Skip to content Skip to footer

জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র: একটি স্বপ্ন ও বাস্তবতা

তিন তলা একটি বাড়ি। ভেতরে রয়েছে একটি বড় মিলনায়তন যেখানে হাজার বারোশ’ মানুষ মিলে কোনো ধ্রুপদী ছবি দেখছেন, রয়েছে শ’তিনেক আসনের একটা ছোট মিলনায়তন যেখানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেকশনে চলছে অধুনা আলোচিত কোনো ছবির প্রজেকশন। রয়েছে দেড়শ জনের একটা সেমিনার কক্ষ যেখানে কোনো বিদগ্ধ বক্তা তার শ্রোতাদের সামনে আইজেনস্টাইন বা সত্যজিৎ রায়ের শিল্পের তত্ত্ব আলোচনা করছেন। রয়েছে দেশ বিদেশের সেরা চলচ্চিত্রবিষয়ক বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন ও ডিভিডিতে ভরা তাকের একটা পেশাদার লাইব্রেরি, যেখানে বসে চলচ্চিত্রবিষয়ক কোনো বইয়ের পাতায় নিজেকে নিমগ্ন রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে আগামী দিনের এদেশের জহির রায়হান বা আলমগীর কবিরেরা। আর বাইরের চাতালে ছড়িয়ে রয়েছে চা-কফির দোকান, যেখানে সিঙাড়া-সমুচায় কামড় দিতে দিতে তুমুল তর্ক-বিতর্কে চায়ের কাপে তুফান তুলছে কিছু বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ-তরুণী, কে বড় ফিল্মমেকার ব্রেসঁ না তারকোভস্কি। আর এসবই ঘটছে বাংলা ভাষায়, আর ঘটছে শিবঠাকুরের আপন দেশ আমাদের এই বাংলাদেশে।

না, তেমন কিছু ঘটছে না এখানে, কারণ এটা আমাদের একটা স্বপ্ন মাত্র। আর এ স্বপ্ন আমরা দেখে চলেছি সেই তরুণ বয়স থেকেই। আমরা আশা করেছি, লেখালেখি করেছি, দাবি তুলেছি, মন্ত্রী-আমলাদের বুঝিয়েছি কেন আমাদের দেশে এরকম একটা কেন্দ্র, একটু কেতাবি ভাষায় বললে ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার বা জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্রের প্রয়োজন। লন্ডনে একটা ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ রয়েছে, কলকাতায় আছে ‘নন্দন’। আর ঢাকায়? নাহ কিছু নেই। কেবল আমাদের এই স্বপ্নটা ছাড়া।

ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট

একটা ‘ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার’-এর কাজটা কী? কীভাবে তা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে অবদান রাখবে? সহজ জবাবটা হচ্ছে যেভাবে অবদান রাখে একটা ন্যাশনাল থিয়েটার কমপ্লেক্স, যেভাবে অবদান রেখে চলেছে বাংলা একাডেমি, সেভাবে। আমাদের এককালীন প্রভু ব্রিটেনের কাছ থেকে আমরা তো অনেক কিছুই শিখেছি। ক্রিকেট খেলা, কাঁটা-চামচে খাওয়া, ‘গুড মর্নিং’ ও ‘থ্যাংক য়ু’ বলা, হনুমানের লেজের মতো টাই পরা, এত এত কিছু শিখেছি। আমাদের এত এত কর্তা ব্যক্তি এত এতবার লন্ডনে গেছেন, কিন্তু টেমসের পারে ওয়াটার সাউথ ব্যাংকের বিশাল ভবনটি, যার নাম ‘ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার’, সেটা বোধহয় দেখেননি। আমরা ঠিক ওরকমই একটি জিনিস চাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরে। যেখানে চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য সুসজ্জিত মিলনায়তন থাকবে, চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা, সেমিনার ও ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা থাকবে, থাকবে চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ে একটা নান্দনিক আবহ। আর অতটা না পারলে প্রতিবেশী শহর কলকাতায় যেমনটি আছে, তেমন একটি ‘নন্দন’ তো আমরা চাই-ই।

নন্দন

সুস্থ চলচ্চিত্র সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়বে না। কেবল এফডিসিকে গালি দিয়েও কিছু হবে না। এদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে আমাদের ধাপে ধাপে গড়ে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে এমন একটি কেন্দ্র যার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা ও তা ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া। আমাদের স্বপ্নের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার’ হবে এমন একটি কমপ্লেক্স যেখানে চলচ্চিত্রবিষয়ক সভা-সেমিনার হবে, চলচ্চিত্র বিষয়ে আলোচনা পরামর্শ হবে, নিয়মিত দেখান হবে দেশ বিদেশের ধ্রুপদী চলচ্চিত্রসমূহ এবং অনুষ্ঠিত হবে রেট্রোস্পেকটিভ ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবসমূহ। এ হবে এমন এক কেন্দ্র যেখানে থাকবে চলচ্চিত্ৰ তাড়িত কিছু মানুষ যাদের ধ্যান-জ্ঞান-কল্পনা সবই থাকবে সিনেমা নামক সর্বাধুনিক এবং সর্বকনিষ্ঠ এই শিল্প মাধ্যমটিকে ঘিরে। বাংলাদেশে একটা পরিপূর্ণ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর পাশাপাশি এরকম একটা কেন্দ্র, একটা ‘ফিল্ম সেন্টার’ গড়ে তুলতে পারলে তবেই এদেশের সুস্থ চলচ্চিত্র সংস্কৃতি একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে। অন্যথায় আমাদের সকল প্রচেষ্টা, আর সব আন্তরিক ইচ্ছা, সব কিছুই পরিণত হবে অরণ্য রোদনে। তবে কবে যে আমাদের দেশে সেরকম রুচিশীল ও সংবেদনশীল একটা সরকার আসবেন যারা ‘ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার’-এর প্রয়োজনীয়তাটা সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, ফলে কেবল সরকারের সদিচ্ছার প্রত্যাশায় বসে থাকলেই চলবে না। বর্তমানে বেসরকারিভাবেও অনেক বড় বড় কাজ হয় এবং ভালোভাবেই হয়। সেই বিকল্প চিন্তাটাও আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে। সরকার যদি এগিয়ে না আসে সেক্ষেত্রে আমাদের নিজ চেষ্টাতেই একটা ‘চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ গড়ে তুলতে আমাদের নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে।

সঠিক পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি ও বাস্তববুদ্ধি থাকলে সেটা সম্ভব। যেভাবে আমরা এদেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছি সেই একই আন্তরিকতা ও উদ্যোগ নিয়ে এদেশে ‘ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার’ গড়তে পারাটা কেবলই একটা স্বপ্ন নয়, এর একটা বাস্তব সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রয়োজন কেবল আমাদের বিশ্বাস ও কাজে যৌথতা।

(লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এর নিয়মিত সাময়িকী ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ থেকে প্রকাশিত)

Leave a comment