Skip to content Skip to footer

সুমন মুখোপাধ্যায়ের হারবার্ট: চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া চলচ্চিত্র

লেখক: ইমরান ফিরদাউস

২০০৮ সালের জানুয়ারির কোনো এক সন্ধ্যায় আমি ও আমার বন্ধুরা বেমক্কা নিজেদের নাম ভুলে বসলাম। কেউ কাউকে আর কোনো নামে ডাকছিলাম না। আমাদের বোধিতে নতুন নাম খচিত হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে; এবার আকিকা ছাড়াই আমাদের নাম হয়ে গেল হারবার্ট। জাতীয় জাদুঘরে সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ডেবিউ সিনেমাটা দেখতে গিয়ে এই নব পরিচয়ের উত্থান; তখন একটা চলচ্চিত্র উৎসব চলছিল, উৎসবের শ’খানেক সিনেমার ভীড়ে এক কোণে দর্শক আকর্ষণের আড়ালে থাকা মুখার্জি মশাইয়ের সিনেমাটা আমাদের দর্শনীর জন্য নির্ধারিত হলে, আমরা বেশ হালকা চালে সিনেমাটা (শুধু) দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু নির্মাতা আমাদের হারবার্টের কারবার দর্শনে মাফ না করে ভাসিয়ে নিলেন উজান স্রোতে।

ঘণ্টা দুয়েক বাদে যখন ‘দ্য এন্ড’ দেখা গেল তখন মনে হচ্ছিল এইটা কি সিনেমা ছিল, নাকি আমরা একটা সাইকেডেলিক ট্রিপে ছিলাম! বেশ নেশা নেশা ঘোর আমেজ মস্তিষ্কের কোষগুলিকে আয়েশি চালে অবশ করে দিচ্ছে, আমার পাতিবুর্জোয়া শুঁয়োপোকাটা কতক্ষণ ধস্তাধস্তি করে আপনা থেকেই খ্যামা দিলে আমরাও বাড়ির পথ না ধরে পথে পথে চাঁদের আলোয় কি জানি খুঁজতে থাকি কিন্তু পাই না কিছুই; পাই শুধু মোনাফেকি রাজনৈতিক বাস্তবতা। এর মাঝে হারবার্ট (২০০৫) ভ্রমণ আমাদের মগজে এক চিরস্থায়ী নিঃসঙ্গতা-প্রেম-মৃত্যু-ভালবাসার বিবমিষা বোধের বন্দোবস্ত করে দেয়…

‘আনন্দনগর কলকাতা’ বললেই দ্যোতিত হয় বাম আন্দোলন। ইংরেজ খেদাও কর্মসূচী হতে শুরু করে ষাটের দশকের উত্তাল সময় এমনকি সাম্প্রতিককালের নন্দীগ্রামের ঘটনা নগরের এই চরিত্রকে প্রক্ষিপ্ত করে। লেখক অশোক মিত্র বলেন, “কলকাতা ভারত উপমহাদেশের বাম আন্দোলনের সূতিকাগার।” হালে এই দ্যোতনাটি ক্ষয়িষ্ণু হলেও সাধারণের মাঝে এই প্রতীকটির প্রচলনই অধিক। ষাটের দশকের কলকাতা আর একুশ শতকের কলকাতার প্রত্ম-মানসিক তফাৎ চোখে পড়ার মতো। কলকাতা এখন আইটি কোম্পানি আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের রমরমা বাজার, মধ্যবিত্তের ঘর হতে খোঁচা দাড়ি-মুখের কোনো যুবক ঝোলা কাঁধে বেরোয় না আর, কথায় কথায় লালবই থেকে কোট করে না; এখন তারা ঝকঝকে বেশে সাইবার কুলিগিরি আর মার্কিন ঢঙে চোস্ত ইংরেজি বোলচালে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

এহেন সামাজিক বাস্তবতায় মঞ্চনাট্য পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় বেছে নিলেন ১৯৯৭ সনের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত নবারুণ ভট্টাচার্য্যের ‘হারবার্ট’ উপন্যাসটি। হারবার্ট সরকারের ছুতোয় কলকাতা-জনজীবনের ছাইচাপা, বিগত পাঁচ দশকের বদলে (পাল্টানোর নয়) যাবার বয়ান হাজির করে।

কলকাতাকে কেন্দ্র করে সুমন গাঢ় বাদামি (সেপিয়া) ও রঙিন ছবিমালার যে বৃত্তটি রচনা করেছেন তা হারবার্ট সরকার নাম্নী জ্যা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে আকস্মিক বদলে যাওয়া (তথাকথিত) আধুনিক কলকাতার সঙ চরিত্রখানি মেলে ধরে। হারবার্ট আমার কাছে ধরা দেয় শিল্পী রশীদ চৌধুরীর আধো-রঙিন ইমেজের ঠাসবুনটের জটিল ট্যাপেস্ট্রির চেহারায় যা পাঠে-অবলোকনে দর্শকের মনঃকল্পিত অভ্যস্ত পৃথিবীর আরশ কেঁপে ওঠে কেননা ঐ মুহূৰ্তমালাগুলি নিয়মিত র‍্যাশনালিটির প্রতি শুধু তাচ্ছিল্য করে না, আমাদের জ্ঞানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

হারবার্ট কে?

হারবার্টের পরিচয় কী? সে এক জন হাতুড়ে বৈদ্য, নাকি জোকার? অপরাধী নাকি কুচক্রী? নাকি সন্ত্রাসবাদী বা গোলমালকারী?

অনেকভাবেই হারবার্ট সরকারকে শনাক্ত করার সুযোগ রয়েছে; এতিম হারবার্টের বেড়ে ওঠা দক্ষিণ কলকাতার এক ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত পরিবারে। হারবার্টের ডাকসাইটে সিনেমাওয়ালা বাবা পিচ্চি হারবার্টের পয়লা জন্মদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ধরাধাম ছাড়লে একলা মা হারবার্টকে নিয়ে যৌথ সংসারে কায়ক্লেশে দিন গুজরান করে। কিন্তু চৈত্রের এক দুপুরে মাও খুব জলদি ওপারের ট্রেনে উঠে পড়ে। এরপর তার সঙ্গী হয় একটা ছোট্ট পেটরা, কাকা-কাকীমার প্রাণান্তকর ফুটফরমাশ, বাড়ির বড়দা ধন্নার জ্বালাতন! বন্ধু বলতে বিনু (তার ছোট কাকার ছেলে, নকশালবাদী)। স্কুলের ঝক্কি থেকেও এক সময় ছাড়িয়ে দোকানে ফুলটাইম কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। এতসব অযাচিত পরিণতির মধ্যেও বাড়ির চিলেকোঠা, কবুতরগুলিকে খাবার ছিটান আর ঘুড়ি ওড়ানোর সুখ হারবার্টকে যাবতীয় কষ্ট থেকে খানিকের মুক্তি দিত। ছেলেবেলা থেকেই হারবার্টের খেয়ালিপনা পাড়ার লোকদের কাছে তাকে ঠাট্টার বস্তুতে পরিণত করেছিল।

হারবার্ট (২০০৫)

হারবার্টের বয়স যখন চল্লিশ, এক দিন এলান করে দিল যে প্রয়াত ব্যক্তির সাথে আলাপ করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার আছে! প্রমাণরূপে, স্বপ্নে পাওয়া পুলিশ এনকাউন্টারে নিহত বিনুর ডায়েরির হদিস দিলে আস্ত পাড়া ক্ষণেকের তরে বিস্মিত হলেও পরমুহূর্তেই নিয়মকার বিদ্রুপে মশগুল হয়। কিন্তু, এই ভবিষ্যদ্বাণী যখন ফলে যায়, রাতারাতি পাড়ায় হারবার্ট সরকার তারকা মর্যাদা অর্জন করে। এবার সে একটি সাইনবোর্ড ঝোলায়—মৃতের সাথে আলাপ করা হয় এবং বিফলে মূল্য ফেরতসহ পারলৌকিক ক্ষমতার চর্চা শুরু করে। এতে টু-পাইস/যশ ভালোই হচ্ছিল। প্রায় বছর তিনেক রমরমা ব্যবসা কাটানোর পর হঠাৎ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট সোসাইটি, কলকাতা—হারবার্টের কনসালটেন্সিকে জোচ্চুরি সাব্যস্ত করে—ব্যবসা বন্ধ না করলে পুলিশে দেয়ার হুমকি দিয়ে যায়। যুক্তিবাদীদের হুমকি তার অহমে মারাত্মক চোট পৌছায়; ফলাফল সে রাতেই আত্মহত্যা। 

দক্ষিণ কলকাতার স্বল্প পরিচিত হারবার্টের কদর নজিরবিহীন মাত্রায় বেড়ে যায় মৃত্যুর পর, যখন তার শবদেহ চুল্লীতে ঢোকানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বিকট বিস্ফোরণে চুল্লীঘর ভস্মীভূত ও তত্রস্থ জনাদশেক মানুষ আহত হয় ।

স্বাভাবিকভাবেই, দ্বিতীয় প্রতুষ্যে সব কাগজে রটে যায় আধ্যাত্মিক/তান্ত্রিক/রহস্যপুরুষ হারবার্ট সরকারের গল্প। ঐদিকে আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ এটিকে জঙ্গি হামলা মনে করে উচ্চক্ষমতা বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি মাঠে নামায়। তবে, কেউই ঠাহর করতে পারে নাই সত্য কারণটি; এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বিনুর হাতবোমাগুলি—সেই সত্তরের দশকে যখন সময় উত্তাল নকশাল আন্দোলন চলছে, তেমনই এক রাতে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিনু হারবার্টের তোষকের ভেতরে বোমাগুলি লুকিয়ে রেখেছিল, এই কথা হারবার্টের কাছে বিনুর মৃত্যুর বিশ বছর পর পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ছিল। হারবার্ট আত্মহত্যা করে তার তোষকে শুলে, তোষকসহ তাকে চুল্লীতে চালান করা হয়।

কিন্তু এটি কি নিছকই বিস্ফোরণ, নাকি কমরেড বিনুদের অতৃপ্ত আত্মার হুশিয়ারি: ‘ফুল ফুটুক আর নাইবা ফুটুক বিপ্লব হবে’। দুঃখবিলাসী-ভোগসর্বস্ব এই অচলায়তন ধ্বসে পড়বে চুল্লীঘরটির মতন। আর, সিনেমার গল্প শুরু হয় এখান থেকেই—পর্দায় ভেসে উঠে তদন্তের নামে লাল ফিতার সর্পিল চলন, ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসে আপন স্বার্থ সম্পর্কে অসচেতন পরোপকারী বাড়ন্ত হারবার্টের মনের গলি-ঘুপচিগুলি যেখানে সে প্রতিনিয়ত একা, বজ্জাত চাচাত ভাই ধন্নার হাতে অপদস্থ কিশোর, তার জীবনের একমাত্র ট্র্যাজি-কমিক ভালোবাসার গল্পের আর অজ্ঞাতসারে উত্তাল সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ার মুহূর্তগুলি।

পাঠক (দর্শক) আবার ভাববেন না যেন এই সিনেমাটি শুধু হারবার্ট সরকারের জীবনালেখ্য মাত্র—এই ছবি মূলত প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের কয়েক দশকের স্মৃতিপরিক্রমার ভেতর দিয়ে প্রাণের শহর কলকাতার চেপে যাওয়া ইতিহাস, শঠতা, প্রলুব্ধতার গল্পটি বলে যায় ।

জটিলভাবে সম্পর্কিত অসদৃশ অংশসমূহ নিয়ে চমৎকার কুশলতার সাথে সুমন যে বয়ানের বিস্তার করেছেন সেখানে হারবার্ট সরকার যেন ‘বিগ গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক’ এর পেন্ডুলাম, যা নির্দিষ্ট সরল ছন্দিত স্পন্দনে অনায়াসে কাল ও আকালের মাঝে ভ্রমে এবং এক মুহূর্তের মৃত্যু থেকে অপর মুহূর্তের জন্ম বা একটি ঘটনার সাথে অন্য আরেকটি ক্রিয়ার সাযূজ্য ঘোষণা করে… 

হারবার্ট সরকারকে কেউ কেউ উন্মাদ বলতে পারেন; যারা ‘উন্মাদ’ বলবার পক্ষে তাদের নিকট একটিই মিনতি আমরা যারা নিজেদের (তথাকথিত) প্রকৃতস্থ দাবি করি, তারা ঠিক কতখানি সংবেদনশীল নিজ-নিজ পরিপার্শ্বের পরিপ্রেক্ষিতে! হারবার্টকে (কি) উন্মাদ সাব্যস্ত করি আমরা তার সংবেদী আকুতির জন্য, নাকি তার (অ)যৌক্তিক কাজকাম আমাদের মুখস্ত বাস্তবতাকে টিটকারি করে বলে? হারবার্ট আমাদের জ্ঞানে কুলোয় না এমন কালিক পরিভ্রমণের বা ফ্যান্টাসি রাইডের আয়োজন করে, তাই বলে ঐ পুরাঘটিত অতীত সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল নই তা কিন্তু নয়! কারণটা হলো, হারবার্টের দিনচর্যা আমাদের অধীত প্রমাণাদি নির্দেশিত ‘রিয়েল ট্রুথ’কে সংশয়ী করে; সিনেমাজুড়ে এই সংশয় উত্তেজনার পারদ হারবার্টের পাগলামোর বিপরীতে ক্রমশই চড়তে থাকে। তবে কি নির্মাতা আমাদের এই চরিত্রের দ্বারা যৌক্তিক-নৈয়ায়িক ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন?

হারবার্ট (২০০৫)

প্রকৃতপক্ষে, সিনেমার প্রায় শেষে যখন ‘পোস্টমডার্ন’ এবং ‘ফুকো বলেছেন’ টাইপ সংলাপ প্রক্ষিপ্ত হয়, তখন হারবার্টের অলৌকিক প্রেরণাসঞ্জাত উন্মত্ত প্রত্যাখান অলৌকিক ক্ষমতার বিদ্যমানতার প্রতি আবার ভেবে দেখার অবকাশ করে দেয়। এক্ষণে, আমরা যদি সত্যজিত রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বীকে(১৯৭০) বাংলা সিনেমায় আত্মমাত্রিকতার (সাজেক্টিভিটি) সংকট অনুসন্ধানের উৎসমুখ রূপে জ্ঞান করি তবে বলতে হয় যে, হারবার্ট সংকটের সেই উৎসমুখকে প্রান্ততক বিস্তৃত করেছে।

নির্মাণশৈলী 

সুমন মুখোপাধ্যায়ের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গির দরুন টানটান বয়ানের এই সিনেমাটির পরিধি জুড়ে নির্মাণ শৈলীর ছাপ ছড়িয়ে আছে। যেমন, অতীত ও বর্তমানের ভেদ হেতু সেপিয়া টোন ও টেকনিকালারের ব্যবহার চাতুর্যতার সাথে (রঙিন) বর্তমান ও (ধূসর) অতীতের ফারাকটা নান্দনিক আকারে উপস্থাপন করে। সুনিপুণ সম্পাদনার গুণে সিনেমাটি অন্য রকম গীতিময়তা লাভ করেছে। বিশেষ করে জাক্সটাপজিশন ও মন্তাজের অমায়িক ব্যবহার দর্শকের চৈতন্যকে বধির করে দিয়ে মহাবৃত্তের হাওয়া বইয়ে দেয় ।

জাক্সটাপজিশনের প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে যায় কিশোর হারবার্ট যখন বাড়ির ছাদে বসে কবুতরগুলিকে দানা ছিটাচ্ছে তখন সন্নিধি দৃশ্যে ডিশ-অ্যান্টেনার রোপণ একই সাথে সাংস্কৃতিক ক্রান্তিকালকে নির্দেশ করে। ডিশ-অ্যান্টেনা রোপিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে ছাদটা আর হারবার্টের থাকে না… ঠিক যেভাবে এই মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে বিনিক্ততা বা একান্ততা বলে কিছু অবশিষ্ট নাই। আর ব্যাটেলশিপ পতেমকিন (১৯২৫) এর ঐতিহাসিক ওদেসা স্টেপ যখন মন্তাজের ভিতর দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের সিড়ি হয়ে যায় তখন বিপ্লবের আঁচটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে সচেতন দর্শকমাত্র।

পুরা ছবিজুড়েই দেখা যায় সময়ের গলন অর্থাৎ এলোমেলোভাবে এক দৃশ্যের ভেতর দিয়ে আরেক দৃশ্যে আগমন-নির্গমন যদিও দিনশেষে তা জিগ-স পাজলের মত ঠিকই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়।

হারবার্ট (২০০৫)

কুশীলবদের অভিনয় এক কথায় দুর্দান্ত। নাম ভূমিকায় সুভাষ মুখার্জি প্রায় সিনেমার পর্দা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছেন বলা যায়, বিনু চরিত্রে পরমব্রত চ্যাটার্জীর অভিনয় নকশাল যশটা প্রতিফলিত করে আর দারোগার ক্যামিও চরিত্রে গায়ক কবীর সুমনের অভিনয় অন্তত আমাকে অ্যাপোকালিপ্স নাউ-এ (১৯৭৯) মার্লোন ব্র্যান্ডোর কর্নেল কুর্টজের ক্যামিও চরিত্রটির কথা মনে করিয়ে দেয়।

হারবার্ট-এর পরতে পরতে ক্লাসিক হলিউড থেকে শুরু করে প্যারালাল ইন্ডিয়ান সিনেমাসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের এন্তার চোথা চোখে পড়ে। চিত্রনাট্যের গড়নটা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার অনুপ্রেরণা পুষ্ট। তথাপি, এটি স্ব আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের কাছে সত্যই থাকে।

সুমন মুখোপাধ্যায় সমন্ধে দু-চার কথা

শৈশবে বাবা অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নাটকের দল ‘চেতনার মহড়া’ ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ড্রামা রিভিউ পড়তে পড়তে সুমনের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটতে থাকে, পাশাপাশি হিন্দি সিনেমা দেখার অভ্যেস তাকে সিনেমার প্রবল অনুরাগী করে তোলে।

সুমন মুখোপাধ্যায়

১৯৮৮-তে বিভাস চক্রবর্তীর সাড়া জাগানো মঞ্চনাটক ‘মাধব মালঞ্চী কন্যা’তে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে তার দৃশ্যরূপ জগতে পথচলা শুরু হয়। ১৯৯১ সনে নিউইয়র্কের এশিয়ান কালচারাল কাউন্সিলে থিয়েটার এর উপর কোর্স করেন এবং কলকাতায় ফেরার পর ক্লাউস মানের ‘মেফিস্টো’ ও গিরিশ কারনাডের ‘নাগমুল’-এর মতো একাধিক সফল দর্শক-সমালোচক নন্দিত নাটক মঞ্চস্থ করেন। পরবর্তীকালে ‘তৃতীয় সূত্র’ নামে নিজ নাট্যদল করেন।

এতকিছুর মধ্যেও সিনেমার অনুরাগ একটুও কমেনি, তাই কারিগরী বিদ্যালাভের উদ্দেশ্যে ২০০১ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন। যদিও ততদিনে মঞ্চের পাশাপাশি পকেটস্থ হয়েছে বেশকিছু প্রামাণ্যচিত্র, টিভি বিজ্ঞাপন এবং নাসিরুদ্দিন শাহ ও পঙ্কজ কাপুর অভিনীত একটি টিভি ধারাবাহিক নির্মাণের অভিজ্ঞতা।

ফিল্ম স্কুলের পাঠ চুকিয়ে তিনি প্রথম বানালেন হারবার্ট। থিয়েটার বা সিনেমা সব ক্ষেত্রেই সুমনের কাজে কিছু বিষয়ের পৌনঃপুনিক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সুমনের ভাষ্যে:

“রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সজ্ঞানতা আমার বেড়ে উঠার দিনগুলিতে অভাবনীয় প্রভাব রেখেছে যা এখন আমার কাজের আবিশ্যিক অনুষঙ্গ।”

তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-এর বাঘারু বা হারবার্ট-এর হারবার্ট সরকার বা চতুরঙ্গ -এর দামিনী; সব ক্ষেত্রেই সুমনের লক্ষ্য প্রান্তিক সমাজের চরিত্ররা। প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সংহিতায় অপাঙক্তেয় মানুষদের চোখে ধরাকে সরা জ্ঞান করার চর্চা সুমনের কাজের অন্যতম ট্রেডমার্ক । সুমনের মতে, প্রান্তিক মানুষদের চোখ দিয়ে দেখামাত্রই প্রচলিত বাস্তবতার একটি ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়।

আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও ফাতিহ আকিনের সিনেমার ভক্ত সুমনের আগ্রহ অনাড়ম্বর ও আকর্ষণীয় এমন সিনেমার প্রতি যা কারিগরি মানে চকচকে নাও হতে পারে কিন্তু মানবিক; যেটি এক অর্থে তার সিনেমার অন্যতম মাত্রা। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত হারবার্ট চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া শৈল্পিকভাবে নির্মিত চলমান ছবিমালার স্থাপত্যকীর্তি যা কলকাতার জায়মান বাস্তবতার ভেতর দিয়ে আমাদের গভীর হাস্যরস-করুণা-মানবিকতার হদিস দিয়ে যায়।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ (২০১২) থেকে সংকলিত)

Leave a comment