Skip to content Skip to footer

“সিনেমা মৃত, সিনেমা দীর্ঘজীবী হোক”

এদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্র লেখক, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম বিধান রিবেরু। পড়াশোনা করেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান, গণযোগাযোগ ও চলচ্চিত্র বিষয়ে। সম্প্রতি তিনি কান চলচ্চিত্র উৎসবের মর্যাদাপূর্ণ ফিপরেসি সেকশনের অন্যতম জুরি নির্বাচিত হন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের পত্রিকা আগন্তুকে ছাপানো হয় চলচ্চিত্র পরিচালক মাইক ফিগিসের বেস্টসেলার বই ‘ডিজিটাল ফিল্মমেকিং’ (২০০৭) অবলম্বনে নবীন নির্মাতাদের জন্য কিছু মৌলিক অথচ তাৎপর্যপূর্ণ এই লেখাটি।  

ডিজিটাল যুগে ছবি বানানো অনেকটা কফি বানানোর মতোই সহজ হয়ে উঠেছে। কারণ এখন চলমান ছবি ধারণের যন্ত্র যেমন সহজলভ্য ও বন্ধুসুলভ, তেমনি ছবি কাটাকাটি করার সম্পাদনা সফটওয়্যারও সকলের হাতের নাগালে এবং সেটা যে কেউ চালাতে পারে। এক হাতে সবকিছু করে তাই সহজেই ইউটিউবে ছবি প্রচারের চল এখন বেশ জনপ্রিয়। এসব ছবি সাধারণত দৈর্ঘ্যে একটু ছোট হয়। কিন্তু যদি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানাতে চান, যদি একটু পেশাদারিত্ব যোগ করতে চান, মানে আপনার ছবিতে একটু ভালো সিনেমাটোগ্রাফি থাকবে, আলোকসম্পাতের কাজটা দায়সারা গোছের হবে না, পেছনের সংগীতটা যেন জুতসই হয়, সম্পাদনাতেও যেন আনাড়ি ভাব না থাকে, তাহলেই আসলে ছবি বানানো কঠিন কাজ নয়। 

চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইক ফিগিস।

তবে জটিলতা অন্য জায়গায়। মাইক ফিগিসের মতে, ছবি বানাতে গেলে অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয় ঘটাতে হয় এবং সেটা ঘটাতে হয় একই সময়ে। আপনি চাইলেই শব্দ ধারণ বা আলোকসম্পাত বা অভিনয় বা ক্যামেরার কোণ ঠিক করার জন্য পুনরায় শুটিং করতে পারবেন না। সবকিছুর উপর নজর রাখতে হয় একই সময়ে। আর যদি ছোট বাজেটের ছবি হয় তাহলে তো আপনাকেই দায়িত্ব নিয়ে সবকিছুর সমন্বয় করতে হবে। তাই লো-বাজেট বা স্বল্প পুঁজির একজন পরিচালকের দশটা হাত আর দশ জোড়া চোখ থাকতে হবে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে মাইক ফিগিস কে? পুরো নাম মাইকেল ফিগিস, ইংরেজ চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও সুরকার। হলিউডে নির্মিত লিভিং লাস ভেগাস (১৯৯৫) ছবির জন্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ‘শ্রেষ্ঠ পরিচালক’ ও ‘শ্রেষ্ঠ আত্মীকৃত চিত্রনাট্য’ বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ঐ ছবিতে অভিনয় করে নিকোলাস কেইজ অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার তকমা পান। ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স (১৯৯০), টাইম কোড (২০০০), হোটেল (২০০১) ইত্যাদি ছবির জন্যও মাইক পরিচিত। এখনও পর্যন্ত ছবি বানিয়েছেন তেইশটি। তবে এগুলোর পাশাপাশি একটি বই তিনি লিখেছেন, নাম ‘ডিজিটাল ফিল্ম মেকিং’ (ফেবার অ্যান্ড ফেবার, ২০০৭), যা পরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বইটি নবীন ও স্বাধীন নির্মাতা, যারা লো-বাজেট মুভি বানাতে চান, তাদের জন্য দিকনির্দেশনামূলক বা কেজো বই বলতে পারেন। মাইক ফিগিস বইয়ের শুরুতেই নির্মাতাকে নিজের অস্ত্র বাছাই করে নিতে বলেন। মানে ছবি বানানো তো যুদ্ধের মতোই। কাজেই কোন অস্ত্র দিয়ে শ্যুট করবেন সেটা আগেভাগে ঠিক করে নিলে লড়াইয়ের ময়দানে সুবিধা হবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় নানা ধরনের ক্যামেরা বেরিয়েছে, সেসবের সাথে পরিচয় ঘটানোর পাশাপাশি, নিজের চোখকেও প্রশিক্ষিত করে নেয়ার পরামর্শ দেন মাইক। 

‘ডিজিটাল ফিল্ম মেকিং’ বইয়ের প্রচ্ছদ।

এরপর আসে বাজেট প্রসঙ্গ। জঁ-লুক গদার যেমনটা বলেছেন, “আমাকে বাজেট দেখাও, আমি তোমাকে চলচ্চিত্র দেখাবো।” চলচ্চিত্রকারদের জন্য এটাই সবচেয়ে কাজের উপদেশ বলে মেনেছেন মাইক। মাইক নিজে গদারের বেশ ভক্ত। বইয়ের বিভিন্ন পাতায় সেটার নজির আছে। এমনকি তার চলচ্চিত্র লিভিং লাস ভেগাস-এও গদারের ছাপ দেখা যায়। যারা ছবিটি দেখেছেন, তারা জানেন, সেরা (এলিজাবেথ স্যু) নামের এক যৌনকর্মীর সাথে সম্পর্ক হয় বেন স্যান্ডারসন (নিকোলাস কেইজ) নামের এক হলিউডভিত্তিক চিত্রনাট্যকারের। এই বেন চাকরিবাকরি খুইয়ে, পরিবার ছাড়া হয়ে, সবকিছু বেচেটেচে দিয়ে যখন লাস ভেগাসে গিয়ে নিজেকে মদ আর জুয়ার আসরেও ডুবিয়ে দিচ্ছে, তখন পরিচয় হয় সেরার সঙ্গে। অকাল বয়সে মারা যায় বেন। এটি জন ও’ব্রাইয়েন-এর লেখা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। তো এই উপন্যাস থেকে ছবি বানান মাইক। ছবিতে বেনের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেয় সেরা। এই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই ছবি এগুতে থাকে, ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে। সেরার এই সাক্ষাৎকারে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই গদারের জাম্প কাট।

লিভিং লাস ভেগাস চলচ্চিত্রে বেন স্যান্ডারসন (নিকোলাস কেইজ)।

যাহোক, বাজেট অধ্যায়ে বিনিয়োগকারীদের সম্পর্কে মাইকের উপলব্ধি সঠিক বলেই মনে হয়। তিনি বলেন, সাধারণত লোকে ছবিতে টাকা ঢালে কারণ তারা চলচ্চিত্রের রূপালি দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে এবং তারা জুয়াড়ি। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের সাথে স্টুডিও বা অন্য প্রতিষ্ঠানের খুব একটা পার্থক্য নেই। তো এই জুয়াড়িদের সাথে কীভাবে একজন নির্মাতা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে পারেন, সেই ব্যাপারেও পরামর্শ দেন মাইক। তবে এই সংক্রান্ত জরুরি একটি পরামর্শ দেন তিনি, সেটি হলো, নির্মাতাকে বলছেন, “আপনি যদি শয়তানের কাছে নিজেকে বিক্রি করেন, তাহলে একদিন সে ফিরে এসে আপনার দরজায় টোকা দিয়ে অর্থ ফেরত চাইবে, সুদ ও আসল দুটোই।” কাজেই যত বড় বাজেট হবে, ততই আপনার হাতের মুঠো থেকে ছবিটা বেরিয়ে যেতে থাকবে। 

প্রি-প্রোডাকশন পর্যায়ে বাজেট ছাড়াও আরো একটি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়, সেটি হলো লোকেশন। লোকেশন খুঁজে পাওয়া, সেখানে যাতায়াতের জন্য পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্রাফিক, আবহাওয়া ইত্যাদি বলে-টলে লাইন প্রোডিউসার আপনার মাথা খারাপ করে দিতে পারে। তবে মাইকের পরামর্শ আপনি একজন ভালো লোকেশন ম্যানেজার খুঁজে বের করুন, তাকে দায়িত্ব দিন, লোকেশনের চেহারা সে ভালো করে তুলেই শুধু আনবে না, লোকেশন সম্পর্কে সবকিছু ভালোভাবে জেনে আসবে এবং আপনাকে সহায়তা করবে। তাছাড়া মাইক ঠিকই বলেছেন, এতো জটিল গল্প ভাবতে যাবেন না, যার জন্য লোকেশন খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। ভালো গল্প বাছাই ও এরপর চিত্রনাট্যের সাথে সংযোগ স্থাপন, স্টোরিবোর্ড করা, শটের তালিকা করা, শুটিংয়ের আগে ইউনিটের সকলকে নিয়ে পরিকল্পনা ও সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলে অনেকটাই ভারমুক্ত হয়ে ছবি তৈরি করা যায়। তারপরও শুটিংয়ের সময় অনেক উটকো ঝামেলা এসে পড়তে পারে। মাইক বলছেন, “ছবি বানানোটাই একটা জটিল প্রক্রিয়া, পরিস্থিতি সামাল দিতে দিতেই এই প্রক্রিয়া খতম করতে হয়।”

শুটিং চলাকালেই সম্পাদনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন মাইক। শুটিংয়ের সময় যেসব বিষয়ে নজর রাখতে হয়, যেমন আলো ও রং, ক্যামেরার কাজ, অভিনয়শিল্পীদের নির্দেশনা এগুলো নিয়েও আলাপ করেন তিনটি আলাদা অধ্যায়ে। ডিজিটাল ছবি করিয়েদের জন্য মাইক পরামর্শ দেন, চিত্রনাট্যে যদি নির্দিষ্ট করে বলা না থাকে, তাহলে কারো মুখের উপর সরাসরি আলো ফেলার দরকার নেই। প্রতিফলিত আলো ফেলে কাজ করলে, সেটার ফল ভালো পাওয়া যায়। মাইক নিজেও সেটা করেন। নিজের সাথে কয়েকটি ছোট আকারের ফ্ল্যাশলাইট বহন করার পরামর্শও দেন তিনি। আর প্রয়োজন না হলে কৃত্রিম আলো প্রয়োগের একেবারেই পক্ষপাতী নন মাইক। ডিজিটাল ক্যামেরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে, উন্নত প্রযুক্তি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, কৃত্রিম আলো ছাড়াই ডিজিটাল ক্যামেরায় রাতের বেলার কম আলোতেও ভালোভাবে শুট করা যায়। দরকার হলে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করা যেতে পারে। কম্পিউটারের স্ক্রিনও বেশ কাজের। তবে ফিল্মি জমানার মতো, লোকেশনে জমকালো লাইট করা ডিজিটাল ছবিওলাদের সাজে না। অনেকেই আছেন, যারা বেশি দামের লাইট কেনেন সেটের জন্য। অল্প বাজেটের ছবির জন্য বেশি দামের লাইট কেনার কোনো দরকার নেই। লাইটের কাজ আলোক উজ্জ্বল করে তোলা, সেটা হলেই হলো। মাইক এক্ষেত্রে একখানা কৌতুক শোনান। তিনি বলেন, “ভালো চুল কাটা আর খারাপ চুল কাটার মধ্যে পার্থক্য কি? মাত্র দুই সপ্তাহ।” লাইটের বেলাতেও তাই। আলো তো আলোই, সেটা দামি লাইট থেকে এলো, না সস্তা লাইট থেকে এলো, সেটা মুখ্য নয়। নিজের হোটেল ছবিতেও মাইক প্রাকৃতিক আলোকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, আর দৃশ্যের সঙ্গে যেসব যায়, যেমন ঘরের বাতি বা মোমবাতি, সেসব দিয়েই লাইটের কাজ সেরেছেন।

আলোর পাশাপাশি চলচ্চিত্রে রং অনেক বড় ধরনের অর্থ বহন করে । ডিজিটাল কাজে রং তো এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, পরিচালক চিত্রশিল্পীর মতোই তার ছবিতে রং ব্যবহার করতে পারেন। শুটিংয়ের সময় যেমন আলোকসম্পাত বা লেন্সে ফিল্টারের মাধ্যমে রঙের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যায়, তেমনি শুটিংয়ের পর সম্পাদনার টেবিলেও রং নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকে। 

আলো আর রং না হয় ঠিকঠাক হলো, ক্যামেরার কাজ? সেটাও কোনো অংশে কম নয়। আগে তো ফিল্মের ক্যামেরা এতো ভারি ছিল যে ক্যামেরার অবস্থান বুঝে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় করতে হতো। যত দিন গেছে ক্যামেরা হালকা হয়েছে। ক্যামেরা একসময় শিল্পীদের অনুসরণ করতে শুরু করলো। দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে ক্যামেরা এখন হয়ে উঠেছে দর্শকের গোপন চোখ, যা সার্বক্ষণিকভাবে অনুসরণ করে ছবির চরিত্রদের। এটা যেন এখন স্টাইলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে কারণে-অকারণেই যে ক্যামেরা নড়াচাড়া করতে থাকে, তাতে খুবই বিরক্ত মাইক। তার বক্তব্য হলো, “যেখানে গল্প বলার ক্ষেত্রে ক্যামেরাকে চলতে হবে, সেখানে ক্যামেরা চলবে। কিন্তু অযথা ক্যামেরাকে প্যান, ট্রলি, ডলি করার কোনো অর্থ হয় না।” ক্যামেরায় গতি যোগ করা ভাইরাসের মতো ঢুকে পড়েছে প্রায় সর্বত্র। এমনটা হওয়া উচিত নয়। ক্যামেরা যদি নড়াচাড়া করে তো পরিচালককে প্রশ্ন করা দরকার, “ভাই ক্যামেরা নড়ছে কেন?” উত্তর যদি হয়, “জানি না”; তো পরামর্শ হলো ক্যামেরাকে তেপায়ার উপর স্থির হয়ে বসতে দিন। এখন কোন জায়গায় ক্যামেরা বসবে সেটা নির্ভর করে আপনার দেখার চোখ কত ভালো সেটার উপর। 

সিনেমা নির্মাণে ট্রাই-পডে বসানো ক্যামেরা।

নতুন নির্মাতাদের নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। শুটিংয়ের সময় ক্যামেরা কোথায় বসাবেন সেটা যেমন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, তেমনি আপনার অভিনয়শিল্পীদের কী নির্দেশ দেবেন সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে আসে। চলচ্চিত্রে দুই ধরনের অভিনয়শিল্পীর মুখোমুখি হতে পারেন নতুন নির্মাতা। এক, অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিল্পী, যারা নিজেদের কাজ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন। দুই, যারা অনভিজ্ঞ, কিন্তু অভিনয়ের কিছু কৌশল তাদের জানা আছে, আর আছে কাজ করার অদম্য ইচ্ছা। তো শুটিংয়ে তাদের নির্দেশনা দিতে গেলে নির্মাতাকেও আসলে অভিনয় সম্পর্কে কিছুটা জানতে হবে। নয়তো ঠিকঠাকভাবে শিল্পীদের বলা যাবে না নির্মাতা কী চান তাদের কাছে। নতুন নির্মাতাদের সঙ্গে অনেক সময় অভিজ্ঞ শিল্পীরা একটু রূঢ় আচরণও করে থাকেন। এতে অনেকে ভড়কে যান। মাইকের পরামর্শ, শিল্পীদের অহমের সাথে কিছুটা সময় কাটান। যেহেতু এটা আপনার ছবি, তাই আপনি জানেন শেষ পর্যন্ত গোটা ছবিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা বুঝিয়ে বলুন শিল্পীকে। যদি তার কোনো মতামত থাকে, সেটা শুনুন, তবে সেটাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত ছবিটি আপনার। আপনিই এটির কাপ্তান। যদিও প্রতিনিয়ত নানা ধরনের প্রশ্নে জর্জরিত থাকতে হয় নির্মাতাকে এখন কী করবো? কাল কী হবে? নায়িকার মুড খারাপ হয়ে গেছে, উপায় কী? দুপুরের খাবারে কী খাবেন? ইত্যাদি। এসব ছোটবড় ঢেউ সামাল দিয়েই আপনাকে ছবি বানাতে হবে। জাহাজকে নিয়ে যেতে হবে বন্দরে। 

যে দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করছেন, সেই দৃশ্যের মূল উদ্দেশ্য কী? দৃশ্য ধারণের পর সেটা আপনার প্রত্যাশাকে পূরণ করতে পারছে কি না? যদি না করতে পারে, তো সেটার কারণ কী? এখান থেকে উত্তরণের পথই বা কোনটি? এসব প্রশ্ন মাথায় রেখে যদি নতুন নির্মাতা শুটিংয়ে হাত দেন, তাহলে অভিজ্ঞ বা অনভিজ্ঞ সব শিল্পীদের নিয়ে কাজ করাটা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাছাড়া আপনি যদি শিল্পীদের সবসময় ব্যাখ্যা করে দেন যে এই দৃশ্য ধারণের পেছনের কারণটি কী বা গোটা ছবিতে এই দৃশ্যের গুরুত্ব কতটুকু, দেখবেন শিল্পীরাও আপনাকে সহায়তা করছেন। মূল ব্যাপার হলো, শিল্পীদের মনে তো আর আপনার মতো গোটা ছবির দৃশ্যকল্প আঁকা নেই, তাদেরকে সেই দৃশ্যকল্পে প্রবেশ করতে দিন। এবং কাজটি যেন তারা মনের আনন্দ নিয়ে করেন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি কথা মনে রাখতে বলেন মাইক, এক অভিনয়শিল্পীর কাছ থেকে অন্য অভিনয়শিল্পীর মতো অভিনয় আশা করবেন না। প্রত্যেকেই আলাদা এবং তারা অন্যদের চরিত্রে অভিনয় করেন। 

শিল্পীদের সাথে কেবল বুঝেশুনে চললেই পরিচালকের রেহাই নেই। শুটিং চলাকালে তাকে ক্যামেরার দিকে যেমন নজর রাখতে হয়, তেমনি লেন্সের ধুলোবালি পরিষ্কার আছে কি না, ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয়েছে কি না, এমনকি যে দৃশ্যধারণ করা হচ্ছে, সেটার লগিং ঠিকঠাক হচ্ছে কি না সেসব দিকেও চোখ রাখতে হয়। ডিজিটাল ছবি নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই লগিং। কোন টেপ বা কার্ডে কী ছবি রাখা আছে সেটা ঠিকঠাক লিখে না রাখলে সম্পাদনার টেবিলে অনেক অসাধারণ ক্যামেরার কাজ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। সম্পাদনায় যাওয়ার আগে মূল ফুটেজটির একটি মাস্টার ও দুটি নকল করে রাখাটা বাঞ্ছনীয়। এবং এই তিনটি যদি তিন জায়গায় রাখা যায় তো আরো ভালো। এতে করে নানা রকম ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সস্তায় অনেক স্টোরেজ সিস্টেম কিনতে পাওয়া যায়, নকল রাখার জন্য সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার হার্ডড্রাইভে পুরোনো কোনো কাজের অপ্রয়োজনীয় ছবি মুছেও নতুন কাজের ছবি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে এই সুবিধা তো আছেই।

ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে অনেকে যত ইচ্ছা ছবি তোলেন, সেটা তোলা যেতেই পারে, তবে সেটার সাথে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে শব্দ ধারণের বিষয়টি। শুটিং লোকেশনে যদি শব্দধারণ ঠিকভাবে না করা হয়, পরে সম্পাদনার টেবিলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কাজেই কোন মাইক্রোফোনের কী কাজ এবং শুটিংয়ের সময় কোথায় সেটিকে বসালে আকাঙ্ক্ষিত শব্দ ধারণ করা যাবে, সেটাও আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে। এর কারণ, ছবির গল্পকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যায় এই ধারণকৃত শব্দ; হতে পারে স্টুডিও বা লোকেশন থেকে ধারণ করা, অথবা পরে ফলি আর্টিস্টের মাধ্যমে।

ছবিতে শব্দ তো নানা ধরনের থাকে, দৃশ্য অনুযায়ী পরিবেশের শব্দ, সংলাপ, প্রপস্ ব্যবহারের শব্দ ইত্যাদি। তবে শব্দ হিসেবে আবহসংগীতের ব্যবহার কিন্তু সেই নির্বাক যুগ থেকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই যুগে ছবিতে কোনো শব্দ না থাকলেও, পর্দার পাশেই বাদ্যবাজনার দল থাকতো, তারা দৃশ্য অনুযায়ী বাদ্যযন্ত্র বাজাতো। দর্শক উপভোগ করতো ছবি ও সংগীত। মাইক ফিগিস মনে করেন, সংগীত হলো চলচ্চিত্রের মানসিক মেরুদণ্ড। আধুনিককালে অনেক নির্মাতাই ছবিতে সংগীত ব্যবহার করতে চান না। মাইক বলছেন, “আপনি যদি ছবিতে সংগীত ব্যবহার না করেন, শুধু কথাবর্তা বা অন্য শব্দ থাকে, তাহলে কিছুক্ষণ পর দর্শক আর সংগীতের অনুপস্থিতিকে মনে রাখবে না। কিন্তু একবার যদি আপনি ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য হলেও সংগীত ব্যবহার করেন, তাহলে দর্শকের মন ছবির অন্য দৃশ্যেও সংগীত প্রত্যাশা করবে। এটা অনেকটা সীমা অতিক্রমের মতো। সংগীতের সীমায় পা রেখেছেন তো, সেখানেই আপনাকে থাকতে হবে, ফিরে এলে সুর কেটে যাবে।” 

এখন সংগীত যে ব্যবহার করবেন, কোত্থেকে নেবেন এই সংগীত? মাইক মনে করেন, আগে থেকে তৈরি করা বা বাজার চলতি কোনো পরিচিত সংগীত ব্যবহার না করাই ভালো। আপনার পরিচিত কোনো সংগীতের দল থাকলে, কম খরচে তাদের দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করিয়ে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অথবা সেই দলের যদি অপ্রকাশিত আগের কোনো গান বা কম্পোজিশন থাকে এবং সেটি যদি আপনার ছবির মুডের সাথে যায়, তাহলে সেটিও ব্যবহার করতে পারেন। সংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাইক অবশ্য মনে করিয়ে দেন যে, ছবিতে এই যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার হয়, সেটিকে কিন্তু আন্ডারস্কোর বলে, ‘আন্ডার’ মানে যা দৃশ্যের নিচে থাকবে। কাজেই সংগীত যেন দৃশ্যকে ছাপিয়ে না ওঠে, যেন ‘ওভারস্কোর’ না হয়ে যায়। আবহসংগীতের ভূমিকা হবে গল্পের টানাপোড়েনকে বাড়িয়ে দেয়া বা আবেগকে ঘন করা, অর্থাৎ ছবিকে সহায়তা করা, নেতৃত্ব দেয়া নয়। আর আবহসংগীত যতটা সরল রাখা যায়, ততই ভালো। সার্জিও লিওনির স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ফিল্মে সংগীত পরিচালকের কাজ করেছিলেন এননিও মরিকোনে। তিনি বলেন, “হারমোনিক কমপ্লেক্সিটি নিয়ে কম ভাবুন, শব্দের কম্বিনেশন নিয়ে বেশি ভাবুন।” যারা লিওনির ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট (১৯৬৮) দেখেছেন, তারা জানেন সেখানে নাটকীয় দৃশ্যে শুধু হারমোনিকার শব্দ কেমন টনিকের মতো কাজ করেছে।

ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট চলচ্চিত্রের হারমোনিকার বিখ্যাত দৃশ্য।

নতুন নির্মাতার ক্ষেত্রে যা হয়, তারা সংগীত পরিচালকের কাছে গিয়ে নিজেকে সমর্পণ করেন, যেহেতু সংগীত সম্পর্কে তার অতোটা জানাশোনা নেই। সংগীত পরিচালক যখন কিছু একটা বানিয়ে দেন, তখন আর সেটা নির্মাতার পছন্দ হয় না, কারণ নির্মাতা জানেন কোনটা ছবিতে লাগসই হবে, তবে কোন ধরনের সংগীত তার চাই, সেটাও তিনি পরিষ্কার করতে পারেন না। তাই মাইক ফিগিস নতুন নির্মাতাকে বলেন, “ভাই আপনি যদি সংগীত পরিচালককে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে চান, তাহলে সংগীত সম্পর্কে দু’কলম জেনে রাখুন।” সেটা কী? সুরের কড়ি (মেজর) ও কোমল (মাইনর) সম্পর্কে ধারণা নিন। প্রকারীয় সংগীত (মোডাল মিউজিক), যা একটি চাবিতে স্থির থাকে, কিন্তু স্বনতা (টোনালিটি) বজায় রেখে ঐকতান বা হারমোনির বিবর্তন ঘটাতে পারে, সেটি সম্পর্কে জেনে নিন। সুর (নোট) ও স্বরসংবাদ (কর্ড) কোনটি কখন, কোন সংগীতযন্ত্রে বাজবে অর্থাৎ স্বরযুক্ত করা বা ‘ভয়েসিং’ সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। 

সংগীত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মাইক নিজের লিভিং লাস ভেগাস, লুই মালের লিফট টু দ্য স্ক্যাফল্ড (১৯৫৮) ছবিগুলো নিয়ে আলাপ করেন। লে মেপ্রিস ছবিতে জর্জ ডেলেরুকে দিয়ে এক টুকরো সুর করান গদার এবং সফলভাবে ঐ ছবির দশটি ভিন্ন দৃশ্যে একই সুর ব্যবহার করেন। দৃশ্যগুলোতে সুরটি যেন হাজিরা দেয় মন্তব্যের আকারে। 

অতএব, সংগীত যেন ছবিতে ভিন্ন মাত্রা এনে দিতে পারে সেদিকেও নজর রাখার পরামর্শ দেন মাইক। আর মন খুলে নিরীক্ষা করার পক্ষেও মত দেন তিনি। ছবি করার পরিকল্পনা, বাজেট, শুটিং, সম্পাদনা, সংগীতায়োজন ইত্যাদি সব যখন শেষ হয়ে যায়, তখন গোটা ছবিটি প্রস্তুত হয়ে যায় প্রদর্শিত হওয়ার জন্য। এ পর্যায়ে দরকার প্রচার ও পরিবেশক নিয়োগ। ছবি নানা পদ্ধতিতেই দেখানো যেতে পারে। বিকল্প প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখন বড় ভূমিকা পালন করছে। তবে যারা সিনেমা বলতে শুধু প্রেক্ষাগৃহকেই বোঝেন, যেখানে কয়েকশো লোক অন্ধকারে একসাথে বসে ছবি দেখবে, তাদের উদ্দেশ্যে ঝাঁঝালো বক্তব্য মাইকের। তিনি বলেন, “মোটামুটি দামের প্রজেক্টরের মাধ্যমে সাদা দেয়াল বা পর্দার উপর ফেলা ছবি দেখতে যখন যেখানে মানুষ চেয়ার পেতে বসে, তখন সেটাই সিনেমা।”

বইয়ের শেষ অধ্যায়ের শেষ লাইনে মাইক মন্তব্য করেন, “সিনেমা মৃত, সিনেমা দীর্ঘজীবী হোক”। কথাটি আপাত সাংঘর্ষিক শোনালেও মাইক আসলে বোঝাতে চেয়েছেন পুরোনো সিনেমার ধারণা আজ মৃত, আর নতুন সিনেমার ধারণা তৈরি হচ্ছে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে সিনেমা নির্মাণে ও প্রদর্শনেও আসছে নতুন সংস্কৃতি। তাই সিনেমা বেঁচে থাকবে, ভিন্ন ভঙ্গিতে, ভিন্ন কাঠামোতে, ভিন্ন সময়ে।

Leave a comment