বছর ঘুরে এলো অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের ৯৩তম আসর। এবারের অস্কারের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেওয়ার একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেছে। বরাবরের মত ড্রামা, কমেডি, থ্রিলার ও পলিটিকাল জঁরার ছবি স্থান পেলেও এবারে সম্ভবত ফ্যামিলি ড্রামা ও পলিটিকাল জঁরাকে উপরে রাখা হয়েছে। স্থান পেয়েছে ডার্ক থ্রিলারও। আসরে এশিয়ান সিনেমা ও কলাকুশলীদের জয়জয়কার। সব মিলিয়ে এবারের আসর ছিল অন্যরকম ও আকর্ষণীয়। মনোনয়নপ্রাপ্ত ছবিগুলোর স্ক্রিপ্ট, সিনেমাটোগ্রাফি যেমন দুর্দান্ত ছিল, তেমনি দর্শক ধরে রাখার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সফল ছিল সেগুলো। অস্কারে মনোনীত এমনই চারটি চলচ্চিত্র নিয়ে রিভিউ দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়।
প্রমিজিং ইয়াং ওমেন (২০২০)
একটা বার। এক মাতাল তরুণী, প্রায় অজ্ঞান, পোশাক অসচেতনভাবে বিন্যস্ত। এক জন ‘নাইস গাই’ তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসে। আপাতদৃষ্টিতে সেই তরুণের নৈতিকতাবোধ বেশ অটল দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত সে ঠিক সেভাবেই চিন্তা করে যেভাবে আমাদের পুরো সমাজ যুগ যুগ ধরে চিন্তা করে আসছে—শি ইজ আস্কিং ফর ইট। মাতাল মেয়েটি তাকে বারবার বাধা দেওয়ার পরেও সে তার সাথে সঙ্গম করতে উদ্যত হয়। এবং তখনই মেয়েটি পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে সম্পূর্ণ পরিষ্কার স্বরে বলে উঠে—হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?
এটাই প্রশ্ন। আপনি কী করছেন? আমি কী করছি? সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র কী করছে? আমরা সবাই কি ধর্ষণের সংস্কৃতি উস্কে দিতে কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখছি না? এই সিনেমাটা আপনাকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলে দেবে। কারণ এটি অত্যন্ত ডিস্টার্বিং, সেই সাথে খুবই বাস্তব।
সিনেমার ভিত্তি প্রতিশোধ, সাত বছর আগে ধর্ষণের শিকার হওয়া বান্ধবীর জন্য প্রতিশোধ নিতে এক জন তরুণী কতদূর যেতে পারে তা নিয়েই ছবি। মূল ভূমিকায় ক্যারি মুলিগান চমৎকার অভিনয় করেছেন। তবে দর্শক ধরে রাখার মূল কাজটি করেছে এর গল্প বলার ধরন। খুবই যত্ন নিয়ে তৈরি করা স্ক্রিপ্ট, স্টোরিলাইন ছবিটাকে প্রাণবন্ত রেখেছে। যদিও দু-একটা দৃশ্যে মুলিগানের অপ্রয়োজনীয় যৌন আবেদন সৃষ্টির একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেছে। তবে গল্পের সাথে খাপ খেয়ে যাওয়াতে চোখে লাগেনি এই অংশগুলো। এই ছবির একটা বড় সাফল্য, এটি আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে—হোয়াট অ্যাম আই ডুয়িং?
নোম্যাডল্যান্ড (২০২০)
আমেরিকায় প্রচলিত যাযাবর জীবন নিয়ে নির্মিত ছবিটি এবার ৬টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। ছবির পরিচালক একাই ৪টি বিভাগে পায়, যা অস্কারের ইতিহাসে নারী পরিচালক হিসেবে প্রথমবার। আসরে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেত্রী এ তিনটি ক্যাটাগরিতেই পুরষ্কার জিতেছে এ চলচ্চিত্রটি।
২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রচুর পরিমাণে কর্মী ছাটাই শুরু করে। বয়স্ক কর্মীদের মধ্যে অনেকেই তখন বাধ্য হয়ে যাযাবর জীবন বেছে নেয়। এমনই এক জন নারীকে কেন্দ্র করে ছবিটি তৈরি।
ফার্ন, মধ্যবয়স্ক এক নারী, চাকরি হারিয়ে নিজের ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন যাযাবর জীবনের উদ্দেশ্যে। পথে পরিচয় হয় অসংখ্য যাযাবরের সাথে, তাদের ভিন্ন ভিন্ন গল্পের মধ্যে আমরা জীবনের বিভিন্ন রূপ দেখি, অন্যরকম জীবনবোধের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। সিনেমার প্রায় পুরোটা জুড়েই অসংখ্য লং শট ব্যবহার করা হয়েছে। আমেরিকার কান্ট্রিসাইড ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সিনেমাটোগ্রাফার বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সিনেমার দারুণ বিষয় ছিল এর চরিত্র নির্বাচন। পর্দায় যাদেরকে আপনি যাযাবর হিসেবে দেখবেন তাদের মধ্যে প্রায় সবাই বাস্তব জীবনেও যাযাবর। এবং অধিকাংশ দৃশ্যে তাদের বাস্তব কার্যকলাপই ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এটিকে এক প্রকার ডকুফিল্মই বলা চলে। ফার্নের চরিত্রে অভিনয়কারী ফ্রান্সিস ম্যাকডরমেন্ড তার ক্যারিয়ারের সেরাটাই দিয়েছেন। সংলাপ দিয়ে যতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন চরিত্রটিকে, তারচেয়ে বেশি পেরেছেন সংলাপ ছাড়াই শুধু অভিব্যক্তির সাহায্যে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি চরিত্রের প্রিয়জন হারানোর কথা শুনে তার ঠোঁটের কোণায় থাকা মৃদু হাসির দৃশ্য, যেটি একাধারে তার প্রিয়জন হারানোর স্মৃতিকাতরতা এবং সেটি থেকে বের হওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রকাশ করে। বাস্তব যাযাবর জীবনের সাথে সিনেমার সংযোগ ঘটানোর কৃতিত্ব এই অভিনেত্রীকেই দিতে হয়। পরিচালক ছবিটাতে সচেতনভাবেই কোনো ন্যারেটিভ দেখাননি। সম্ভবত সেটি ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকদের জন্যই।
জুডাস অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক মেসিয়াহ (২০২১)
বর্ণবৈষম্য ও পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ষাটের দশকে গড়ে ওঠা বিপ্লবী সংগঠন ব্ল্যাক প্যানথার পার্টির এক জন ক্যারিশমাটিক নেতা ফ্রেড হ্যাম্পটন। নিজের দক্ষতায় কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন শেতাঙ্গদের। বর্ণ নয় বরং অধিকারের প্রশ্নে এক মন্ত্রে কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ নির্বিশেষে রেইনবো কোয়ালিশন তৈরি করেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের নজরে পড়তে বেশি দিন লাগেনি তার। এফবিআইয়ের প্রধান হুভার ও দুর্ধর্ষ এজেন্ট মিশেল যেকোনো উপায়ে তাকে থামাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সেই প্ল্যানেরই অংশ ছিল উইলিয়াম ও’নিল, এক জন কৃষ্ণাঙ্গ গাড়ি চোর, যে পরবর্তীতে হ্যাম্পটনের পার্টিতে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে তার দেয়া সাক্ষাতকারে উঠে আসে না-জানা সব সত্য। যা ঘিরেই এ সিনেমা।
ও’নিল চরিত্রটিকে আমরা বারবার নিজের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে দেখি। একদিকে হ্যাম্পটনের ক্যারিশমা, সুন্দর আচরণ, কোমলতা, আত্মবিশ্বাসে মুগ্ধ হয় সে, আর অন্যদিকে তার রোল মডেল এজেন্ট মিশেল। তাকে বোঝানো হয় ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি, কু-ক্লাক্স-ক্লানের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়৷ কিন্তু পার্টির বিভিন্ন কর্মসূচি দেখে সে বরং আপ্লুত হয়। হ্যাম্পটনের সাথে স্লোগান মিলানোর সময় তার অভিব্যক্তি দেখে মিশেলের মতো দর্শকদের মনেও প্রশ্ন জাগবে—ডাজ হি বিলিভ ইন দিস শিট?
ও’নিলের ভূমিকায় লা কেইথ স্ট্যানফিল্ড ছিলেন অনবদ্য। প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া চরিত্রটিকে বেশ ভালোভাবে পর্দায় তুলে ধরেছেন তিনি। হ্যাম্পটন চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে ড্যানিয়েল কালুইয়াকে বেশ খাটতে হয়েছে বলা যায়। হ্যাম্পটনের স্বাভাবিক ক্যারিশমাটিক অ্যাপ্রোচ সফলভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন। হ্যাম্পটনের স্ত্রীর চরিত্রে ডমিনিক ফিশব্যাকের অভিনয়ের কথা না বললেই নয়। খটমটে রাজনৈতিক গল্পে সামান্য রোমান্সের ছোঁয়া বেশ উপভোগ্য লেগেছে। এছাড়া সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার, মিউজিকও বেশ ভালো। ষাটের দশকের আমেরিকা বেশ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এ ছবিতে। সাসপেন্স সৃষ্টির ক্ষেত্রে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের সফল ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। এ ছবির ‘ফাইট ফর ইউ’ গানটি এবারের আসরে ‘বেস্ট অরিজিনাল সং’-এর খেতাব জিতে নিয়েছে।
মিনারি (২০২০)
মিনারি এক ধরনের উদ্ভিদ, যার প্রাণশক্তি অনেক বেশি, যেকোনো স্থানে জন্মায় এবং মারা গেলে সেখানেই নতুন উদ্ভিদ জন্মাতে পারে। এই ধ্বংস ও সৃষ্টি যেমন প্রকৃতির অংশ, তেমনি মানুষের জীবনেরও। এই সিনেমার অভিবাসী কোরিয়ান পরিবারটির রুপক হিসেবে কাজ করেছে মিনারি।
জ্যাকব এবং মনিকা—এই কোরিয়ান দম্পতি তাদের দুই সন্তান অ্যানি ও ডেভিডসহ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আরকানসাসে আসে। জ্যাকব তার একঘেয়ে চাকরিতে বিরক্ত, চায় নতুন জায়গায় নিজের ফার্ম তৈরি করতে। অপরদিকে মনিকা শহরমুখী, সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, জ্যাকবের ফার্মে লস, অতি আত্মবিশ্বাসী ও একগুয়ে আচরণ, মনিকার অসহিষ্ণু মনোভাব ইত্যাদি ঘিরে গল্প; অর্থাৎ অভিবাসী পরিবারের খুবই আটপৌরে কাহিনি। কিন্তু এই সাদামাটা গল্পেই অসাধারণ কাজ করেছেন পরিচালক। একটি পরিবার জীবন্ত হয়ে ওঠবে স্ক্রিনে, আপনার মনে হবে আপনিও পরিবারটির এক জন, ওদের ঘাত-প্রতিঘাতে আঘাত পাচ্ছেন আপনিও।
সিনেমাটোগ্রাফি গড়পড়তা মানের হলেও সিনেমার মিউজিক বেশ চমৎকার, বিশেষত মেলানকোলিক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চরিত্রগুলোর মধ্যের দ্বন্দ্ব ও সহানুভূতি এ দুই ভিন্নধর্মী অনুভূতির সংমিশ্রণ ফুটিয়ে তুলেছে সুন্দরভাবে। নানীর চরিত্রে ইয়ুহ জুং-এর অভিনয় নজর কেড়েছে। নানী সুনজা ও ডেভিডের শিশুতোষ সরল সম্পর্ক এই টানাপোড়েনের গল্পে একটু স্বস্তি দেয়। মনিকা চরিত্রে হ্যান ইয়ে-রি অনবদ্য। বিশেষত মাকে দেখার পরে তার অভিব্যক্তির দৃশ্যটি এত বাস্তব ছিল যা এক কথায় অতুলনীয়। অভিবাসীদের নিয়ে গতানুগতিক সিনেমার থিমের বাইরে গিয়ে ভেবেছেন পরিচালক। চার্চের দৃশ্যে ডেভিডকে এক আমেরিকান বালকের “হোয়াই ইজ ইউর ফেইস ফ্ল্যাট?” প্রশ্ন করার মাধ্যমে রেসিজমের এক সূক্ষ্ম ছাপ আনলেও তা বাড়তে দেননি পরিচালক। সম্ভবত তার লক্ষ্য ছিল শুধু পরিবারটির গল্প বলা, তাই পরক্ষণেই ঐ ছেলেটির সাথে ডেভিডের বন্ধুত্ব দেখিয়েছেন। সুনজাকে নিয়ে জ্যাকব-মনিকার কথা কাটাকাটি বা হাসপাতালে ডেভিডের রোগের ব্যাপারে জ্যাকবের গা-ছাড়া আচরণ ইত্যাদি দৃশ্য দেখলে হয়তো আপনার আরোপিত মনে হতে পারে, তবে ছবিটি শেষ করে আপনি ভাববেন এ সকল কিছুই দরকারি, সব দ্বন্দ্ব নিয়েই পরিবার হয়।