Skip to content Skip to footer

জীবনের শেষ দশ বছরে আমার মা ধীরে ধীরে তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। তাকে দেখার জন্য আমি জারাগোজায় যেতাম, যেখানে তিনি আমার ভাইদের সাথে থাকতেন। আমি লক্ষ করতাম কীভাবে তিনি পত্রিকা পড়েন, খেয়াল করে পাতা ওলটান, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। পড়া শেষে বলে দিতাম, শুধু দেখার জন্যই তিনি পত্রিকাটির প্রতিটি পাতা ওলটাচ্ছেন, পড়ার জন্য নয়।

তার ছিল চমৎকার স্বাস্থ্য আর বয়সের তুলনায় ছিলেন রীতিমত চটপটে, কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে এসে তিনি নিজের সন্তানদের চিনতে পারতেন না। তিনি বুঝতে পারতেন আমরা কে, অথবা তিনি নিজেই বা কে। আমি তার ঘরে যেতাম এবং চুমু খেয়ে কিছুক্ষণ তার সাথে বসতাম। কখনো বা আমি উঠে গিয়ে আবার মুহূর্তের মধ্যেই চলে আসতাম। তিনি আমাকে একইভাবে সম্ভাষণ জানাতেন এবং বসতে বলতেন যেন তিনি আমাকে প্রথমবারের মতো দেখছেন। আমার নাম তার মনে ছিল না।

স্কুলে পড়ার সময় আমি স্পেনের সব রাজাদের নাম জানতাম। সেই সাথে ইউরোপের সব দেশের আয়তন ও জনসংখ্যার তথ্যও ছিল জানা। আসলে আমি ছিলাম অপ্রয়োজনীয় সব বিষয়ের স্বর্ণখনি। এসব বিষয়ে আমার দক্ষতা ছিল অজস্র কৌতুকের উপলক্ষ। তবুও এসব গুরুত্বহীন বিষয়ে আমার আগ্রহের শেষ ছিল না। এখন আমি সে সব স্মৃতি হেসেই উড়িয়ে দেই তা কিন্তু নয়। আমরা আসলে সময়ের সাথে সাথে আমাদের ভেতর অবচেতনভাবে গড়ে ওঠা স্মৃতিগুলো সম্পর্কে কখনো ভাবি না। ব্যাপারটা শুধু তখনই উপলব্ধি করতে পারি, যখন আমরা কোনো কাছের বন্ধু বা আত্মীয়ের কথা আর মনে করতে পারি না। যেন বই থেকে খুব সহজেই তার সম্পর্কিত সবগুলো পাতা ছেঁড়া হয়েছে আর আমরা ভুলে গেছি। ভুলে গিয়ে আমরা রেগে যাই আর দু-একটি স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। ঘটনাটা আমাদের ঠোঁটে এসে আটকে যায়, শব্দ হয়ে ভূমিষ্ঠ হয় না।

এক বার এরকম হওয়ার পর তা ক্রমশই বাড়তে থাকে আর তখনই আমরা স্মৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করি। আমার বয়স যখন সত্তরের কাছাকাছি তখন এই ধরনের অ্যামনেশিয়া প্রথম আমার উপর ভর করে। এটা শুরু হয় বিভিন্ন জিনিসের নাম আর নিকট অতীত দিয়ে। আমার লাইটারটা কোথায় যেন রেখেছি (পাঁচ মিনিট আগেই এটা আমার হাতে ছিল)? আমি কী যেন বলতে চেয়েছিলাম? খুব দ্রুত অ্যামনেশিয়া ছড়াতে ছড়াতে ঘটনাকে খেয়ে ফেলে। ১৯৮০ সালের সে মাসে আমি যেন মাদ্রিদের কোন হোটেলে ছিলাম? ছয় মাস আগে কোন বইটি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম? স্মৃতি হাতড়ে আমি বারবার ব্যর্থ হই। আমার কিছুই করার নেই, অ্যামনেসিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো ছাড়া। এটা সেই পর্যায় যা মুছে দিতে পারে সম্পূর্ণ একটি জীবন, যেমনটি হয়েছে আমার মায়ের।

লুই বুনুয়েল

তবে এখন পর্যন্ত আমি জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়কে ঠেকিয়ে রেখেছি যা প্রতিনিয়ত আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এখনও আমি অসংখ্য নাম ও মুখ মনে করতে পারি। যদি কোনোটি ভুলে যাই তো শান্ত থাকার চেষ্টা করি। আমি জানি অবচেতন সত্তার দুর্ঘটনায় হঠাৎ করে তা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা বা সদ্য পরিচিত হওয়া কেউ অথবা বহুল ব্যবহৃত কোনো জিনিসের নাম ভুলে গেলে হতাশা আমাকে গ্রাস করে ফেলে। মনে হয়, যেন এটা আমার ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত। আমার মন যেন কোথায় ডুবে যায় আর আমি কিছুই চিন্তা করতে পারি না। আমার সব চেষ্টা ও ক্রোধ আমাকে গন্তব্যহীন অবস্থায় নিয়ে ফেলে। আমি একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যাব? ‘টেবিল’ বর্ণনা করার জন্য একটি রূপক খোঁজার বাধ্যকতা সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই জগতে এর চেয়েও খারাপ অবস্থা আছে। তা হলো বেঁচে থাকা অথচ নিজেকে না চেনা, নিজের সম্পর্কে কিছুই মনে না থাকা।

আপনি যদি খণ্ডে খণ্ডে স্মৃতি হারাতে থাকেন তাহলেই অনুধাবন করতে পারবেন আমাদের জীবনটা স্মৃতি দিয়ে গড়া। স্মৃতি ছাড়া জীবন কোনো জীবনই নয়। যেমনটি প্রকাশভঙ্গি ছাড়া বুদ্ধিমত্তা আসলে কোনো বুদ্ধিমত্তাই নয়। স্মৃতি আমাদের জীবনের সুর, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের অনুভূতি, এমনকি আমাদের অবস্থা। এটা ছাড়া আমরা কিছুই না।

একটি দৃশ্যের কথা কল্পনা করুন যেখানে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে একটি গল্প বলার চেষ্টা করছে । প্রতি চার শব্দের পর একটি করে শব্দ ভুলে যাচ্ছে। খুব সাধারণ শব্দ যেমন গাড়ি, এলাকা অথবা পুলিশ। সে তোঁতলাচ্ছে, ইতস্তত করছে আর বাতাসে হাত নেড়ে শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে, বন্ধুটি বিরক্ত হয়ে তাকে চপেটাঘাত করে চলে যায়। মাঝে মাঝে এই ভীতিকর অভিজ্ঞতাগুলো অনুধাবন করানোর জন্য আমি অন্যদের একটি গল্প বলি যেখানে এক লোক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায় স্মৃতিবিভ্রান্তির সমস্যা নিয়ে। সাইকিয়াট্রিস্ট তাকে কিছু রুটিন প্রশ্ন করেন: “তাহলে এই স্মৃতিবিভ্রান্তি?” “কিসের স্মৃতিবিভ্রান্তি?”—লোকটির ঝটপট জবাব।

স্যাল্ভাদর দালির আঁকা লুই বুনুয়েল

স্মৃতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ আর এর আছে যেকোনো কিছু করার জাদুকরি ক্ষমতা। সেই সাথে তা ক্ষয়িষ্ণুও বটে। স্মৃতিবিভ্রান্তির হুমকি সব জায়গায়, শুধু ভুলে যাওয়াতে নয় বরং মিথ্যা স্মৃতি তৈরিতেও। যেমন: প্রায়ই আমার বলা ১৯৩০ এর দশকে পল নিজানের বিয়ের গল্পটি। আমার পরিষ্কার মনে আছে তার বিয়ে হয়েছিল সেন্ট জারমেই-দো-প্রে চার্চে। বিয়ের অনুষ্ঠানটি আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। সব অতিথিদের মুখ আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। এমনকি জ্যঁ পল সার্ত্রেরও মুখখানি, যিনি ছিলেন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। হঠাৎ করেই গত বছরের কোনো একদিন আমার মনে হলো এটা তো অসম্ভব। নিজান ছিল কট্টর মার্কসবাদী আর তার স্ত্রী ছিল অজ্ঞেয়বাদে বিশ্বাসী পরিবারের মেয়ে। তাদের বিয়ে তো কখনোই একটি চার্চে হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি এটা আমি নিজে কল্পনা করে নিয়েছি? হয়তো আমি অন্যের কাছ থেকে শোনা কোনো গল্পে আমার খুব পরিচিত কোনো চার্চ বসিয়ে দিয়েছি। এমনকি আজও আমি মনে করতে পারিনি আমি কীভাবে এই গল্প তৈরি করেছি কিংবা আসল সত্যটাই বা কী। আমাদের কল্পনা ও স্বপ্নগুলো সব সময়ই আমাদের স্মৃতিকে দখল করে চলছে। আমাদের ফ্যানটাসিগুলোর সম্ভাবনায় বিশ্বাস করি বলেই শেষ পর্যন্ত মিথ্যাগুলো বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। অবশ্যই ফ্যানটাসি আর বাস্তবতা দুটোই ব্যক্তিগত, আর সমানভাবে অনুভূত হয়—তাই এদের মিলিত হওয়াটাও প্রাসঙ্গিক।

আমি আমার এই আত্মজীবনীতে প্রায়ই বিষয় পরিবর্তন করেছি উদ্দাম গতিতে ছুটতে থাকা ঘোড়ার মতো। কিছু কথা বলা হয়নি আর সন্দেহাতীতভাবে কিছু মিথ্যে স্মৃতি রয়ে গেছে আমার পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও। কিন্তু আগেই বলেছি, এটা তেমন কোনো ব্যাপার নয়। আমার ভুল ও সন্দেহ সেই সাথে আমার নিশ্চয়তা—এসব মিলিয়েই আমি। যেহেতু আমি কোনো ইতিহাসবিদ নই, আমার কোনো তথ্যকোষ নেই। তবুও যে ছবিটা এঁকেছি তা একান্তই আমার নিশ্চয়তা, আমার বিভ্রান্তি, আমার পুনরাবৃত্তি ও ভুলে যাওয়া স্মৃতি। আমার সত্য ও আমার মিথ্যা–এরকমই আমার স্মৃতি।

প্রবন্ধটি খ্যাতনামা স্প্যানিশ-মেক্সিকান চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাই লাস্ট ব্রেথ’ থেকে অনূদিত।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ এর লাতিন চলচ্চিত্র সমাচার সংখ্যা থেকে সংকলিত)

1 Comment

  • mehedi hasan
    Posted September 29, 2021 at 1:06 AM

    good thinking and writing

Leave a comment