ধরুন আপনার মন ভীষণ খারাপ। জীবনে আর কোনো কিছুই চাওয়ার পাওয়ার অবস্থায় তো নেইই, একটা সেকেন্ডও আর বেঁচে থাকাও কুলোচ্ছে না যেন। এমতাবস্থায়, ‘এ জীবন আর রাখব না’ ভেবে ছাদে উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে পা পিছলে পড়লেন তো পড়লেন; ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে তাকিয়ে দেখলেন একজন (পাঠক/পাঠিকা নিজ দায়িত্বে জেন্ডার নির্বাচন করে নিন) অবাক নয়নে আপনার দিকে তাকিয়ে, আপনি তো ফার্স্ট সাইটেই পুরা ‘ক্রাশ’ খেয়ে কাত! সুতরাং, আপনি কী ভাবছেন, আর কী ঘটতে চলেছে, আর তার ফলাফল কী হবে, তা আপনি কোনো সময়েই নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না, একেবারেই ‘ইউ নো নাথিং, জন স্নো’-টাইপ একটা ব্যাপার! যে কোনো সম্ভাবনাকেই শেষতক খারিজ করতে না পারার যে নিশ্চিত অনিশ্চয়তায় আমরা প্রতিনিয়ত বাঁচি, জীবনের দুর্ধর্ষ মাহাত্ম্য হয়তো সেখানেই!
দক্ষিণ ভারতীয় ছবির গল্প বলার ঢং নিয়ে নতুন করে আলাপ করার কিছু নেই। গল্প বলায় কিংবা সে গল্পকে রংমহলের পর্দায় ক্যারিশম্যাটিক রং-রূপ-প্রকৃতির আদলে ফুটিয়ে তোলার কায়দায় বলিউডের চেয়ে গন্ডা গন্ডা ব্যাচ সিনিয়র হয়ে গেছে তামাম দক্ষিণ ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রি। সুপার ডিলাক্স (২০১৯) নির্মাতা থিগারাজন কুমারারাজা দক্ষিণ ভারতের মণিমুক্তোর ডালায় এমনই এক দামী জহরত বটে! সুপার ডিলাক্স তাঁর ঝুলি থেকে বেরোনো দ্বিতীয় চমক, তাঁর পয়লা এন্ট্রি ছিল ২০১০ সালের ‘অরণ্য কানদাম’ ছবিটি, যা তাবড় তাবড় সমালোচকদের প্রশংসা পেতে মোটেও বেগ পায়নি। প্রায় এক দশক পর সুপার ডিলাক্স দিয়ে প্রত্যাবর্তনে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন; ট্রেনিং তো জমা দেনইনি, বরং অস্ত্র আরও শানদার করে তুলেছেন এই লম্বা বিরতিতে। এ সিনেমার স্ক্রিপ্টেও তাঁর হাত রয়েছে।
‘ফিল্ম উইদিন আ ফিল্ম’—ব্যাকরণের আমদানি বিবিধ কনশাসনেসের প্রয়োজনীয়তায় গুরুস্থানীয় নির্মাতারা করে গেছেন, এই সিনেমায় একটি সিকোয়েন্সে ডিভিডি স্টোরের দোকানে সাঁটানো গ্যাংস অব ওয়াসিপুর বা পাল্প ফিকশন এর পোস্টার এই ব্যাকরণের অতি ক্ষুদ্র একটি সিগনেচার হলেও কুমারারাজা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সিনেমা নিয়ে তাঁর পড়ালেখা ঠিকঠাক আছে। এই ডিভিডির দোকানে কয়েকটি ইতস্তত বালকের নীলছবির সিডি খরিদ করতে গিয়ে যে তুলকালাম পুরোটা ছবিতে তিনি টেনে টেনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাতে আপনার হাসি পেতে পারে, কুশীলবদের অপূর্ব সহজাত অভিনয়ে মুগ্ধ হতে পারেন বারংবার, তবে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে পারেন না কখনোই। এ প্রসঙ্গে, এই যে সম্ভাবনা আর কী, খুবই প্রাসঙ্গিক হতে পারে নিকোলাস হেনরি পোর্টার ওরফে ও. হেনরির লেখা ‘দ্য গ্রিন ডোর’ শিরোনামের একটি ছোটগল্প। পড়া না থাকলে ও. হেনরির কোনো সংকলন বা গুগলের সহায়তা নিতে পারেন চাইলে, হ্যাপি রিডিং!

সিনেমা, অর্থাৎ সুপার ডিলাক্স-এর কথায় ফিরে আসা যাক। আপাতদৃষ্টিতে এই সিনেমার কোনো চরিত্র বা কাহিনীকেই মুখ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করার কায়দা নেই, কারণ প্রতিটি চরিত্র এবং কাহিনী একটি আরেকটির সাথে বকুল ফুলের মালার মতো জড়িয়ে রয়েছে। ছবির গল্প বলে স্পয়লারের ময়লা তাই না জমানোই শ্রেয়তর। যে বকুল ফুলের মালার কথা বলছিলাম, সেই মালা নিখুঁতভাবে গাঁথায় পরিচালক, কাহিনীকার, কুশীলব থেকে সবাইকেই টুপি খুলে স্যালুট ঠোকা ছাড়া উপায় নেই।
কুমারারাজার স্টাইলিশ-ইন্ডি-সিনেফিল-সেনসিবিলিটি’র তারিফ করতে করতে এক কদম এগিয়ে অভিবাদন জানাতেই হয় ‘রাসু কুট্টি’ চরিত্রে রুপদানকারী চেন্নাইয়ের ৮ বছুরে খুদে ছোকরা, অবিশ্বাস্য এক জাত অভিনেতা অশান্থ অশোককুমারকে। ঘন্টা তিনেকের এই ছবিতে এই শিশুর অ্যাপেয়ারেন্স, অ্যাক্টিভিটি থেকে প্রতিটি সংলাপ ছুড়ে দেওয়া এতোটা মনোমুগ্ধকর; তা না দেখলে আসলেই খুব ‘মিস’ করবেন! ‘মানিক্যম’ থেকে ‘শিল্পা’ বনে যাওয়া বিজয় সেতুপতির মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্সও এই অশান্থের কাছে হার মেনেছে সম্মান দিয়ে। ছবির একটি পর্যায়ে যখন ‘বাবা কি কখনো মা হতে পারে না?’ বলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রাসু কুট্টি, সেটি কেবল সিনেমার সেই সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যতার রেটোরিকই নয়, আমাদেরকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করতে সক্ষম হয়।
সার্থক একটি সিনেমার সাফল্য এখানেই
নন-লিনিয়ার স্টোরি টেলিং এখন ভারতীয় মুলুকে হরদম হচ্ছে, এক রাত বা একটি নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমের মধ্যে অনেকগুলো চরিত্র বা ঘটনার একটির আরেকটির সাথে জড়িয়ে যাওয়ার মতো সার্থক কাঁড়ি কাঁড়ি কাহিনী দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে তো বটেই, এমন কী গল্পের আকালওয়ালা বলিউড মুলুকও ইস রাত কী সুবাহ নাহি (১৯৯৬), এক চল্লিশ কি লাস্ট লোকাল (২০০৭) কিংবা পর্দায় মুক্তি না পাওয়া উর্ফ প্রোফেসর (২০০১) সিনেমায় দেখিয়েছে। এই ঘরানার সিনেমাতে মূলত সিনেম্যাটিক প্লেজার নির্ভর করে কাহিনীর গাঁথুনি আর হেডফোনের প্যাঁচ খাওয়া তারের মতো পরিস্থিতি নিখুঁতভাবে ছুটিয়ে ও মিলিয়ে ফেলার মুন্সিয়ানার ওপর।
কাহিনীর কায়দায় সুপার ডিলাক্স খুব উচ্চ আসনে থাকবেই, তা বলা যায় না। তবে সুপার ডিলাক্স দর্শককে ভিন্ন এক স্কুল অব থটের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, বারেবারে বিভিন্ন প্রশ্ন আর পরিস্থিতির মেটাফোরে। জীবন আপনাকে কখন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি করছে আর তাকে আপনি কীভাবে দেখছেন এবং গ্রহণ করছেন; সে বিষয়েই সুপার ডিলাক্স এর কুশীলবগণ আপনাকে ভাবাতে সক্ষম হবে। এমন কী শুরু থেকেই একটু আজগুবি বা স্যাটায়ার-ভর কিংবা পরিস্থিতির শিকার ভেইম্বু-মুগিল (সামান্থা-ফাহাদ ফাসিল) দম্পতিও একটা পর্যায়ে আপনাকে নিজের সাথে সাথে অন্যকে আবিষ্কার করার ও গ্রহণ করে নেওয়ার পথ দেখাবে।
আর হ্যাঁ, খুদে রাসু কুট্টি আপনাকে ভালোবাসা কী এবং কী করে ভালোবাসতে হয় তা শেখাবে। ১০০% গ্যারান্টি। পরখ করতে সুপার ডিলাক্স দেখে ফেলুন ‘নেটফ্লিক্স’-এ, আর নইলে গরীবের গৌরব টরেন্ট তো আছেই!