়ে যায় এবং ১৯৭৮ সালের মধ্যে সিনেমা তৈরির হার যুদ্ধের মধ্যেও বছরে ৩টি থেকে বেড়ে ২০টিতে দাঁড়ায়। যুদ্ধ পরবর্তী বছরগুলোতে বিষয়বস্তু ছিল মূলত বিপ্লবের বীরত্বগাঁথা, যুদ্ধ দ্বারা তৈরি দুর্দশা ও যুদ্ধ পরবর্তী সমাজের সমস্যাসমূহ। এ সময়ের ছবি ছিল সিজন অব দ্য হুয়ার্লউইন্ড (১৯৭৮) এবং দ্য ওয়াইল্ড ফিল্ড (১৯৭৯)।
সমকালীন ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র
১৯৮৬ সালে বাজার অর্থনীতির আগমন ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র বাজারে একটি বড় আঘাত হানে । চলচ্চিত্র তখন ভিডিও ও টেলিভিশনের সাথে প্রতিযোগিতায় পড়ে। ১৯৮৭ সালে ভিয়েতনামে চলচ্চিত্র তৈরির সংখ্যা অনেক কমে যায়। এই সময়েও কিছু চলচ্চিত্রকার তাদের নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখেন। এর মধ্যে আছে ত্রান ভান থুইয়ের হ্যানয় থ্র হুজ আইজ (১৯৮৩), স্টোরি অব গুড বিহেভিয়র (১৯৮৭), ত্রান আন ত্রা এর আ ক্যাথলিক ইন থোং নাট ডিস্ট্রিক্ট (১৯৮৫), সিবিলিংস (১৯৮৬), দ্য গার্ল অন দ্য রিভার (১৯৮৭), দ্য রিটায়ার্ড জেনারেল (১৯৮৮) এবং গুয়াভা সিজন (২০০১)।
১৯৯৯ সালে ত্রান ভান থুইয়ের দ্য সাউন্ড অব দ্য ভায়োলিন ইন মাই লাই ৪৩তম এশিয়া প্যাসিফিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। পরের বছর একই উৎসবে নগুয়েন থানের স্যান্ডি লাইফ (১৯৯৯) শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় ।
২০০০ সালে বুই থাক চুয়েনের নাইট সিকলো ট্রিপ কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পায় । ভিয়েতনামি চলচ্চিত্র হিসেবে বেশি পরিচিতি পেয়েছে ইউরোপে তৈরি দ্য লাভার (১৯৯২) ও ইন্দোচিন (১৯৯২) ও প্রবাসী ভিয়েতনামি চলচ্চিকার ত্রান আং হুং এবং টনি বুই । ত্রানের প্রথম চলচ্চিত্র দ্য সেন্ট অব গ্রিন পাপায়া ১৯৯৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন ক্যামেরা’ পুরস্কার জিতে নেয়। তার অপর দুই চলচ্চিত্র সিকলো এবং দ্য ভারটিক্যাল রে অব দ্য সান বেশ আলোচিত হয়। টনি বুইয়ের থ্রি সিজনস ১৯৯৮ সালে সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতে নেয়। ইউরোপের সাথে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত আরেকটি চলচ্চিত্র নগুয়েন ভো গিয়েম মিনের মুআ লেম ব্রাউ ২০০৪ সালে শিকাগো চলচ্চিত্র উৎসবসহ আরও বহু উৎসবে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছে ।
বর্তমান সময়ে ভিয়েতনামি চলচ্চিত্রকাররা টেলিভিশন ও ডিভিডির কাছে হারিয়ে ফেলা দর্শকদেরও পুনরুদ্ধার করতে আরও বেশি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি ভিয়েতনামি বক্স অফিসে সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলোর একটি ছিল হ্যাভেন’স নেট (২০০৩)। এর বিষয়বস্তু ছিল দুর্নীতি ও হো চি মিন সিটির গ্যাংস্টার ন্যাম ক্যামের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে।
এর চেয়েও বড় সিনেমাটি ২০০২ সালের লে হোয়া বার গার্ল যা নির্মিত হো চি মিন সিটির উত্তেজক ও আসক্তিকর রাত্রির জীবন অবলম্বনে এবং এইচ আই ভি এইডস এর মতো রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে। এর কিছু দৃশ্য ভিয়েতনামে প্রথমবারের মতো সরকারি অনুমতি পায়। ২০০৪ সালে এর পরবর্তী পর্ব স্ট্রিট সিনডারেলা (২০০৪) মুক্তি পায়। এই ধারার আরও একটি চলচ্চিত্র গ্যাংস্টা গার্লস (২০০৪)।
ত্রুওং বায়ের সৌল ইন বুচার’স বডি (২০০৬) এবং হোয়েন ম্যান গেট প্রেগনেন্ট (২০০৪) এর মতো রোমান্টিক কমেডিও নির্মিত হচ্ছে। ভিয়েত লিনের মতো নারী চলচ্চিত্রকাররাও অনেক সিনেমা নির্মাণ করছেন যা সমালোচকদেরও প্রশংসা পাচ্ছে।
প্রবন্ধটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের বার্ষিক প্রকাশনা ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ এর ‘দূর প্রাচ্যের চলচ্চিত্রকথা’ সংখ্যা হতে সংকলিত