ইশতিয়াক আহমেদ
গণেশ চতুর্থীর দিন। ঘরের জানালা পেরিয়ে এসে নাসিরের শরীরে আলো হুটোপুঁটি খায়। মৃদুমন্দ হাওয়ায় পর্দা কাঁপছে। খুবই সাধারণ একটা দিনের প্রত্যাশা নিয়ে নাসিরের ঘুম ভাঙে। সারাদিন তার অনেক কাজ, সবই মামুলি। কারণ সাধারণ মানুষের অসাধারণ রুটিন হয় না, রুটির জোগাড় করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য; আদিম মানুষের স্ক্যাভ্যাঞ্জার হান্টের মতো। পিঁপড়ার মতো হাজার হাজার মানুষ একই তাড়নায় নাসিরের মতো সাতসকালে বেরিয়ে পড়ে শহর জুড়ে। তখন একই তাড়নায় ধর্মনেতারা তাদের উপদেশ শুনিয়ে যায়, পরজীবন বা পরজন্মের হিসাব কষে দেয়।
এইতো অরুণ কার্তিকের নয়া সিনেমানাসির (২০২০) এর মুখবন্ধ সিকোয়েন্স। সিনেমাটার জন্য ২০১৮ সালে হিউবার্ট ব্যালস ফান্ড পান পরিচালক। আর নির্মাণের পর রটারডাম ফিল্ম ফেস্টিভাল, আন্দ্রেই তারকোভস্কি জেরকালো ফেস্টিভাল, এশিয়ান আর্টহাউজ ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে একঝুলি পুরস্কারও বাগিয়েছেন। তবে স্বীকৃতি এবং অর্জনের বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে নির্মাতার সৎসাহসের তারিফ করাটাই আমার কাছে বাঞ্চনীয়। কারণ সময়টা অ্যানা ফ্রাংক কি জর্জ ফ্লয়েড, নাসির কি সুবোধ, কারোরই পক্ষে না। সারাবিশ্ব যখন জাতিগত বিদ্বেষের তাড়ি খেয়ে মাতাল হয়ে বর্বর জঙ্গিপনায় উম্মত্ত, অরুণ কার্তিক তখনই নিয়ে আসলেন নাসির‘। সুনামগঞ্জের শাল্লা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, অভিজিৎ রায়, দীপন, ট্রাম্পের আমেরিকায় ক্যু ক্লাক্স ক্ল্যানের পুনরুত্থান, নানকশাহী গুরুদুয়ারা, ক্রাইস্টচার্চ, উইঘুর, রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল, শার্লি এব্দো—এইসব ঘটনা তিনি একটা মাত্র লংশট দিয়ে স্ট্যাটিক ফ্রেমে একটা চরিত্রের নিথর দেহের ছবিতে আটকে ফেলেছেন!
সাধারণ এক সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে নিয়ে সিনেমার গল্পটাও খুব সাধারণ। তার যাপিত জীবনের একঘেয়ে একটি দিনের চিত্র, যার যবনিকা টানে যমের সাক্ষাৎ পেয়ে। মৃত্যু শব্দের একটা নেতিবাচক রূপ আছে—‘অপমৃত্যু’। যখন মৃত্যুসংঘটনের প্রক্রিয়া বিবেকবান মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, সেটাকে আমরা স্বাভাবিক মৃত্যু বলি না। সেই মৃত্যুর পিছনে অনেক ‘কেন?’ উত্থাপিত হয়। এসব ‘কেন?’ এর উত্তর নির্মাতা দেননি। তিনি শুধু ক্ষুদ্রাতি মানুষের আগামীর স্বপ্ন দেখাকে পরিহাস করেছেন পুরো সিনেমা জুড়ে। প্রথমবারনাসির দেখবার সময় এসব পরিহাস চোখের আড়াল থেকে যায়। মনে হয় সংলাপগুলোকে আটপৌরে জীবনের ক্লিশে কথাবার্তা। তবে দ্বিতীয়বার দেখার সময় সংলাপ নিয়ে নির্মাতার খেলা স্পষ্ট হয়। গণেশ চতুর্থীর পরদিন, পরের সপ্তাহে, পরের মাসে সদ্যনিহত নাসিরের পরিকল্পনাগুলো, তার আশপাশের মানুষজন নিয়ে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবার স্পৃহা—সবই এক উপভোগ্য বিষণ্ণতায় রূপ নেয়। কারণ তার নগণ্য অস্তিত্ব এ ধরণীর কিছু মানুষের সর্বস্ব। সে তার স্ত্রীর প্রেমিক কবি, মায়ের আশ্রয়, ভ্রাতুষ্পুত্রের টিকে থাকবার সম্বল। তার অস্তিত্ব বিলোপের সাথে সাথে এই মানুষগুলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়ে যায়। এবং এই মানুষগুলোর একমাত্র অপরাধ ভুল দেশে, ভুল পরিবারে, ভুল ধর্মে, ভুল সময়ে জন্ম নেয়া। নাসির যদি পাকিস্তানে জন্ম নিত, হয়তো গেল বছর তাকেও দেখা যেত নানক গুরুদুয়ারার দিকে রামদা হাতে ধেয়ে যেতে। কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’ উপন্যাসে এমনই এক বিবরণী পাওয়া যায়। করাচি থেকে মৃত্যুর খড়গ মাথায় নিয়ে পালাতে পালাতে গল্পের নায়ক যখন ইরাবতী নদীর ওপারে পৌঁছায়, তখন সেও হয়ে ওঠে হানাদার। নদীর ওপারে যে শিকারের মতো তাড়া খেয়ে এলো, এপারে সেই শিকারি।
নাসির যদি পাকিস্তানে জন্ম নিত, হয়তো গেল বছর তাকেও দেখা যেত নানক গুরুদুয়ারার দিকে রামদা হাতে ধেয়ে যেতে।
প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্য—ধর্মান্ধতা, বর্ণবাদ, জাতিগত বিদ্বেষের ধারক-বাহক উম্মাদদের প্রতিহিংসার বলি মানুষগুলোর প্রতিচ্ছবি দেখা যায় নাসিরের মধ্যে। তাই নাসির বিশ্বজনীন সিনেমা; এবং কালোত্তীর্ণও। কেননা সেই সুদূর অতীত থেকে মানুষ তার গোষ্ঠীগত পরিচয়ের কারণে হত্যা, নির্যাতন, বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। বর্তমান দুনিয়াজুড়ে চরম ডানপন্থার পুনর্জাগরণ—নিকট ভবিষ্যতেও সুদিনের প্রতিশ্রুতি ম্লান করে দেয়। এই সহিংসতার অন্যতম প্ররোচক শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং সম্পত্তিচিন্তা। সকল সম্প্রদায় নিজেদের অন্যের থেকে উত্তমতর বলে বিশ্বাস করে, এবং সংখ্যাগুরুরা দেশকে নিজেদের সম্পত্তি জ্ঞান করে। এরই প্রতিফলন দেখা যায় নাসির যখন স্ত্রীকে বাসে তুলে দেওয়ার জন্য সকালে ঘর থেকে বের হয়। তার মুসলিম অধ্যুষিৎ এলাকায় হুজুরের ওয়াজ চলছে, আর এলাকা থেকে বেরোলেই ধর্মসভার প্রবচন। উভয়ের বক্তব্যের বিষয় বৈষয়িক, তাদের সম্প্রদায়ের সোনালি অতীত। নির্মাতা এখানে কৌশলে নাসিরের বাসস্থান এবং কর্মক্ষেত্রের মানচিত্রও এঁকে ফেলেছেন। অরুণ অনেক দৃশ্যেই এরকম পারিপার্শ্বিক শব্দ দিয়ে গল্প টেনে নেওয়ার অসাধারণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
আইরনি ব্যতিরেকেও পুরো সিনেমা অসংখ্য ছোট ছোট হিউমার দিয়ে বুনে গেছেন নির্মাতা। যেমন কলেজের গেটে দারোয়ান তাকে বিড়ি টানবার জন্য ভর্ৎসনা করে, পরে দু’জনে মিলে কলেজের চাতালে একই বিড়ি ভাগ করে টানে। সাবলীল অভিনয়, মিহি নীল-হলদে রঙের ব্যবহার আর অপূর্ব সব কম্পোজিশন এই আপাত-একঘেয়ে দিনের গল্প প্রাণবন্ত করে রাখে। তাই যতই সাধারণ জীবনের চিত্রায়ন হোক না কেন, নির্মাতা দর্শককে প্রথম শটেই বড়শিতে গেঁথে ফেলে। পরবর্তীতে এই নৈপুণ্যের দরুন দর্শক নাসিরের দিনলিপি পড়ে যায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে।
সিনেমায় আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার নেই। আবহ সঙ্গীতের শূন্যতা পূরণে পারিপার্শ্বিক শব্দের উপরই নির্মাতার নজর বেশি ছিল। বলতেই হবে, ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে উতরেও গিয়েছে। ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে বাজানো গানের ব্যবহারও চমৎকারভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন গল্পের সাথে। চিত্রনাট্যের বিচার-বিশ্লেষণ করে পুরো একটা বই লিখে ফেলা সম্ভব। তাই ওদিকটা ফাঁকি দিয়ে দুই-তিনটে দৃশ্যের উপর আলোকপাত করা শ্রেয়।
এরকম একটা দৃশ্য নাসিরের সহকর্মীর ফোনালাপ। ফোনে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পূজার মিছিল বাধা পাওয়ার খবর শুনে নাসিরের সহকর্মী উগ্রবাদী মন্তব্য করে। নাসির আড়চোখে তার ফোনালাপ শুনতে থাকে। কয়েক দৃশ্য পরে সেই ব্যক্তি আবার নাসিরকে কবিতা শোনাতে বলে এবং তার কবিতার প্রাণোচ্ছ্বল তারিফ করে। ব্যক্তি নাসিরের প্রতি তার সাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করে না। ব্যক্তি নাসিরের প্রতি তার খেদ নেই, বরং শ্রদ্ধাভাব দেখা যায়। এমনই এক দৃশ্যের অবতারণা ‘গাদ্দার’ উপন্যাসে দেখা যায়। পলায়নরত মুসলমানদের সারির প্রতি সাম্প্রদায়িক গালাগাল করে যাওয়া মুচি হঠাৎ সেখানে তার সহকর্মী বন্ধুকে দেখতে পায়। তারা দুজন আলিঙ্গন করে এবং দুজনই ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা-আক্রোশ ভুলে স্মৃতিচারণে বুঁদ হয়ে যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে সাম্প্রদায়িক দর্শনের সংঘাত ঘটে। কেননা সাম্প্রদায়িকতা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ধারণা, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা লুটবার অস্ত্র। ব্যক্তিসম্পর্ক রাজনীতি দিয়ে চালিত হয় না। একারণেই নাসিরের সহকর্মীর আচরণ এবং চিন্তাভাবনায় দুইক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক দেখা যায়।
অরুণ শেষ দৃশ্যেরও অসাধারণ ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন। পুরো সিনেমা একটা মেলোডিসদৃশ দৃশ্যাবলীর কোলাজ। কিন্তু শেষদৃশ্য গণপিটুনি বা সংঘবদ্ধ হত্যার। এ যেন রাগের শেষে রক ড্রাম সলো। তাই সহিংসতার মাত্রা কমানোর জন্য পরিচালক সরাসরি আঘাত দেখাননি। শুধু মোশন ব্লারের আর জার্কের ভিতর কতগুলো মানুষের হল্লা আর দানবিক কার্যকলাপ দেখা যায়। এরপর মিনিট দুয়েক ধরে দেখা যায় গলির মাথায় সোডিয়াম বাতির নিচে নাসিরের মৃতদেহ পড়ে আছে। এত লম্বা সময় এই ফ্রেম দেখতে দেখতে দর্শক তার চিন্তার জগতে চলে যাওয়ার সুযোগ পায়। পুরো সিনেমার পুঞ্জিভূত আবেগ এই সময় তাড়িত হয়। মানুষ মানুষের নির্মমতার স্বরূপ দেখতে পায়, আশরাফুল মাখলুকাত শব্দযুগলের হিপোক্রেট গোমর ফাঁস হয়ে যায়। যান্ত্রিক সভ্যতার শিখরে ধাবমান প্রাণী, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক বন্যতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে।
1 Comment
https://bandur-Art.blogspot.com/2024/08/the-ultimate-guide-to-no-mans-sky-mods.html
It’s nearly impossible to find well-informed people in this particular subject,
but you seerm like you know what you’re taking about!
Thanks https://bandur-Art.blogspot.com/2024/08/the-ultimate-guide-to-no-mans-sky-mods.html