Skip to content Skip to footer

সিনেমা খনন: মার্টিন ম্যাকডোনা

ধরা যাক, আপনি একটা পার্কে। আপনি আপনার পরম শত্রুকে খুন করতে একটা পয়েন্ট থ্রি রিভলবার নিয়ে পিছন দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছেন। শত্রু বসে রয়েছে একটা বেঞ্চিতে, আপনার দিকে পিছন ফিরে। ঠিক যেই মুহূর্তে আপনি লক্ষ্য স্থির করে শ্যুট করতে যাবেন তখনই দেখলেন আপনার শত্রু একটা পিস্তল বের করে নিজের কানের কাছে নিয়েছে, নিজেকেই খুন করতে যাচ্ছে। আপনি তখন কী করবেন?

কিংবা, আপনি একটা বারে বসে রয়েছেন। আপনার পিছনেই অন্য দুইজন মানুষ নিজেদের মধ্যে আলাপ দিচ্ছে। না চাইতেও আপনি তাদের কথা শুনে ফেলেছেন। আপনি যা জেনেছেন— দুইজন মানুষের একজন ধর্ষক এবং আরেকজন খুনি। আপনি এই ব্যাপারে তাদের মুখ থেকে কথাবার্তা শুনে পুরোপুরি নিশ্চিত। কিন্তু আপনার কাছে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নাই। দুইজন মানুষ বের হয়ে যাচ্ছে অবলীলায় ভদ্রলোকের মতো। কেউ ঘুণাক্ষরেও আমলে নিবে না আপনার অভিযোগ। আপনি কি পুলিশকে জানাবেন না নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করবেন?

এগুলো মোরাল প্যারাডক্স। নৈতিক কূটাভাস— যদি বাংলা করতে যাই। তবে মোরালিটি, প্যারাডক্স এইসব ইংরেজিতে শুনতে আমাদের খারাপ লাগে না। আর মার্টিন ম্যাকডোনার সিনেমার কথাই যদি বলতে হয় তাহলে এই মোরালিটির প্যারাডক্স বারবারই ঘুরে ফিরে আসবে। 

মার্টিন ম্যাকডোনা ব্রিটিশ-আইরিশ নাট্যকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা এবং পরিচালক। ১৯৭০ সালে জন্ম নেওয়া এই পরিচালকের ঝুলিতে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, বাফটা অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার জুটেছে। সিনেমার কথা ধরলে তার সংখ্যা বেশি না। শর্ট ফিল্ম সিক্স শুটার (২০০৪) দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে ইন ব্রুজস (২০০৮), সেভেন সাইকোপ্যাথস (২০১২), থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি (২০১৭)—এই কয়টির নামই বলা যায়। তবে সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে ম্যাকডোনার কাজের অবমূল্যায়ন হবে। যদিও থিয়েটারের মাধ্যমে ম্যাকডোনার কর্মজীবন শুরু, থিয়েটারের জন্যে লিখে গেছেন নাটক, রচনা করেছেন বিভিন্ন ত্রয়ী এবং সেগুলোও সমাদৃত; কিন্তু, তিনি নিজেকে সিনেমার মধ্যেই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ্য মনে করেন বলে এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।

ম্যাকডোনার ব্ল্যাক কমেডিই হোক কিংবা ড্রামাই হোক সবসময়ই তিনি মোরালিটি নিয়ে একটা প্যারাডক্স তৈরি করেন। যেমনটা শুরুতে বলছিলাম, দুটো উদাহরণই তার সিনেমাকল্পানুসারে নেওয়া। তাঁর নৈতিকতার বোঝাপড়া নিয়ে উদাহরণই তৈরি হয়েছে ব্যাপক আলোচিত থ্রি বিলবোর্ডস আউটসাইড এবিং, মিসৌরি সিনেমা থেকে। আমরা দেখতে পাই মিলদ্রেদ নামক এক মহিলার কাহিনী, যেখানে তার মেয়ে অ্যাঞ্জেলা ধর্ষিত হয়ে খুন হলেও এই ঘটনার বিচার মিলদ্রেদ পায় না। এই থেকে শেরিফ বিল উইলোবির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কান্ট্রি রোডের ধারে পরিত্যক্ত তিনটা বিশালাকার বিলবোর্ড ভাড়া করে মিলদ্রেদ। সেখানে তিনটা বাক্য লিখে দেয়—’ধর্ষিত হয়ে মরছিলো’, ‘এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় নাই?’, ‘কী অবস্থা চিফ উইলোবি?’। স্বভাবতই, তুমুল ঝড় উঠে ছোট মফস্বল এলাকায়। চিফ উইলোবি এলাকার সবার শ্রদ্ধেয়জন। সবাই ধরে নেয়, মিলদ্রেদের চরিত্র নাটুকেপনায় ভর্তি। চিফ উইলোবি নিজেই ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলো এর উপর যখন এই ধরণের একটা নৈতিক চাপ মিলদ্রেদ বিলবোর্ড দিয়ে জুড়ে দেয় তখন চিফ অসহায় হয়ে পড়ে। 

প্রথমদিকে মনে হবে এইখানে পুলিশের ভূমিকার ব্যর্থতাকে ছোট করে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু, চিফ উইলোবির জবাবদিহিতাও কাহিনীর বিভিন্ন অংশজুড়ে দেখতে পাই। নৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে চিফ উইলোবি এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে রেখে। যদিও সে তিনটা পৃথক চিঠিতে জানিয়ে যায়, তার মৃত্যুর জন্যে মিলদ্রেদ কোনভাবেই দায়ী নয় বরং এটা তার ব্যর্থতা ছিলো; বরঞ্চ পরবর্তী মাসের বিলবোর্ড টাঙানোর অগ্রিম ভাড়াও মিলদ্রেদকে চিফ দিয়ে যায়। প্রথমদিকে মিলদ্রেদকে নায়ক হিসাবে দেখা গেলেও কাহিনীর এই পর্যায়ে এলাকার সবার কাছে মিলদ্রেদ হয়ে পড়ে দোষী। তার মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে, খুন হয়েছে এটা যেমন কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না তেমনি এতে মিলদ্রেদের বাড়াবাড়ির কারণে ভালোমানুষ চিফ যে আত্মহত্যা করলো সেটা এলাকার মানুষ কীভাবে মেনে নিবে? ম্যাকডোনার প্রথম মোরালিটির প্যারাডক্স এইখানে প্রস্তুত। 

আবার রগচটা, বদমেজাজি, বর্ণবাদী ডেপুটি ডিক্সনের কথাই ধরা যাক। প্রথম অর্ধেক সময় আমরা তার নানান রকম বর্ণবাদী, রাগান্বিত, খুব ছেলেমানুষী একটা ব্যবহারের সাথে পরিচিত হই। কিন্তু, পরবর্তীতে ডিক্সনকে চাকরি ছাড়তে হয়, হতাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়, সর্বশেষে নতুন এক ডিটেকটিভরূপে আবির্ভূত হয়ে এ কেসের সুরাহা ঘটানোর চেষ্টা করে। ঘটনাক্রমে একরাতে দুই লোকের কথা শুনে তার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়, এদের মধ্যে একজন সম্ভবত অ্যাঞ্জেলার ধর্ষক ও খুনি। হাতাহাতির পর সন্দেহভাজনের ডিএনএ মিলিয়ে হতাশ হয় ডিক্সন। সে আসলে অ্যাঞ্জেলার নয়, অন্য কারও ধর্ষক। তবে সে যে ধর্ষক এটা প্রমাণ করতে পারে না ডিক্সন। সে মিলদ্রেদকে লোকটার ব্যাপারে বলে। মিলদ্রেদ বুঝে অ্যাঞ্জেলার কেসের সুরাহা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। 

শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি, মিলদ্রেদ ও ডিক্সন গাড়ি চালিয়ে ওই লোকের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। দুইজন মিলে অন্তত একটা ধর্ষককে খুন করা ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় কিনা তা আমরা জানতে পারি না। তবে, এইখান থেকে সিনেমার মূল প্যারাডক্স স্পষ্ট হয়ে উঠে—কেউ যদি ধর্ষকও হয় এবং তাতে কোন প্রমাণও নাই, মিলদ্রেদ/ডিক্সনের কি উচিত হবে আইনের পরোয়া না করে ধর্ষককে খুন করা? কিংবা অন্য একজন ধর্ষকের বদলে অন্য ধর্ষকের শাস্তি পাবার বিষয়টা কেমন? 

ভিজিলান্তিজম, বাংলাদেশে আলোচিত সাম্প্রতিক হারকিউলিসের ঘটনা এই প্যারাডক্স থেকে খুব বেশি দূরে না। মোরালিটি এই ভিজিলান্তিজমকে প্রশ্ন করে। ম্যাকডোনা এই প্রশ্নের আরেকটা পাশও দেখান। যদি এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে ধর্ষণের বিচার নাই, অপরাধীকে ধরা গেলো না, ধর্ষক পালিয়ে বেড়ায় সেই পরিস্থিতি যে শূন্যতা তৈরি করে, যেখানে মিলদ্রেদ মাসের পর মাস ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে, সেই পরিস্থিতিতে পুলিশ-আইন-রাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করে এক ধর্ষকের বদলে অন্য ধর্ষককে নিজ হাতে হত্যা করলে তাকে আমরা কীভাবে দেখব? মিলদ্রেদ কি এখানে কেবলই একজন নাকি অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর? কিংবা বাস্তবতার চাপে চিফ উইলোবির মতো আরো অনেক পুলিশ অফিসারও কি কিছুই না করতে পেরে এইরকম হতাশায় আক্রান্ত হয় না? মিলদ্রেদের দিক কিংবা চিফ উইলোবি—উভয় জায়গা থেকেই পরিস্থিতি হতাশাজনক। এই অবস্থায় ব্যক্তির প্রতিরোধের ধরণ-ধারণ কেমন হবে? অন্য কাউকে হারকিউলিস সেজে খুন করে ফেলা নাকি টিকতে না পেরে নিজের জীবনকে মুছে ফেলা?


ম্যাকডোনা এইসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের দেন না। শুধু দেখিয়ে দেন, বিষয়গুলো কীরকম হতে পারে। মোরালিটিকে প্রশ্ন করার ধরন এই সিনেমাতেই প্রথম না। ইন ব্রুজস  সিনেমাতে রে এবং কেইন, দুইজন হিটম্যান। একজন যাজককে খুন করতে গিয়ে রে ভুলবশত একটা বাচ্চাকেও খুন করে ফেলে। ফলে চরম আত্মদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে রে। বস হ্যারির নির্দেশে ব্রুজস-এ আত্মগোপন করে কেইন ও রে। হ্যারির পেশা খুন করা হলেও কাজের ক্ষেত্রে সে খুবই নৈতিক। নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা হ্যারির নৈতিকতার পরিপন্থী। তাই কেইনের ওপর দায়িত্ব পড়ে রে-কে মেরে ফেলার কিন্তু ততদিনে রে আর কেইনের মাঝে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। নানা দোটানার পর কেইন যখন রে-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তখনই দেখতে পায় রে নিজেই নিষ্পাপ এক শিশুকে খুন করার অপরাধবোধ, অনুশোচনায় আত্মহত্যার চেষ্টায় লিপ্ত। সেই মুহুর্তে রেকে গুলি করতে পারে না কেইন। কিন্তু পাপের সাজা তাকে পেতেই হবে। আর তাই হ্যারি নিজেই হাজির হয় ব্রুজস শহরে। ঘটনাচক্রে যখন রেকে সামনে পায় তখন জানায়, আমি যদি তোমার মতো ভুল করে কোনো বাচ্চাকে খুন করতাম, তখনই নিজের মুখে গুলি করতাম। কিন্তু রে-কে খুন করতে গিয়ে হ্যারি ভুলবশত মেরে ফেলে জিম নামের একজন বামনকে। বামনটিকে শিশু মনে করে নিজের নৈতিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে নিজের মুখে গুলি করে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুকে বেছে নেয় সে।

এই সিনেমায় ম্যাকডোনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গেছেন—নৈতিকতা ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যক্তির বিচার-বিবেচনাতেই নৈতিকতা নির্ধারিত হয়; চার্চ, সমাজ ও রাষ্ট্র নৈতিকতা নির্দিষ্ট বা সর্বজনীন করে দিতে পারে না। হ্যারি, কেন, রে—এরা তিনজন খুন করলেও এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নৈতিকতা, সেটা মানবিকতার ধার ঘেঁষতে পারে আবার তা সহিংসতার ধারও ঘেঁষতে পারে।

অনেকে এই সিনেমার জোরে ম্যাকডোনাকে একজন পোস্টমডার্ন কাহিনীকার হিসেবে অভিহিত করেন। এই সিনেমাতে পোস্টমডার্ন নানারকম উপাদানের খোঁজও পাওয়া যায়। ব্রুজস শহরটাকেই কাহিনীর মঞ্চ হিসেবে বিশেষ করে বেছে নেওয়া হয়েছে। এটার প্রথম কারণ, ব্রুজস ম্যাকডোনার নিজেরই পছন্দ। 

দ্বিতীয়ত, ব্রুজসই একমাত্র শহর যেখানে বারোশ শতাব্দীর সময়কার চার্চ, ক্যাথেড্রাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় বিভিন্ন স্থাপত্য এখনও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সিনেমার বিভিন্ন সময় ধরে চার্চে মধ্যযুগীয় পুরনো চিত্রকর্ম দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ছিলো হিরোনিমাস বশের দ্য লাস্ট জাজমেন্ট, জ্য প্রুঁভোর ডেথ এন্ড মিসারি, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে জেরার্ড ডেভিডের জাজমেন্ট অব ক্যাম্বাইসেস। এই ছবিগুলোর শেষ দুইটি নৈতিকতার ডুয়ালিজম বা (একজন বিচারক যদি ঘুষ নেওয়ার অপরাধে ধরা পড়ে) দ্বৈততা তুলে ধরে। প্রথমটি যখন দেখানো হচ্ছিলো তখন তা (একমাত্র এই চিত্রকর্মই) রে-র নজর কাড়ে। সে তখন কেইনকে জিজ্ঞাসা করে, সে পরকালে বিশ্বাস করে কিনা? এইটা আসলে রে-র ভিতরে ওই বাচ্চা খুন করার অপরাধের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতিফলন (এই সিনেমার চিত্রকর্ম নিয়ে আরও বিশ্লেষণের জন্যে সার্টল ব্লগে ঢুঁ মারা যেতে পারে)। এই চিত্রকর্মসমূহ, মধ্যযুগীয় চার্চের ভিতর নৈতিকতার অবস্থান, আরও সহজ করে বললে নৈতিকতা যখন একরৈখিকভাবে চার্চের প্রচার-প্রচারণায় প্রতিষ্ঠিত—তার ভিতরও যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, আধুনিক জমানায় এসে এই সমস্ত দ্বন্দ্ব যে প্রকট হয়ে উঠতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রে, কেইন কিংবা হ্যারিরা। মার্টিন ম্যাকডোনার এই নৈতিকতা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন যদি পোস্টমডার্ন হওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয় তাহলে এর প্রতি সমর্থন থাকতেই পারে।


তবে লেখকের অভিমত, মার্টিন ম্যাকডোনা পোস্টমডার্ন কোনো ফিল্মমেকার নন। বড়জোর, তাকে আধুনিকতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পরিচালক বলা যেতে পারে। যিনি তদন্ত করছেন আধুনিকতার ভিতরে মিলদ্রেদ, রে, কেইন এদের মাধ্যমে। তাঁর এই তদন্ত সবচেয়ে ভালো করে বোঝা যায় সেভেন সাইকোপ্যাথস (২০১২) সিনেমার মাধ্যমে। প্রতিটি সাইকোপ্যাথ যাদের আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নৈতিকভাবে বিবর্জিত কিন্তু প্রতিজনেরই নিজস্ব দৃষ্টিকোণ আছে। ক্রুড রিয়ালিটি প্রতিজনের সামনেই হাজির হয় আর চিরাচরিত মোরালিটির সামনে দুইয়ের পার্থক্য স্পষ্ট করে তোলে। এবং সেভেন সাইকোপ্যাথসে তিনি প্রচলিত সিনেমার একটা ধারা ভাঙতে চেষ্টা করেছেন। মর্টি একইসাথে সেভেন সাইকোপ্যাথস সিনেমার স্ক্রিপ্ট বানাচ্ছে আবার সিনেমাও চলছে আমাদের সামনে। দর্শক, পরিচালক, সিনেমার মধ্যকার বাঁধা যেন তিনি ভাঙার অভিপ্রায়ে ছিলেন প্রথম অর্ধেক সময়। ম্যাকডোনার মোরালিটির ইনভেস্টিগেশন এই সিনেমাতেও পাওয়া যাবে।

ম্যাকডোনাকে পোস্টমডার্ন বলা হয় আরও একটা কারণে। তার সিনেমাতে কেন্দ্রীয় কোনো চরিত্র নাই। প্রতিটিরই নিজের নিজের কাহিনী আছে, প্রতিটি চরিত্রেরই আলাদা আলাদা গল্প আছে। একই কারণে, আমি তাকে পোস্টমডার্ন বলতে দ্বিধাবোধ করি। তার সিনেমাতে সেক্সিস্ট উপাদান যেমন আছে, তেমনি রেসিস্ট উপাদানও আছে, আবার এই সেক্সিজম, রেসিজম উপাদান বাদ দেওয়ার স্ট্রাগলও আছে। এসব জায়গায় বৈপরীত্যে ভরপুর ম্যাকডোনা। যেমন, সেভেন সাইকোপ্যাথসে অন্য সাইকোপ্যাথদের গল্প ভালোভাবে জানতে পারলেও নারী সাইকোপ্যাথটির গল্প আমরা জানি না। বরং পরিচালক সিনেমার অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই তাকে খুন করে ফেলেন। এক ঘন্টার মাথায় হ্যারি, মার্টিনকে নিজেই বলে যে তার নারী চরিত্রগুলো অদ্ভুত। তাদের নিজেদের কিছু বলার নাই। একই জিনিস ইন ব্রুজস-এও। নারী চরিত্র ক্লো-এর বিশেষ কোনো গুরুত্বই নাই পুরো সিনেমাতে। তাকে নিয়ে জটিল ইস্যুগুলোতে ম্যাকডোনা কোনোরকম বোঝাপড়াতে যাননি। আবার এই বিষয়ে ম্যাকডোনা যে অসচেতন, তাও না। তার প্রমাণ হ্যারির মার্টিনকে বলা কথাগুলোই। তবে সম্ভবত এই অভিযোগ এড়াতে চেয়েছেন থ্রি বিলবোর্ডস সিনেমাতে মিলদ্রেদের সাহায্যে। তাও এই সিনেমাকে পুরোপুরি নারীবাদী না বললেও কিছুটা নারীবাদী উপাদান যে আছে তা অস্বীকার করা যায় না। রেসিজম নিয়ে এই সিনেমাতে দুই চরিত্রের মাধ্যমে কিছুটা বোঝাপড়াতে গেলেও একটা ভারসাম্য আনার সচেতন চেষ্টা করেছেন ম্যাকডোনা। কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রগুলো ম্যাকডোনার খুবই সচেতনে বেছে নেওয়া এটা বোঝা যায় সেভেন সাইকোপ্যাথস দেখলে। তবে, বামন বা মিজেট চরিত্র কেন ম্যাকডোনার আনতেই হয় আবার তাও ব্যঙ্গাত্মক উপায়ে, অবমাননাকর উপায়ে অথচ মানবিক আকারে—এটা সম্ভবত ম্যাকডোনা সম্পর্কে আরেকটা পর্যবেক্ষণ। রে, মিজেট দেখে তামাশা করে, অপমান করে আবার মিলদ্রেদ মিজেটের সাথে ডেটে গিয়ে অস্বস্তিবোধ করে। প্রথমটাতে মিজেট জিমি শেষে গুলি খেয়ে মারা যায়। দ্বিতীয়টিতে কেবল কষ্টই পায়, অপমানিত হয়। এইটা কি ম্যাকডোনার মিজেটকে অবমাননাকর উপায়ে দেখানোর চেষ্টা না তাদের প্রতি সহানুভূতি থেকেই এইভাবে মিজেট উপস্থাপনের একটা কায়দা? এইসবের উত্তর আমার কাছে নাই। তবে এই কন্ট্রাডিকশান তার সিনেমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 

এই সব চিহ্ন বাদেও মার্টিন ম্যাকডোনার সিনেমা সুন্দর। এই সুন্দরের ব্যাখা আমার কাছে নাই। তবে এই যে তার সিনেমাতে মোরালিটির বোঝাপড়া, পোস্টমডার্ন উপাদান কিংবা কন্ট্রাডিকশানের ভিতর দিয়ে কনট্রাডিকশান বের করে নিয়ে আসা—এগুলো একদমই ম্যাকডোনার নিজের। ম্যাকডোনা পোস্টমডার্ন নাও হতে পারেন কিন্তু আধুনিকতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আধুনিকতাকে সেলুলয়েডে ছিঁড়ে দেখানোর কঠিন সক্ষমতা তার আছে।

তৌকির হোসেন

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এর নিয়মিত পত্রিকা ‘আগন্তুক’-এর ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত)

Leave a comment