Skip to content Skip to footer

বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম: বাস্তবতার আলোকে নিরীক্ষা

স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে ‘বিরল’ অভিজ্ঞতার তকমা পেতে যাচ্ছে। পাবেই বা না কেন, সিনেমা এখন আরও সহজলভ্য। হলের সংখ্যা কমে যাওয়া, পাইরেসির মতো নেতিবাচক বিষয় ছাড়াও হলে গিয়ে সিনেমা না দেখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ ভাগে চলচ্চিত্রের আগমন। তখন প্রজেক্টর ছাড়া চলচ্চিত্র দেখা যেত না। কিন্তু এখন চলচ্চিত্র দর্শন-প্রদর্শনের স্থান-কাল-পাত্র অনেকটাই বদলে গেছে। প্রজেক্টর, টেলিভিশন, কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট ঘুরে সিনেমা এখন মানুষের মুঠোফোনে!

ওটিটি শব্দের পূর্ণরূপ ‘ওভার দ্য টপ’। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে সিনেমা দেখা সম্ভব হচ্ছে কম্পিউটার, স্মার্ট টিভি এমনকি স্মার্টফোনেও। মজার বিষয় হলো, পরিসংখ্যান বলছে প্রযুক্তির এই জোয়ারে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর চাহিদাও কমেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৮ থেকে একটানা ২০১৬ সাল পর্যন্ত টিভি দেখার লোক বাড়লেও, ২০১৭ সাল থেকেই টেলিভিশনের গ্রাহক কমতে শুরু করেছে। ঠিক একই বিষয় ঘটেছিল টেলিভিশন আবিষ্কারের সময়। টেলিভিশন যখন মানুষের বিনোদনের জায়গা দখল করছিল, সিনেমা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। গ্রাহকের বিনোদনের জায়গায় তৈরি হওয়া শূণ্যস্থান দখল করে নিয়েছে নতুন ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। অর্থাৎ নতুন কোনো কিছু এলেই জনসাধারণের মাঝে তা গ্রহণ করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। গবেষকরা বলছেন, প্রচুর বিজ্ঞাপন, পর্যাপ্ত ভালো কনটেন্টের অভাব ও দর্শকের হাতে নিয়ন্ত্রণ না থাকা টেলিভিশন বিমুখতার মূল কারণ।

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, এইচবিও-এর জনপ্রিয়তা প্রায় এক দশক পুরোনো। দেশ-বিদেশের নানাবিধ কনটেন্ট, টিভি সিরিজ, সিনেমা এমনকি ডকুমেন্টারিও দেখা যাচ্ছে খুব সহজে। শুরুতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশের প্ল্যাটফর্মগুলোতে দর্শকের আনাগোনা কম থাকলেও এ সংখ্যা দ্রুতই বাড়ছে। কনটেন্টের প্রাচুর্যের তুলনায় ভালো কনটেন্টের আধিক্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তুমুল জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে ‘ভালো’ কনটেন্টের মানদণ্ড হিসেবে ধরছি দর্শকের কাছে সহজ গ্রহণযোগ্যতাকেই। শিহাব শাহিন পরিচালিত বিঞ্জ-এর ‘১৪ আগস্ট’ ওয়েব সিরিজটি মুক্তির পরপরই পক্ষে-বিপক্ষের নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে সাধারণ দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে ‘বঙ্গ’ প্রথমবারের মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তাদের যাত্রা শুরু করে। একে একে টেলিকমিউনিকেশন্স সেক্টরের বদৌলতে যোগ দিয়েছে বায়োস্কোপ, বাংলাফিক্স, টফিসহ আরো বেশ কিছু প্ল্যাটফর্ম। প্রথমদিকে কেবল দেশি ও বিদেশি পূর্বনির্মিত চলচ্চিত্র, সিরিজ ও অন্যান্য ভিডিও কনটেন্টের দিকে মনোযোগ থাকলেও বর্তমানে শুরু হয়েছে অরিজিনাল কনটেন্টের চল। পাশের দেশ ভারতভিত্তিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্যেও আলাদাভাবে যাত্রা শুরু করেছে। একইসাথে আছে চরকি, লাগ-ভেল্কি, সিনেমাটিক অরিজিনালস-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো। স্বাভাবিক ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, দেশের এতগুলো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থাকার কারণে গ্রাহক ধরে রাখতে সবকটি প্ল্যাটফর্মকেই ভালো অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ, দর্শকপ্রিয় কনটেন্ট ছাড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো টিকে থাকতে পারবে না। 

অরিজিনাল কনটেন্ট হিসেবে এই প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেই প্রযোজনা করছে নতুন নতুন ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ফিল্ম। ফলস্বরূপ, ইন্ডাস্ট্রির নির্মাতারা আরও বেশি ছবি নির্মাণের সুযোগ পাচ্ছেন। সুযোগ পাচ্ছেন ইন্ডাস্ট্রির তরুণ মেধাবী পরিচালকেরা। এতে করে তরুণ নির্মাতাদের মেধার স্বাক্ষর রাখা একটু হলেও সহজ হয়েছে। মোহাম্মাদ তৌকির আহমেদের সিরিজ ‘শাটিকাপ’, রবিউল ইসলাম রবির ‘ঊনলৌকিক’, বরকত হোসেন পলাশের ‘মহানগর’, সালেহ সোবহান অনিম ও সৈয়দ আহমেদ শাওকীর ‘তাকদীর’ তারুণ্যের ঝান্ডাবাহী সৃজনশীল নির্মাণ।

ঊনলৌকিক সিরিজের পোস্টার।

সিনেমা হলগুলো থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের টাকা উঠে আসছে না, এমন অভিযোগ নির্মাতারা অনেকদিন থেকেই করে আসছেন। তাই, ইদানীং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতেই অনেক নির্মাতা তার চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। কারণটা খুব সহজ, সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো থেকেই বেশি লাভবান হচ্ছেন নির্মাতারা। এ ধরনের ফিল্মগুলোও পেয়েছে নতুন চটকদার নাম ‘ওয়েবফিল্ম’। আবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, কিছু চলচ্চিত্র প্রথমে সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়ার পর, সেটি যখন হল থেকে নেমে যাচ্ছে, তখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি কান চলচ্চিত্র উৎসব মাতিয়ে আসা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের রেহানা মরিয়ম নূরও (২০২১) দেখা যাচ্ছে অনলাইনে। একই নির্মাতার লাইভ ফ্রম ঢাকা (২০১৬), মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর টেলিভিশন (২০১৩), সোহেল মোহাম্মদ রানার এনিমেশন ফিল্ম মুজিব আমার পিতা (২০২১), দীপংকর দীপনের ঢাকা অ্যাটাক (২০১৭), সালাউদ্দিন লাভলুর মোল্লা বাড়ির বউ (২০০৫) পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। মোটকথা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থানের কারণে চলচ্চিত্র দর্শন, বিপণন ও সার্বিক উন্নয়নের বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দেশের সাধারণ মানুষকে মূলধারার বাইরে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রকমের শৈল্পিক, বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্র দেখানো। ষাটের দশকে ভিসিআরের যুগে এ অঞ্চলে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের শুরুর সময়টায় এসব সিনেমা খুবই দুর্লভ ছিল। হাতেগোনা কিছু বিদেশি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তা ছাড়া সেসব দেশের সিনেমা এখানে প্রদর্শন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই, তখনকার চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অংশটুকুর অনেকটাই আবর্তিত হতো বিদেশি এসব সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঘিরে। কালের পরিক্রমায় এখন বিদেশি চলচ্চিত্র দেখা আর কঠিন থাকলো না। চলচ্চিত্র সংসদের কাজও কেবল বিদেশি চলচ্চিত্র জোগাড় করে দেখানোর পর্যায়ে থাকলো না। চলচ্চিত্র চর্চা, বোঝা ও চলচ্চিত্র দেখার চোখ তৈরি করতেই এই সংসদগুলো এখন ব্যস্ত। চলচ্চিত্র সংসদ কেন্দ্রিক এই আলোচনা নিয়ে চাইলেই আরও অনেক দূর যাওয়া সম্ভব কিন্তু সে নিয়ে যুক্তি-তর্কের অথবা বিতর্কেরও অবকাশ থাকে। তাই, এখানেই থাকুক। বরং ওটিটি আসার ফলে বর্তমানে চলচ্চিত্র সংসদের আর সিনেমা সংগ্রহে বেগ পেতে হচ্ছে না। হ্যাঁ, চলচ্চিত্র সংসদগুলো যেমন করে বিদেশি ধ্রুপদী নির্মাতাদের কাজ নিরীক্ষার চোখে দেখার চেষ্টা করে, ঠিক তেমন করে সাজানো হয়নি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। তাই, চলচ্চিত্র সংসদের এখনো ভিন্ন মাধ্যমেই অধিকাংশ সিনেমা জোগাড় করতে হচ্ছে। তবে যেভাবে জোয়ার এসেছে, তাতে এসব প্ল্যাটফর্মে সব ঘরানার চলচ্চিত্রের সম্মিলন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সবকিছুর পরও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ছোট পর্দা আর সিনেমা হলের বড় পর্দার এক্সপেরিয়েন্সে ভিন্নতা রয়েই যাবে। সিনেমা হলে অনেক মানুষের সাথে বসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাটা ওটিটির ছোট স্ক্রিনে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া, ‘ওয়েবফিল্ম’ গুলোকে সিনেমা বলা যাবে কিনা তা নিয়েও বোদ্ধাদের মাঝে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। পরিবর্তন আসছে চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতিতেও। ৩৫ এমএম প্রজেক্টরের বড় পর্দা মাথায় রেখে ডিটেইল ও ক্যামেরার দিকে যে খেয়াল রাখতে হয়, মোবাইল, টিভি বা কম্পিউটারের ছোট পর্দার জন্য তা করতে হয় না। তাই চলচ্চিত্রের মানেও আসছে বড় পরিবর্তন।

সব মিলিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এ যুগের চলচ্চিত্র জগতের অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দেখতে হবে, কেমন করে এর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে, ইতিবাচক অংশটুকু আঁকড়ে রাখা যায়।

লেখক: কে এম ইতমাম ইসলাম

লেখাটি ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২৮’ স্মারকসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

Leave a comment