ভাষান্তর ও সম্পাদনা: সুস্মিতা জাহান চৌধুরী
শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া এক বলকান নগর সারায়েভো। এখানেই ১৯৫৪ সালের ২৪ নভেম্বর একটি সেক্যুলার মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেন পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্র জগতের বহু প্রতীক্ষিত রাজপুত্র এমির কুস্তুরিকা। তিনি একাধারে একজন রকস্টার, গ্রাম নির্মাতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক এবং উন্মাদ। এই অসম্ভব মেধাবী এবং পাগলাটে নির্মাতা সিনেমা বানাতে বানাতে বানিয়ে ফেলেছেন তার নিজস্ব এক ইউটোপিয়া কুস্তেনদরফ। এক মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে ইউরোপের শেষ কৃষি অভয়ারণ্য তৈরি করতে গিয়ে নিমজ্জিত হয়েছেন অতল ঋণে। তার জীবনযাপন, তার নির্মাণ কৌশল সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক চোখে প্রখর উন্মাদনা ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। তিনি ভালবাসেন ক্যামেরা, গিটার, জিপসি, বিস্ফোরক, বন্দুক, রাজহাঁস, তিতির, টার্কি, ছাগল এবং প্রকৃতির কাঁচা রং-রূপ। এই ক্ষ্যাপা চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্রের সেটে ক্ষেপিয়ে তুলেন প্রত্যেক আর্টিস্টকে যারা প্রতিনিয়ত অকুণ্ঠ ভালবাসায় ক্ষমা করে যান তার সকল পাগলামি। পৃথিবীর চলচ্চিত্রপ্রেমিদের মুগ্ধ ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু এই পরিচালক কতটা স্বীকৃতি পেয়েছেন তার নিজ দেশে? স্বদেশ ও পশ্চিম ইউরোপের বিদ্বৎজনের কাছে? ফরাসি দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী অ্যালেন ফিঙ্কিয়েলক্রাউট তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন এই বলে যে কুস্তুরিকা তার সারায়েভোতে প্রোথিত সাংস্কৃতিক মূল ভুলে গিয়ে বেলগ্রেড এর হয়ে কাজ করছেন। ১৯৯৫ সালে যখন কুস্তুরিকা এপিক চলচ্চিত্র আন্ডারগ্রাউন্ড (১৯৯৫) পাম দ’র জিতে নেয় তখন অ্যালেন ফিঙ্কিয়েলক্রাউট, বারনারড হেনরি লেভি এবং স্লাভোয় জিজেক প্রকাশ্যে কান জুরি বোর্ড এর নিন্দা করেন। হেনরি লেভির মতে কুস্তুরিকা এক ফ্যাসিস্ট লেখক। এদিকে তার নিজ দেশের মানুষ কী বলছে? তাদের চোখে কুস্তুরিকা পশ্চিম ইউরোপের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া, ধর্ম বিসর্জনকারী এক প্রতারক। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে তিনি ধর্মান্তরের সিদ্ধান্ত নেন এবং সারবিয়ান অর্থোডক্স চার্চে ব্যাপটাইজড হয়ে নেমানজা কুস্তুরিকা নাম ধারণ করেন। কুস্তুরিকা ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, প্রাগ অ্যাকাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস (FAMU) এ। তার প্রথম ফিচার ফিল্ম ডু ইউ রিমেম্বার ডলি বেইল (১৯৮১) ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার লায়ন জেতে ‘বেস্ট ফার্স্ট ওয়ার্ক’ ক্যাটাগরিতে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে মুক্তি পায় তাকে প্রথম পাম দ’র এনে দেয়া চলচ্চিত্র হোয়েন ফাদার ওয়াজ এওয়ে অন বিজনেস। একে একে তার পাঁচটি ফিল্ম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা করেছে এবং দুবার পাম দ’র জিতে নেয়া চতুর্থ চলচ্চিত্রকার তিনি। সিনেমা বানানো ছাড়াও দারুণ কর্মী এই পরিচালক প্রথম জীবনে সারায়েভো অ্যাকাডেমি অব পারফর্মিং আর্টসে পড়িয়েছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে। ১৯৮৯ সালে জুরির দায়িত্ব পালন করেন মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ২০১২ সেইন্ট পিটারসবার্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ২০১১ সাল থেকে তিনি ‘Academy of Sciences and Arts of the Republika Srpska’র সদস্য পদ অলংকৃত করে আছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি তার নিজ বানানো গ্রামে ‘কুস্তেনদরফ ফিল্ম অ্যান্ড মিউজিক ফেস্টিভাল’ এর আয়োজন করে চলেছেন নিয়মিতভাবে। তার প্রতিটি চলচ্চিত্রই উল্লেখযোগ্য। এখানে গুটিকয়েকের নাম উল্লেখ করা হল: টাইম অফ দ্য জিপসিজ (১৯৮৮), অ্যারিজোনা ড্রিম (১৯৯৩), ব্ল্যাক ক্যাট, হোয়াইট ক্যাট (১৯৯৮), সুপার এইট স্টোরিজ (২০০১), লাইফ ইজ আ মিরাকল (২০০৪)। তিনি এমির কুস্তুরিকা অ্যান্ড দ্য নো স্মোকিং অর্কেস্ট্রা ব্যান্ডের বেজ গিটারিস্ট।
ফরাসি ম্যাগাজিন অপ্টিমাম এর ৬৬তম সংখ্যায় ২০০৫ এর মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় এই সাক্ষাৎকারটি। শিরোনাম ছিল, ‘দ্য এমির অব দ্য সেভেন্থ আর্ট’।
অপ্টিমাম: আপনি কি নিয়মিত বাইবেল পড়েন?
এমির: হ্যাঁ পড়ি। যখন আমি কুরোসাওয়া, কুব্রিক, ভিসকন্তি, গুনে, কৌরিজমাকি…এদের সিনেমা দেখি, বাইবেল এর কিছু না কিছু এলিমেন্ট দেখতে পাই। এই বইটি প্রাণ বিকাশের শুরু থেকে জ্ঞানের সকল শাখাই ছুঁয়ে যায়।
অপ্টিমাম: ধর্মের নামে, বাইবেলের নামে এখন পর্যন্ত অজস্র মানুষ খুন হয়েছে। এই প্রক্রিয়া থেমে নেই। চলছেই…
এমির: আপনি যা বলছেন আর আমি যা বলছি, তা ভিন্ন। আপনি বলছেন খ্রিষ্টান কমিউনিটির কথা। আমি বাইবেল এর কথা বলছি, ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর হিসেবে। ধর্ম নিছক চার্চের ক্রীড়নক। যে জিনিস যুদ্ধক্ষেত্রে সমাধান হওয়ার উচিৎ, চার্চ সেখানে ওঁত পেতে থাকে। অংশ নেয় সেই যুদ্ধে। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ধর্মই মানব ইতিহাসে প্রথম স্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম দেয়। যেইমাত্র ইব্রাহিম (আব্রাহাম) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বহু-ঈশ্বর থেকে এক ঈশ্বরের জন্য দরজা খুলে দিলেন, সেইমাত্র সৃষ্টির ইতিহাসে যুক্ত হলো স্বাতন্ত্র্য ও স্বৈরতন্ত্রের বর্ণমালা। খ্রিস্টত্বের ইতিহাস এবং মানুষের ইতিহাস এ দুটোয় পার্থক্য বিস্তর। মানুষ যদি মঙ্গলের জন্য ধার্মিক হতো, তাহলে আমরা এত এত মৃত্যু ও যুদ্ধ এড়াতে পারতাম। এটা হলো আদর্শবাদ। আমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করি যে, মানুষের ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি। ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা ও অনীহা আরও এক ভয়ংকর ধর্মের পথে পরিচালিত করে, সেটি হলো নাস্তিক্যবাদ। এটিও একধরনের ধর্ম যে ধর্ম শুধু মুনাফার ধর্ম। যা মানুষকে ব্যক্তির মর্যাদা থেকে নামিয়ে বস্তুতে পরিণত করে।
অপ্টিমাম: তো আপনি, মানে এসবের মাঝে আপনি কোথায় অবস্থান করেন? কারণ, আপনি নিজেকে মাঝে মাঝে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দেন।
এমির: আমি বস্তুত ঈশ্বরের খোঁজে আছি। এটা খুঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন, জানেন? আমার খোঁজার পথটা দার্শনিক গোছের। আমি চাই কোনো কিছুকে ভেঙ্গে না ফেলে, বিচ্ছিন্ন না করে, অচ্ছুৎ না করে এগিয়ে যেতে। যেমনটা চার্চ করে থাকে। তারা শুদ্ধতার অপমান করেন।
অপ্টিমাম: আপনার পরবর্তী চলচ্চিত্র যুদ্ধকেন্দ্রিক। কেন বানাচ্ছেন এই সিনেমা? আপনার দেশের কী হয়েছিল সেটি জানতে? আপনি কে, সেই তথ্য বের করে আনতে?
এমির: সর্বৈব সত্য। আমার মতে, সবকিছুই একধরনের যুদ্ধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটি একটি চিন্তা প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। হেগেল বলেছেন, যখন বিপ্লব থেমে যায়, বিজ্ঞান এগোতে থাকে। যুদ্ধ বস্তুত আরও উন্নত এবং কৌশলী সমাজের জন্ম দিচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো—যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এই পৃথিবীকে; তারা আর দেশের ধারণায় বিশ্বাসী নয়। তারা এক নাম বের করেছে অঞ্চল। যুদ্ধ ছাড়া এই পুরো মানবসভ্যতা অরাজকতায় ডুবে যেত। আমি একটি সিনেমা এমন বানাতে চেয়েছি যেখানে জাতিসংঘের সেক্রেটারিকে গিয়ে বলা হবে, “এই নাও, সকল যুদ্ধ শেষ। তুমি মুক্ত। তোমাকে আর মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না।” কিন্তু এটি আমাদের কোনদিকে নিয়ে যাবে?
অপ্টিমাম: আপনার কি মনে হয় এই পরিস্থিতি আমাদের বিরাট ঝামেলার দিকে নিয়ে যাবে?
এমির: বিরাট। কারণ, এর মাধ্যমে আমরা মানবজাতির বুক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরিয়ে ফেলি। সেটি হলো মুনাফা। আমরা বসবাস করছি অর্থনৈতিক ফ্যাসিবাদের সময়ে। আমি কেন ধর্মের কথা বলি? আমি ধর্মের কথা বলি, কারণ ধর্ম আমার দেশের মতোই তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। অধিবিদ্যা এবং বিবর্তনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ধর্ম। মানুষের আবিষ্কৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা—ঈশ্বর; যুদ্ধ নয়। এবং নাস্তিক্যবাদ পরিণত হলো একটি নতুন ধর্মে। সিনেমার কথা যদি বলি, তো বলব আমরা শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সিনেমাগুলো খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। সেগুলি আমাদেরকে আর কোনো চিন্তার খোরাক যোগায় না। সেগুলি মানুষের অন্তরাতমা জাগিয়ে তুলতে পারে না। জীবনকে বড় করার বদলে, সেগুলি জীবনকে আরও ছোট করে তোলে, মস্তিষ্ককে করে ভাগাড়। আমরা এমন একটা পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছি যেটা পরিচালিত হচ্ছে হ্যামবার্গার দ্বারা। খুব বিপজ্জনক কিন্তু এটা। সিনেমা এখনো একটা ব্যতিক্রম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে এটি ঐ সর্বগ্রাসী রেজিম এর ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে, যারা কিনা মানুষের সিনেমার স্বাদ ও রুচিকে ফেলে দেবে একই ছাঁচে। আমি আগেও বলেছি, যে দেশ আমাকে তার জন্য জীবন উৎসর্গ করার দাবি জানায়, সেই দেশকে আমি বিদায় জানিয়ে চলে আসি।
অপ্টিমাম: আপনি কি একটা শামানিক পথে এগুচ্ছেন?
এমির: ক্রমশ। জীবনকে যতটা সুন্দর করা সম্ভব, আমি ততটা সুন্দর করার চেষ্টা করি সব সময়। এটা কঠিন। খুব কঠিন। আমরা খাই বিষ্ঠা, আমাদেরকে প্রতিনিয়ত বাইরে থেকে বিষাক্ত করা হচ্ছে। আপনি যদি আশাবাদী হতে চান তো, আপনাকে নির্বোধ হয়ে থাকতে হবে। আপনি যদি মানবতাবাদী হন তো যা কিছু ঘটে যাবে, সেই সবকিছুতে আপনাকে নির্বোধের মতো আচরণ করে যেতে হবে। ১৯৮৯ এ এই দাঁড়ায় যে, মানবতার স্বার্থে উন্নয়নটা খুব জরুরি নয়। বহুজাতিকেরা চেষ্টা করে সংস্কৃতির মূল বার্লিন ওয়াল ভাঙবার পর থেকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দারিদ্র্য বেড়ে গিয়েছে বহুগুণে। তার মানে আবহটাকে ভেঙ্গে ফেলতে। প্রকৃতিকে সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলতে। যাতে আমাদের এমন বোধ হয় যে, এই সংস্কৃতি ও প্রকৃতি কোনো কিছুরই দরকার নেই আমাদের। কেন? কারণ এতে করে আমরা যেন নির্বোধ ভোক্তায় পরিণত হই, যার চাহিদা ছাড়া আর কোনো প্রশ্ন নেই মনে।
অপ্টিমাম: লাইফ ইজ আ মিরাকল চলচ্চিত্রটি তৈরি করা কি আপনার জন্য খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল?
এমির: হ্যাঁ। আরোগ্য লাভ করার জন্য এটি নির্মাণ খুব দরকারি হয়ে উঠেছিল। আমি খুব মাত্রাতিরিক্তভাবে বিষাদগ্রস্ত এবং আহত হয়ে পড়েছিলাম কতিপয় বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা যারা আমার দেশের এই অবস্থা নিয়ে অযথা বয়ানবাজি করেছেন।
অপ্টিমাম: আন্ডারগ্রাউন্ড নিয়ে যারা কট্টর সমালোচনা করেছেন, সেই সমালোচনার জবাব কি এই চলচ্চিত্র?
এমির: অবশ্যই। যেমন, অ্যালেন ফিঙ্কিয়েলক্রাউটু এই প্যারিসিয়ান সমাজতন্ত্রী ভদ্রলোক যিনি কিনা অন্য যেকোনো বুদ্ধিজীবীর চেয়ে ভালো জানেন, ঠিক কি হয়েছিল আমার দেশে, কেন এভাবে ধ্বংস হতে হলো দেশটাকে। তিনি কিনা ‘লা মঁদে’ এর প্রথম পাতায় আন্ডারগ্রাউন্ড নিয়ে লিখলেন এই শিরোনামে, ‘যে চলচ্চিত্র আমি দেখিনি।’ অথচ মনে করে দেখুন, ১৯৬০-১৯৭০ এর সময়ে যখন কেউ সিনেমা না দেখে রিভিউ লিখত, সেই লেখা নিষিদ্ধ হত। এখন কে এসব নিয়মের তোয়াক্কা করে! আমরা এমন এক ভার্চুয়াল জগতে বর্তমানে বসবাস করি, যেখানে যে কেউ যেকোনো কিছু বলে ফেলতে পারে। সকল তথ্য বিকৃতির এক মহোৎসব চলছে। তবু এই জগত ও তথ্য আমাদের একান্তই দরকার। এই চলচ্চিত্রটি শুরু হয় সেখান থেকে যেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড থেমে গিয়েছিল। কিন্তু মূল সুরের ক্ষেত্রে আমি বলব এটি হোয়েন ফাদার ওয়াজ এওয়ে অন বিজনেস এর কাছাকাছি।
অপ্টিমাম: আপনার মতে যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বলা খুবই বিপজ্জনক। এর কারণ কি আপনার পক্ষপাতদুষ্টতা?
এমির: আপনাকে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ থাকবার চেষ্টা করে যেতে হবে। এটাই আমাদের যুদ্ধ। বেশ কঠিন এক যুদ্ধ। আশা করি, আমার এই চলচ্চিত্রটি যুদ্ধের মাঝে যে এক মানব স্বভাব বিদ্যমান তাই নিয়ে আলোচনা করবে। যুদ্ধ কখনোই থেমে নেই। থেমে থাকে না।
অপ্টিমাম: কোনো কিছুর সত্যাসত্য নির্ণয় না করে কাজ করাটা কি খুব কঠিন? প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত না করা?
এমির: যারা ইউরোপের মূলস্বত্তাগত ভাবনাটাকে পরিবর্তন করতে চায়, যারা ‘দেশ’ এর ধারণা থেকে উত্তরিত হয়ে ‘অঞ্চল’গত ধারণায় পৌঁছুতে চায়, তারা যেখানে সেখানে পঙ্গপালের মত বেড়ে উঠছে। মানুষ হয়ে আরেকটি মানুষকে খুন করবার বাসনা জাগিয়ে তুলছে। তারাই মানুষকে পুড়তে প্ররোচিত করছে প্রতিশোধ স্পৃহায়। এই পৃথিবীটা তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যারা কিনা অঞ্চলগত ধারণার মতো একটা দুঃখজনক ধারণায় আচ্ছন্ন।
অপ্টিমাম: আপনার চলচ্চিত্রগুলি কি ভালবাসার অলৌকিক স্বর?
এমির: নিঃসন্দেহে! আমার লাইফ ইজ আ মিরাকল সিনেমাতে লুকা আর সাবাহার প্রেমটা গড়েই উঠেছে যুদ্ধের নিরবচ্ছিন্ন ভয়াবহতা এবং অনিশ্চয়তার মাঝে। একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি করেছি সিনেমাটি। শেক্সপিয়রীয় দ্বন্দ্বকে নিয়ে গেছি বলকানীয় দ্বন্দ্বের মাঝে যেখানে একটি যুদ্ধবন্দী মুসলিম নারী ও তার সারবিয়ান গার্ড—দুজনের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় তীব্র ভালবাসার অনুভূতি। এটা দেখাতে পেরেছি বলে আমি খুব খুশি। বেরনারদ আঁরি লেভি (বারনারড হেনরি লেভি) এর মতো ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রতিক্রিয়ার জবাবে আমার উচ্চারণ। আমি খুশি যে আমি আমার মানুষদের জীবন নাটক নিয়ে কাজ করতে পারছি। ইতিহাস আমাকে, আমার দেশকে যেভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে তার প্রতিশোধ আমার একেকটি চলচ্চিত্র। এভাবেই আমি সিনেমা বানাই।
অপ্টিমাম: আপনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই প্রতিক্রিয়ায় অংশ নেন?
এমির: হ্যাঁ। আলজেরিয়ার মরুভূমিতে ধবধবে স্কার্ফ, পরিষ্কার নীল জিন্স এবং পরিপাটি বো ড্রাই করা চুল সংবলিত যেসব সিনেমা হেনরি লেভি বানিয়ে থাকে তার চেয়ে আমার সিনেমা যথেষ্ট স্বতঃস্ফূর্ত। আর এজন্যই এই লোকের মন্তব্য এমন জঘন্য। ভাবখানা এমন, আমি ব্লুজ মিউজিক বাজানোর মত ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছি! অথচ যেটা কিনা আমি প্রায় সারাক্ষণই নিজে তৈরি করি। যে সুর আমার আত্মাকে, হৃদয়কে স্পর্শ করে না, সেটা আমি কীভাবে তৈরি করতে পারি। নিশ্চয়ই ব্লুজ আমার আত্মাকে অনুরণিত করে, তাই পারি।
অপ্টিমাম: আন্ডারগ্রাউন্ড-এর ওপর এতসব আক্রমণের পর আপনি একটা বই লিখলেন যার নাম ‘মঁ ইমপোস্টার’….
এমির: আমি সেসবের জবাব দিতে চেয়েছি। আমি জানি না এরা কোন দলের লোক। গাক্সমান এবং তার অনুসারীরা আমাকে এদের কথায় কর্ণপাত না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু এত ঘৃণার জন্ম কোথায়? যেন বা আমি তাদের অতীত নিয়ে শিক্ষা দিতে এসেছি! যেন আমি তাদের চেয়ে উন্নত কোন সমাজের মানুষ। প্রত্যেকটা চলচ্চিত্র আমি বানিয়েছি কোনো এক কষ্টের জবাবে। কোনো এক তীব্র দাহ যা আমাকে পুড়িয়েছে, তাই নিয়ে আমি সৃষ্টি করেছি। যখন তুমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু নির্মাণ করবে না, তা দেখামাত্র মানুষ তার অসারত্ব টের পেয়ে যাবে।
অপ্টিমাম: যে গল্পগুলো আপনি ইতিমধ্যে বলে ফেলেছেন, এই সিনেমায় কি তার পুনরাবৃত্তি থাকবে?
এমির: নিশ্চিতভাবে। যত বয়স বাড়ছে, আমি এক অনড় অবিচল শক্তির স্বরূপ সম্পর্কে জানতে পারছি যা এই পৃথিবীর সমস্ত ট্র্যাজিক নাটকের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। এবং অবশ্যই তার এন্টি-থিসিসটাও। লড়াইটা এখানে সত্যের জন্য, সুন্দরের জন্য। আমি বর্তমানে সার্বিয়ার একটি পুরোনো গ্রাম পুনঃনির্মাণ করছি যেখানে তরুণদের জন্য ফিল্ম ইন্সটিটিউট থাকবে। আরও অনেক কিছুই তাদের শেখানো হবে। আপনার চিন্তার জগতকে প্রসারিত করার সুযোগটা সবসময়ই থাকে। এবং তা সম্ভবও। কিন্তু মোটের ওপর আমাদের এক চিরন্তন শত্রু এক্সিস্ট করে আর তা হলো বিশ্ব পুঁজিবাদ। এটা সবখানেই আছে। এর দেহরক্ষীরা সবখানে ছড়ানো-ছিটানো। এমনকি আর্মিদের ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র আমাদেরকে এটা বোঝানোর জন্য যে ব্যাপারটা বস্তুত এমনই হওয়া উচিৎ। মিলোশেভিচকে বন্দি করার বাহানায় তারা বেলগ্রেডে বোমারু বিমান চালায় এবং তিন হাজার মানুষ হত্যা করে। এখন বলুন, মিলোশেভিচ এর বিনিময়মূল্য কীভাবে ঐ তিনটি হাজার মানুষ হতে পারে? তারা এর এক অদ্ভুত নামকরণ করল, ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ বা ‘বন্ধকী ক্ষতি’। ক্ষমতার অপব্যবহার মানুষের প্রকৃতিগত এক পাপ। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, যখন তুমি কারো বিরুদ্ধাচরণ কর তখন তার বিরোধিতা করতে গিয়ে যেকোনো কিছু করাটা খুব ন্যায়সঙ্গত। তারা টেলিভিশনে এসব বয়ানবাজি করে করে আমাদের মূর্খ করে রাখছে।
অপ্টিমাম: আপনি কি আপনার অন্তর্গত প্রেরণায় আস্থা রাখেন?
এমির: শুটিং এর সময় আমি আমার ভাবনার সম্প্রসারণ ঘটাই। একে বাড়াই, সাজাই, পরিবর্তন করি। ছোট থেকে ছোট ডিটেইলগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবি আমার অন্তর্গত দ্বন্দ্বগুলোকে লুকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করেই। এখনকার সিনেমা সামাজিকতার উত্তর দেয় না, মনস্তাত্ত্বিকতার উত্তর দেয় না। আপনি দেখেছেন রক্ত মাংসের একটি সিনেমা যার নিজস্ব হৃৎপিন্ড আছে?
অপ্টিমাম: এখনকার সিনেমা, বিশেষ করে হলিউডের সিনেমা আমাদের আর অন্ধকার দিকগুলি নিয়ে কাজ করে না?
এমির: না। একেবারেই না। হলিউড যুক্তিবাদী। শিল্পের সাথে তাদের কোনো রকম যোগাযোগ নেই।
অপ্টিমাম: এই ক্ষেত্রে আপনি কি ট্রুফোর সাথে একমত হবেন যে চলচ্চিত্র জীবনের চেয়ে সুন্দর?”
এমির: তিনি ঠিক বলেছেন। সিনেমা জীবনের দৈনন্দিন ক্ষুদ্রতাগুলিকে অতিক্রম করে যায়। মানুষের যুদ্ধ দিনযাপনকে এই সমস্যা ভারাক্রান্ত পৃথিবীর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। আপনার প্রতিদিনকার রাস্তাটিই হয়ে উঠতে পারে এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। সংবাদপত্র, মিডিয়া এরা বেশ জ্ঞাতসারে খবরগুলি, প্রয়োজনীয় খবরগুলি চেপে যায়। যখন বেলগ্রেডে বোমা হামলা হয়, তখন এই বিষয়ে হ্যোরল্ড পিনটারের আর্টিকেলটা ছাপা হয় ‘গার্ডিয়ান’ এর সপ্তম পাতায়। ঐ খবর হয়তো আপনার ঠিকমত পড়বেও না। আমি এটা কখনোই ভুলব না। সত্যকে কোণঠাসা করার, তার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া এ এক কৌশলী প্রক্রিয়া। আমাদেরকে মিনিমাম খবরটুকু প্রদান করা হচ্ছে এবং এটা প্রকৃত নির্বুদ্ধিতা। অরওয়েল এর ভবিষ্যতবানী ফলে গিয়েছে অনেকদিন হল। এই পৃথিবী ভর্তি অজস্র প্যারাডক্স।
অপ্টিমাম: আপনি কি মনে করেন সিনেমা, চিত্রকলা এবং সংগীত হচ্ছে এই ভাঁওতাবাজি এবং তথ্যবিভ্রাট এর বিরুদ্ধে শেষ সৎ প্রতিক্রিয়া ?
এমির: হ্যাঁ। সাহিত্যকে সাথে নিয়ে অবশ্যই।
অপ্টিমাম: আপনি আপনার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কীভাবে নির্বাচন করেন? তারা প্রত্যেকে অসাধারণ চেহারার অধিকারী, মানে ঠিক যেমনটা ঐ চরিত্র অনুমোদন করে। কোনো সংলাপ না বলেও তাদের চোখমুখ কথা বলেই যায়।
এমির: আমি এমন কলাকুশলীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, যারা প্রাণ প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ, যারা রাগী, যারা মুডি। যাদের উদ্দেশ্যই থাকে, তার সর্বোচ্চটুকু দেয়ার। আমি চাই আমার চলচ্চিত্রগুলি হোক পুরোনো চলচ্চিত্র পুরোনো চিত্রকলার মত। আন্ডারগ্রাউন্ড নির্মাণকালে আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম দেলাক্রো এবং তার সমকালীনদের চিত্রকলা যারা কিনা এই সামষ্টিক অন্তঃজ্ঞান বা কালেক্টিভ সাবকনশাসকে অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। একইসাথে তারা মরিয়া হয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র ডিটেইলসগুলো নিয়ে কাজ করেছেন যাতে করে সমস্ত ছবিটা এক জীবন্ত সমগ্রতা নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে। এই ক্ষেত্রে আমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবয়ব খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অপ্টিমাম: তারা তাদের অন্তর্জগতে আপনাকে প্রবেশ করতে দেয়? তারা তাদের সত্যটা উদঘাটিত করে?
এমির: হ্যাঁ। অথচ যখন হেনরি লেভি আলজেরিয়ার মরুভূমিতে একটি পরিপাটি চুলের ছাঁট নিয়ে দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তের দিকে তাকান, নিজেকে হয়ত তিনি তখন আঁদ্রে মলিষ্ঠ ভাবতে পারেন। কিন্তু সে এক স্থূল ছদ্মবেশ ছাড়া কিছুই না।
‘মাই ভিলেজ ইজ অ্যা কালচারাল ল্যাবরেটরি’ শিরোনামের নিচের এই সাক্ষাৎকারটি ফরাসি পত্রিকা ‘লে জার্নাল দু ডিমানচে’ প্রকাশ করে ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল।
অপ্টিমাম: আপনার আত্মজীবনীর নাম ‘হোয়্যার অ্যাম আই ইন দিস স্টোরি’ আপনি কি অস্তিত্ব সঙ্কটে ভোগেন?
এমির: আমি নিজেকে বহুবার এই একই প্রশ্ন করেছি। এমন একটা প্রশ্ন, যার কোনো সঠিক উত্তর হয় না। শুধু অভিনেতারা ফিল্মের সেটে তাদের পরিচালকের নির্দেশে এই ধরনের প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন। ব্যক্তির জীবনচর্চার ক্ষেত্রে এর উত্তরটা খুব নাজুক। খুব সংবেদনশীলতার সাথে খুঁজতে হয় এর অর্থ। আমার প্রথম চলচ্চিত্র ডু ইউ রিমেম্বার ডলি বেল যখন ভেনিসে পুরষ্কৃত হয়, টাইম ম্যাগাজিন এর এক আমেরিকান রিপোর্টার লিখেছিলেন ‘শিকড়হীন অজ্ঞাতকুলশীল এক পরিচালক কুস্তুরিকা’। আজ আমি বলতে পারি, আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি, যে দেশ চিরতরে হারিয়ে গেছে। যে দেশের কোনো অস্তিত্ব আজ আর নেই। আমি সেসব হতভাগ্য যুগোস্লাভদের একজন যারা তাদের স্বভূমি সারায়েভোকে ধ্বংস হতে দেখেছে।
অপ্টিমাম: আপনি আপনার শিকড় হারিয়েছেন। এই বোধটির সাথে কীভাবে বাস করেন?
এমির: আমার দেশ আমি নিজেই তৈরি করে নিয়েছি। বসনিয়া এবং সার্বিয়া সীমান্তে উঁচু পাহাড়ের ওপর আমার আবহমান সংস্কৃতি নিয়ে গড়ে তোলা এক গ্রাম, কুস্তেনদরফ। এটা এক কালচারাল ল্যাবরেটরি যেখানে আমি শিল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। প্রায় একশোটার মত কাঠের বাড়ি, থিয়েটার, সিনেমা হল আছে এখানে। আমি এমন একটা সমাজ গড়ে তুলতে চাই, যেখানে আমরা সবাই রাজা। কুস্তেনদরফ কোকাকোলা কালচারের অ্যান্টিথিসিস। আমরা দোকানে কোনো ধরনের কোকাকোলা রাখি না তো! আমাদের যা কিছু দরকার আমরা তা নিজেরাই তৈরি করি। নিজস্ব বিয়ার, নিজস্ব ওয়াইন, নিজস্ব মদ সব সবকিছু । মানুষ এখানে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকতে পারে। আমি এখানকার প্রভু। এটা সত্য। বলা যায়, বেশ মজার এক প্রভু যে প্রভুত্ব নিয়ে হাসাহাসি করে।
অপ্টিমাম: আপনি একজন সংবেদনশীল পরিবেশবাদী?
এমির: নিঃসন্দেহে! বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে একমাত্র মুক্তির পথ হলো এই পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলন। কোনো রাজনৈতিক দলের হোতা হলে আমার নির্বাচনী প্রচারণায় থাকত শুধুমাত্র একটাই ইশতেহার পৃথিবীকে পরিণত করব একটি অরণ্য উদ্যানে।
অপ্টিমাম: অর্থাৎ ইউটোপিয়া?
এমির: ইউটোপিয়া অথবা সিনেমা। যেকোনো অসম্ভবের চিলেকোঠায় পৌঁছে যাওয়া চলচ্চিত্রের জন্য কোনো ব্যাপার না। যখন আমি জাপান এবং ফুকুশিমা পাওয়ার প্ল্যান্ট এর চেহারা দেখি, আমার মনে হয় এই হলো শেষের শুরু। বাইবেলে এপোক্যালিপসের কথা আছে। প্রকৃতি তার সমস্ত শক্তি মানুষের বিরুদ্ধে ব্যয় করবে কারণ মানুষও তাই করছে!
অপ্টিমাম: সারায়েভোরে গরিচায় আপনি বেড়ে উঠেছেন। সেখানে তো জিপসিরা ছিল আপনার প্রতিবেশী। কেমন ছিল তাদের সাথে সখ্যতা?
এমির: সব সময় নিজেকে হালকা জিপসি ভেবে এসেছি। তারা ভীষণ আদর্শবাদী মানুষ, যারা কখনই ইউরোপীয় ছাঁচে জীবন যাপন করবে না। তারা স্বাধীনচেতা এবং লড়াকু। বস্তুত, লড়াইটা তাদের টিকে থাকবার লড়াই। ছোটবেলায় কেউ যখন আমাকে জিপসি বলে ডাকত, কখনোই শব্দটাকে আমার গালি মনে হয়নি। খুশি হয়েছি বরং। আমি যেখানেই গিয়েছি তাদের মত অভিযোজিত হতে চেয়েছি। সবটা হয়তো পারিনি। শহরে তাদেরকে ডাকা হতো, ভারতীয় অথবা কালো। আমি একজন ভারতীয়-এই ধারণাটাই খুব ভালো লাগত। কেননা, জিপসিরা কোনো কিছুকে ভয় পায় না। এমনকি মৃত্যুকেও না। আমি সব সময় তাদের জন্য কাজ করেছি। প্রত্যেকটা সিনেমাতে দেখিয়েছি তাদের সংস্কৃতি, তাদের গান, তাদের নিজস্ব চরিত্র। তাদেরকে ইউরোপীয় ছাঁচে ফেলা সম্ভব না। তারা এতটাই স্বাধীনচেতা যে এটাই তাদের শক্তি।
অপ্টিমাম: মুসলিম, ক্যাথলিক এবং অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এই তিনটি ধর্মের অনুসারীদের এক মিলনাধারে বর্ষিত হয়েছেন আপনি। আপনার ওপর কি প্রভাব রাখতে…
এমির: সেই সময়ে যুগোস্লাভিয়া ছিল এক দুরন্ত অরণ্য যেখানে ফুটে থাকত পৃথিবীর সেরা ফুলগুলি। বলকানের সেই চিরকালীন সমস্যা—ক্যথলিকরা ভ্যাটিক্যানমুখী, অর্থোডক্সরা চেয়ে আছে মস্কোর দিকে আর মুসলিমদের চোখ মক্কার ঐতিহ্যে। এই তিন জাতি এক হতে পেরেছে কেবলি তাদের ঘৃণার সহবাসে, ভালবাসায় নয়। দুশো বছর আগে আমার পরিবারের একাংশ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু এ দিয়ে আমার পরিচয় নির্ধারিত হয়ে যায় না। আমার বাবা কখনোই ইসলাম ধর্মটি চর্চা করেননি। বর্তমানে আমি এক অর্থোডক্স খ্রিষ্টান; কাজেই অন্য ধর্মের প্রতি আমি যথেষ্টই সহানুভূতিশীল। যে বিষণ্ণতার ধারাবাহিকতা মুসলিমরা আমাদের উপহার দিয়েছিল, সেই প্রাচ্য সংস্কৃতিকে দেখেছি আমি খুব খুব কাছ থেকে।
অপ্টিমাম: আপনি কি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন?
এমির: হ্যাঁ। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। কিংবা বলা যেতে পারে এক অচেনা রহস্যময় শক্তিতে আমি আস্থা রাখি। কিন্তু কখনোই ধর্মচর্চা করিনি। আমি এটা বিশ্বাস করি যে, ধর্ম মানুষকে তার পরিচয়ের একটা ধারণা দিতে সক্ষম। কোনো এক নিশ্চিত শক্তিতে বিশ্বাস আমাদের নিজেদের গড়ে পিটে নিতে সাহায্য করে।
অপ্টিমাম: আপনার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাথে মিলোশেভিচপন্থী তকমাটি কি এখনো গেঁথে আছে?
এমির: অতীতে আমাকে আমার কাজকে ভুল বোঝা হয়েছে। অ্যালেন ফিঙ্কিয়েলক্রাউট এর মতো বুদ্ধিজীবী আন্ডারগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলেন-“একটি আমেরিকার অর্থ ও মদদপুষ্ট, আমেরিকার স্বার্থরক্ষাকারী প্রচারণা”। তার বক্তব্য অদ্ভুত। এই নিয়ে ঐ একই পত্রিকায় আমার প্রতিক্রিয়া লেখার পর তিনি স্বীকার করেছেন এই সিনেমা আসলে দেখেননি। আমাকে মিলোশেভিচ পন্থী বলে অভিযুক্ত করা হয় কারণ মানুষ সবাইকেই কোনো না কোনো ছাঁচে ফেলে দিতে হামেশা আগ্রহী। এতে করে তাদের চিন্তার প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যায়। মিলোশেভিচ এর একার হস্তক্ষেপে যুগোস্লাভিয়া ধ্বংস হয়ে যায়নি, হারিয়ে যায়নি। যুগোস্লাভিয়াকে ক্রমাগত ক্ষয় করেছে এর অর্থনীতি। প্যারিসবাসী ঐ মানবতাবাদী ন্যাকা বুদ্ধিজীবীদের আমার অসহ্য বোধ হয়। তারা বলকানদের জটিল ইতিহাস না জেনেই আমার দেশ সম্পর্কে ভালো মন্দের বিচার নির্ণয় করে। বসে থাকে। আরে এই ভালো মন্দের ধারণা কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণির সিনেমাতেই মেলা সম্ভব। বাস্তবজীবনে এই নির্ণয়ের কোনো অবকাশ নেই, ইতিহাসের ক্ষেত্রে তো আরও কম।
(সাক্ষাৎকারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এর নিয়মিত প্রকাশনা ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)