Skip to content Skip to footer

ফেস্টিভাল তো তোমাকে খাওয়া-পরা দেবে না!—হুমায়রা বিলকিস

সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও ভূমিকা: ইমরান ফিরদাউস।

আল্লাহ সীমানা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না। হুমায়রা বিলকিস ও তার ফিল্মসকল সীমানাভেদী সব আঙ্গিক ও বয়ান নিয়ে নীরবে হাজির হয় আমাদের দেখা-না-দেখার যাপনে। হুমায়রা মূলত ফিল্ম করেন আর আলাপের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ডকুমেন্টারি নামক নন-ফিকশনাল মোশন পিকচারকে। ফিল্মিক আঙ্গিক ও বিষয়ীগত বিন্দু থেকে হুমায়রার কাজ বিচার করলে সেখানে দেখতে পাওয়া যায় সীমানা অতিক্রম করার একটা নিয়ন্ত্রিত অবসেশন এর ছায়া। এতদসত্ত্বেও অধিবিচারে এই প্রতীতি হয় যে, সীমানা অতিক্রম করাটা হুমায়রার ‘লক্ষ্য’ নয় বরং ‘মাধ্যম’ বার্তা সংজ্ঞাপনের। হুমায়রা ও তার ফিল্ম যেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ট্রান্সগ্রেসন তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে ফুকো বলছেন, সীমানা অতিক্রমের এই বাসনা সর্পিলাকারে খেলা করে চরম সীমার ছায়া ও অশরীরী আত্মা বরাবর (ফুকো, ১৯৭৭: ৩৪)। সে মতে, হুমায়রার ফিল্মসকল হুমকি হয়ে ফুটে উঠে তাদের কাছে যারা জীবনের কাছে কনফর্মিটি খোঁজেন। মুচকি হাসি হয়ে ভেসে উঠে তাদের চোখের কোণে যারা বিশ্বাস করেন ননকনফর্মিটি বিনা যে কোন পরিপূর্ণ সমাজের ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী।

আর্লি ক্যারিয়ারে পা ফেলা, ঢাকা নিবাসী হুমায়রা বিলকিস এর আজতক প্রকাশিত ফিল্মের সংখ্যা তিনটি। ইন্ডিপেনডেন্ট স্পিরিটে করা, অবজারভেশনাল এবং পারসোনাল রিফ্লেক্সিভ ধারার মিশেলে গড়া ফিল্মগুলো প্রদর্শিত হয়েছে দেশে বিদেশের একাধিক ফিল্ম পার্বণে। পেয়েছেন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অনুদান। পয়লা ফিল্ম আই অ্যাাম ইয়েট টু সি দিল্লি (২০১৪) ইয়ামাগাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে থেকে পেয়েছে ‘স্পেশাল মেনশন বাই জুরি অ্যাওয়ার্ড।’


পাঠিকা ও পাঠক চলুন এই সাক্ষাৎকারের উপর ভর করে আপন আপন আন্দাজ ঝালাই করে নেই এবং বুঝে নেই এই সময়ে, এই জয় বাংলার দেশে একজন হুমায়রা বিলকিস কোন উপায়ে মুক্ত ফিল্মমেকার হিসেবে বেঁচে থাকে, সারভাইভ করে। একদম নিজের ছবিটা করার স্বপ্ন সাকার করে। সেলাম।

এই শহরে অনেকই এখন আপনাকে ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার হিসেবে চেনে-জানে। আপনার আরো বিবিধ পেশাগত পরিচয় ছাপিয়ে ফিল্মমেকার পরিচয়টাই প্রধান হয়ে উঠলো কীভাবে?

হুমায়রা বিলকিস: আমার অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর কাজ-কর্মের সূত্রে বেশ খানিকটা সময় কেটে যায় একটি বেসরকারি চ্যানেলে সাংবাদিকতা করে। পরে সে যাত্রারও ইতি ঘটে। যুক্ত হই শিক্ষকতা পেশায় ২০০৯ সনে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া পড়াই। এর ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা নিয়ে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণার কাজ করতে থাকি। এবং উপলব্ধি করতে থাকি যে, শুধু মিডিয়া, নিউজ, ভিজ্যুয়াল নয় বরং সিনেমা দেখা, পড়া এবং করাটাই আমার মূল আগ্রহের জায়গা।

এই আগ্রহের জায়গা থেকেই কি আবার পেশা বদল…

হুমায়রা: তুমি জানো বোধহয় যেহেতু আমি টিচিংটা কন্টিনিউ করতে চাইছিলাম, সেহেতু পেশাগত কারণেই আমার প্রয়োজন ছিল ফার্দার স্টাডির দিকে আগানো। তো, সেটা হোয়াই নট ইন ফিল্ম? মানে আমার যেটা আগ্রহের বিষয় সেটাতেই করাটা দরকার এবং এটা করতে গিয়ে বাইরের দুইটা ইউনিভার্সিটি থেকে আমার জন্য কাগজপত্র আসল। ভাবলাম যাব হয়তো। কিন্তু, যখন এত টাকা দিয়ে পড়া, প্লাস থাকা-খাওয়া। এই এলাহি খরচা সামলানো তো আমার কম্ম নয়। বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগল না। এক রকমের খারাপ লাগা শুরু হলো তখন। তাই, চিন্তাটাও বাদ দিলাম এবং আস্তে আস্তে পাকে চক্রে পড়ে টিচিংও বাদ দিলাম। সব বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সিং করব। সিনেমার কাজ খুঁজতে লাগলাম। 

বাংলাদেশের এই থোড়বড়ি খাঁড়া ফিল্মসিনে শুধু সিনেমায় ফোকাস করে ফ্রিল্যান্সিং করতে চাওয়া তো ‘কঠিনেরে আমি বাসিলাম ভালো’র নামান্তর।

হুমায়রা: জীবন যেখানে যেমন। তাই না? হোক, তখন আমি একটু আর কি নিজের কাজও করছি। আবার দেশের বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন ফিল্মমেকারদের সাথে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছি। সেই সময় ২০১২ হার সনে, পাকিস্তানি-কানাডিয়ান ফিল্মমেকার শারমিন ওবায়েদ-চিনয় ও গীতা গম্ভীর, জাতিসংঘে বাংলাদেশ পুলিশের নারী শান্তিরক্ষী ইউনিটের সদস্যদের সাহস ও সংগ্রামের প্রামাণ্য-গল্পের উপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণ করতে বাংলাদেশে আসেন। অ্যা জার্নি অব থাউজেন্ড মাইলস: পিসকিপারস্ শিরোনামের এই প্রজেক্টে আমি অ্যাসোসিয়েট প্রডিউসার হিসেবে করি। ওদের সাথে এই কাজটাও একটা বড় এক্সপেরিয়েন্স হইছে আমার জন্য।

অ্যা জার্নি অব থাউজেন্ড মাইলস: পিসকিপারস্ প্রামাণ্যচিত্রের পোস্টার।

তাহলে, সিনেমা নিয়ে বাইরে পড়তে যাওয়ার প্ল্যান একদম বাদ হয়ে গেল…

হুমায়রা: তা কেন হবে? প্ল্যান না থাকলেও ইচ্ছাটা ছিল। সব বাদ দিয়ে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে যখন ডুব দিছি, তখনও আমি মনে মনে খুঁজতেছিলাম কোথায় পড়তে যাওয়া যায়। ইন্ডিয়ার দিল্লিতে একটা কোর্সের খবর পাই ২০১০ সনে ক্রিয়েটিভ ডকুমেন্টারির উপর। মানে, আমি আসলে যেমন ধরনের কোর্স, খুঁজতেছিলাম, দেখলাম যে ঐ কোর্সের আউটলাইনটাও আমার টেম্পারমেন্টের সাথে যায়।

দিল্লির কোন ইন্সটিটিউটে?

হুমায়রা: শ্রী অরবিন্দ সেন্টার ফর আর্টস অ্যান্ড কমিউনিকেশনে। ক্রিয়েটিভ ডকুমেন্টারির উপর পোস্ট-গ্র্যাড কোর্সটার খবর পেয়ে আমার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগল। আমার মনে হলো আমি যা চাই বা এগজ্যাক্টলি যেভাবে চাই ডকুমেন্টারিতে, মানে আমি বাইরের কোর্সগুলোতেও এমন ডিজাইন দেখি নাই। ধর যে, গেরিলা ফিল্মমেকিং ডিজাইন—এক হাতে কীভাবে একটা ফিল্ম সামলানো সম্ভব, মানে আইডিয়া ডেভেলপিং থেকে শুরু করে, শুট করা, এডিট করা, একজন বা দুইজন ক্রু এবং সিম্পল প্রপস (ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার) নিয়ে সব। তার উপর, কোর্সটা নতুন, প্লাস যারা যারা ইনভলভড তারা সবাই আমার চেনা। ডকুমেন্টারি সেক্টরে এরা খুবই পরিচিত নাম। আমি একটা রিস্ক নিয়েই ওখানে চলে গেলাম।

আচ্ছা আচ্ছা। তো, এর আগে মানে ঢাকায় থাকা অবস্থায় কি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নিয়ে ওয়ার্কশপ বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটেছিল?

হুমায়রা: দেখ তখন, ওই অর্থে তো আমাদের সবারই, মানে যারা আমরা ফলো করতে চাইতাম, টুকিটাকি কিছু ওয়ার্কশপ এদিকে হচ্ছে, ওদিকে কিছু হচ্ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটি করতাম, সেখানে কেউ না কেউ আসতই, এগুলোতে অ্যাটেন্ড করা হতো। তবে, সিরিয়াস টাইপের ওয়ার্কশপের কথা বলতে পেলে অবশ্যই বলতে হবে সিনেমাটোগ্রাফার মাকসুদুল বারীর মেন্টরিংয়ে করা সিনেমাটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের কথা। ফিল্মমেকিং প্লাস ক্যামেরা ইন্টারেস্টেড যারা তাদের জন্য ছিল স্পেসিফিক একটা ওয়ার্কশপ। ২০০৫ সনে দুই মাস ধরে হাতে ক্যামেরা নিয়ে শেখা, ক্যামেরা পারসন পারসপেক্টিভ থেকে ডিজাইন করা ওয়ার্কশপটা একটা আই-ওপেনিং এক্সপেরিয়েন্স ছিল। ওয়ার্কশপটা অর্গানাইজ করেছিল স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট।

আচ্ছা, আবার ফেরত যাই দিল্লিতে। শ্রী অরবিন্দ সেন্টার ফর আর্টস অ্যান্ড কমিউনিকেশনে কোর্সের শেষে শর্তমাফিক একটা ডিপ্লোমা ফিল্ম করতে হয়। তো, ডিপ্লোমার অংশ হিসেবে নির্মাণ করলেন আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি (২০১৪)। এখন এই যে, সিনেমা ও দৃশ্যমাধ্যমকে কেন্দ্রে রেখে বিবিধ পেশা ও যাপন বদল করে আবার সিনেমা-শিক্ষার্থীর পরিচয় নিলেন—এই পর্যায়ে এসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফিল্ম পড়তে শিখলেন, গড়তে শিখলেন। সেখানে, কতটুকু লার্নিং ছিল আর কতটুকুই বা আনলার্ন (মানে শেখা জিনিস ভোলার চেষ্টা) করতে হয়েছে?

হুমায়রা: দেখ, এটা খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার। ওখানে আমরা অবশ্য যেই কোর্সটা করেছি ওটা খুব ইন্টারেস্টিং ডিজাইন ছিল, মানে খুবই হ্যান্ডসাম কোর্স ছিল। ওটা একদমই অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে ভারাক্রান্ত ছিল না। এবং আমার পছন্দের ফিল্মমেকাররাও ওখানে ছিল। তারপরেও একটা কোর্স যেহেতু কিছু না কিছু বিষয় তো থাকেই। কোর্সের মধ্যে দিয়ে যেটা হয়—একটা অর্গানাইজড প্রসেসের মধ্যে দিয়ে কোনো একটা ফিল্ম দেখা, পড়া ও ভাবার প্র্যাকটিস গড়ে উঠে। আগে যেমন খুবই র‍্যানডমলি একটা ছবি দেখা বা ছবি নিয়ে কথা বলা হইত আরকি। এই ধরনের পড়া বা ওরকম অর্গানাইজড বা গোছানোভাবে তো আসলে এটা হয় নাই।

আমাদের কোর্সটার আউটলাইনটা এমন ছিল যে, টিম হতে হবে দুইজনের, আর যেহেতু যে কাজটা করবে সেই আবার ক্যামেরাটাও করবে, সেই এডিটটা করবে, তোমার শুধু সাউন্ডের জন্য সাথে একটা মানুষ দরকার। তো, আমাদের ঐটাই সিস্টেম ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে এমনও হইছে যে, একই সময়ে সবার ডিপ্লোমা ফিল্মের কাজ শুরু হওয়ার কারণে অনেকে হয়তো সাউন্ডের কাজ করার জন্য কেউ কাউকে পায় নাই। তবে মোর অর লেস সাথে একজন ছিল সাউন্ডটা হ্যান্ডেল করার জন্য।

আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি (২০১৪) এর একটি দৃশ্য।

তো, এই ডিপ্লোমা ফিল্মের বাজেট কেমন ছিল?

হুমায়রা: অলমোস্ট জিরো বাজেট। বলতে গেলে নিজের বাজেট আর ইন্সটিটিউটের ছিল লজিস্টিকস সাপোর্ট মানে ক্যামেরা, সাউন্ড ইকুইপমেন্ট, এডিটিং স্যুট আর বাদবাকি যা খরচ তা সব নিজের।

ঐ সময় আপনার পারসোনাল স্টাইল এবং অ্যাস্থেটিকস কী হবে বা কী করতে চান সেটার ধারণাটা কীভাবে ডেভেলপ হয় বা হইছিল?

হুমায়রা: আমি যেরকম, মানে বরাবরই আমার মধ্যে সিচুয়েশন অবজার্ভ করা, আর্কাইভ করার একটা প্রবণতা কাজ করে। সে কারণেই হয়তো পারসোনালি আমি অবজারভেশনাল সিনেমার প্রতি এই কোর্সের মধ্যে দিয়ে খুব অ্যাট্রাক্টেড ফিল করা করি। কোর্স ওয়ার্কের অংশ হিসেবে একটা প্রেজেন্টেশন ছিল সেটাও আমি অবজারভেশনাল সিনেমা নিয়ে করেছি। তো থাকেনা যে এক একজনের পছন্দের এক একটা জায়গা থাকে। আমার ক্ষেত্রে আমি যেটা খেয়াল করি যে, অবজারভেশনাল এবং পারসোনাল রিফ্লেক্সিভ—এর যে ধারা, দুইটাই আমাকে অ্যাট্রাক্ট করতেছে।

সেইটা বুঝতে পারলেন কীভাবে?

হুমায়রা: মানে ওইটার একটা ধরন আমার ভেতরই আছেই। তো যেটা হচ্ছে, এই কোর্সের মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা আরও পরিস্কার হয়ে ওঠে আমার কাছে। কিন্তু এটা আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আগে থেকেই ছিল বলতে আমি সবসময় আমার ক্যামেরাতে আমি কিছু না কিছু ছবি তুলি। কিছু না কিছু কাজ করতেই থাকি এবং এটা ঠিক কাজের জন্য না, আনন্দের জন্য। যখনই নতুন কোনো জায়গায় যাচ্ছি, নতুন কোনো কিছু এক্সপ্লোর করতেছি, তা ক্যামেরায় তুলে রাখতেছি, নয়তো নোট নিচ্ছি। ধর, ফ্যামিলি ট্রিপে কোথাও গেলাম, আমরা সবাই-ই আছি, সেখানে আমি ছবি দিয়ে কিছু না কিছু করতেছি। ওইটা আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আর আমার কাছে মনে হইছে কোর্সটা হচ্ছে তোমার পাথটা কী এটাকে ফাইন্ড আউট করার চেষ্টা করা। তুমি এক্সপ্লোর কর নিজের পাথটাকে। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হইছে কোর্সটা এবং কোর্সের আউটপুট হিসেবে আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি, ঐ পুরাটা সময়ই আমি আসলে একটা ইজি পথ খুঁজতেছিলাম। ওখানে যেই কাজটা করছি ওটাকে আমি কোনোভাবেই ধর আর সেকেন্ড টাইম পয়দা করতে পারব না! আমার কাছে বরং এইটাই ভাবতে ভালো লাগে যে, ঐ কাজটা আসলে আর কোনোদিন করা সম্ভব হবে না।

কেন?

হুমায়রা: ওই পরিমাণ নার্ভ আসলে জীবনে ফিরে পাওয়া সম্ভব না। ঘটনাটা ঘটার জন্য যা যা দরকার ঐ সমস্ত কিছু ওখানে ছিল এবং ওখানে সমস্ত কিছুর মিশেলে ধর একটা অদ্ভুত সারল্যের যে বহিঃপ্রকাশ, পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে কেউ সেই টেক্সচারটা আছে। আমার কাছে পারসোনালি মনে হইছে যে, কোনো ইঁচড়ে পাকামো নাই কিন্তু এতে পথ খোঁজার একটা চেষ্টা আছে আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লিতে।

চেষ্টা করার তেষ্টাটা ট্রান্সপারেন্টলি বোঝা যায় আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লিতে।

হুমায়রা: হ্যাঁ, মানে প্রিটেনশন নাই আরকি। আছে না যে, আর্ট করতে গিয়ে বা সিনে করতে গিয়ে মানুষকে চাপ দেওয়ার অজুহাতে নিজেকে নিজের কাছ থেকে লুকানোর একটা খেলা করার পাঁয়তারা; ঐটা আমি খোলামেলাভাবে হ্যান্ডেল করার ট্রাই করছি।

তা তো বটেই। ট্রান্সপারেন্সি যেমন জরুরি তেমনি অ্যাম্বিগুইটি তো থাকা দরকার। যেইটা আপনার ফিল্মে পৌনঃপুনিকভাবে হাজির থাকে। একেবারে বাইনারি ছকে ফেলে কোনো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা না করার বা না দেখতে চাওয়ার প্রবণতা আমি মনে করি আপনার কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলে, মূল গল্পের সমান্তরালে ইন্টারসেকশনাল ইস্যুগুলোকে টোটালি অগ্রাহ্য করা হয় না। এছাড়া তো, জীবন-সময়-পরিপার্শ্বের ভেতর ঘটতে থাকা, জায়মান বিমূর্ততা বোঝা সম্ভব নয়। আর ঐ কারণে যেটা হয় যে আমাদের জীবনের ভিতরকার যে অ্যাবস্ট্রাকশন, ওটা আমরা ফিল করতে পারিনা। যেটা কিনা আপনার ফিল্মের মধ্যে দেখা যায়, এক ধরনের অ্যাবস্ট্রাকশন। যেমন হঠাৎ এমন একটা ছন্নছাড়া ফ্রেম উদয় হয় চলমান গল্পের মধ্যে কোনোরকম শানে-নুযূল ব্যতিরেকে। এই ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্টটাকে বেশ ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা থেকে দেখার সুযোগ আছে।

হুমায়রা: দিল্লিতে সহপাঠীদের মধ্যে আমাকে নিয়ে একটা কথা চালু ছিল যে, আমি খুব কনফিডেন্টলি কনফিউজড। এইটা নিয়ে খুব হাসাহাসিও করত সবাই। যাই হোক, আমি একদমই বলতে চাইনা বা আমি কখনোই বলিনা যে আমি খুব কনফিডেন্ট। মানে কনফিডেন্স শব্দটাই আমার কাছে খুব ঝামেলার মনে হয়। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে। ইনকনফিডেন্ট থাকাটা আমার কাছে প্যারা মনে হয় না। বরং, কনফিউজড থাকাটা আমার কাছে খুব পছন্দের মনে হয়। আর্ট বা ফিল্ম করার প্রশ্নে এই ইনকনফিডেন্স আমাকে পলিটিক্যালি একটা ভিন্ন ভাবমূলক দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচনের সুযোগ করে দিয়ে থাকে। আমার মনে হয় যে, এটা আমাকে এক ধরনের অ্যাস্থেটিক স্বাধীনতা দেয় আরকি।

এ পর্যন্ত আপনার তিনটে ফিল্ম প্রকাশিত হয়েছে: আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি (২০১৫), বাগানিয়া (২০১৮) এবং ডিয়ার মম (২০১৯)। আপনার ফিল্মমেকিং স্টাইলের মধ্যে দুইটা বিষয় প্রথমেই নজরে আসে মিনিমালিজম এবং গেরিলা স্টাইল ফিল্মমেকিং। পাশাপাশি, আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি এবং ডিয়ার মম এই দুইটা ফিল্ম একসাথে দেখলে বিষয়গতভাবে নজরে আসে যে, ইসলাম এবং ফটোগ্রাফ বা ফটোগ্রাফি, এবং পারসোনাল আইডেন্টিটি—এই ডিবেটটা আপনি ক্যারি করতেছেন দুটো ফিল্মে। যদিও, দুটো ফিল্মের লোকেশন ভিন্ন—একটা দিল্লিতে, আরেকটা ঢাকায়। এই দুইটা ইস্যু আপনার কাছে কেন মনে হইল বেশি ইম্পর্ট্যান্ট?

হুমায়রা: আমার কাছে মনে হয় যে, এটা একদম ছোটবেলা থেকেই আমার একটা কোর কোয়েশ্চেন ছিল। ছোটবেলায় ছবি আঁকা আমার খুব পছন্দ ছিল। যখনই কোনো মানুষের ছবি আঁকাআঁকি করতাম বা কোনো হিউম্যান ফিগার আঁকতে গেলেই আমাকে বাসায় বলা হতো যে এটা খুবই গোনাহর কাজ। ছবি আঁকলে ওটাতে জান দিতে হবে। তো ছোটবেলা থেকেই ওটা একটা ভয়ের কারণ ছিল আমার জন্য। এবং আমি তারপরেও লুকায়ে লুকায়ে আঁকাআঁকি করতাম। এবং অনেক সময় মুখ আঁকতাম মানুষের। তো ওটাতেও সবসময় একটা আতঙ্ক থাকত আমার মধ্যে। সবসময় মনে মনে বলতাম যে, আল্লাহ আমি এটা এরপরে আর করব না।

আমার কাছে মনে হয় কোনো একভাবে সাইকোলজিক্যালি আমার মধ্যে ওই জায়গাটা খুব ইমপ্রিন্টেড হয়ে আছে এবং এটা শুধু তখন নয়, এখনও আমার বাসায় বিভিন্ন সময়েই আমার এটা শুনতে হইছে। ধর যে, এক একটা স্টেজ থাকেনা? যখন লেখাপড়া করতেছি তখনো তারা নিশ্চিত হইছে যে হ্যাঁ রুমু মাস কমিউনিকেশনে পড়তেছে। এখন হয়তো অন্যদের মতো একটা ক্যারিয়ার ডেভেলপ করবে। ওখানে আবার কিছু কোর্সও ছিল ফিল্ম, ভিজ্যুয়াল মিডিয়া রিলেটেড। তবে যখন টিচিং এ ঢুকলাম তখন আবার তারা একটু নিশ্চিন্ত হলো। আবার যেহেতু ওখান থেকে বের হয়ে ফিল্ম করা শুরু করলাম, আমার ফ্যামিলির মানুষজন আবার ভড়কে গেল। মানে, এই যে একটা অদৃশ্য পীড়ন, এইটা থেকে আমার ছুটকারা মেলে নাই এখনো। এই ফিল করাটা আসলে কনফ্লিক্ট করে আমাদের ভ্যালু সিস্টেম এর সাথে। তো ওইটাই আমার মনে হয়। যখনই আমি কোনো কাজ করতে গেছি এই ব্যাপারটা আমার সামনে একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াইছে। আমার কাছে এটা খুবই অন্টোলজিকাল ক্রাইসিসের জায়গা। 

আমাদের প্রচলিত যে ইসলামীয় ধারণা, সেই ধারণা থেকে চিন্তা করলে সিনেমা তো আসলে একদমই শরিয়তের বাইরে।

হুমায়রা: হ্যাঁ, শরিয়তি ধারণা অনুযায়ী এটা একদমই বেশরিয়তি কাজ।

এই অন্টোলজিকাল ক্রাইসিসকে, এম্পিরিকাল নলেজ দিয়ে সুরাহা করার চেষ্টা করতে গিয়ে কি আপনি স্টিল ফটোগ্রাফ ইউজ করেন ন্যারাটিভে? নাকি ট্রিটমেন্ট অনুযায়ী ইউজ করেন? মানে আপনার পয়েন্ট অব ভিউটা কী? 

হুমায়রা: দুইটাই । মানে আমি আসলে একটা মজা পাই এটাতে সত্যি কথা বলতে ।

কী রকম ব্যাপারটা, একটু শুনি?

হুমায়রা: এটা একটা দ্যোতনা তৈরি করে বয়ান ও বয়নে। ধর যে, আমরা তো মুভিং ইমেজ নিয়ে কাজ করি। তাই না? তো, মুভিং ইমেজের এমন কিছু কিছু মুহূর্ত ঘনায় উঠে, যেখানে মনে হয় যে সময়ের একটা স্তব্ধতা নির্মাণ করা জরুরি। এই অর্থে সময়টাকে ফ্রিজ করে দিচ্ছি, স্টিল ইমেজ ব্যবহার করে। একধরনের পাওয়ার-প্লে বলতে পার। অ্যাজ ইফ আই অ্যাম ফ্রিজিং দ্য টাইম। এই যে একটা ক্ষণ বা একটা সময়কে স্থির করে দেওয়া, বা সময়কে স্থির করে দেওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ওটা আমার মনের মধ্যে কাজ করে। মানে সময় নিয়ে খেলা করার একটা ব্যাপার আমার মনের মধ্যে কাজ করে আরকি।

ক্রিস মার্কারের লা জেতি (১৯৬২) কি প্রভাবিত করেছে আপনাকে এই ক্ষেত্রে?

হুমায়রা: লা জেতি তো আমার খুব পছন্দের ফিল্ম। ওখানে তো পুরোটাই স্টিল ফটোগ্রাফ দিয়ে করা। আমার ইচ্ছা ওরকম একটা ফিল্ম বানানোর, তবে এই ক্ষেত্রে যে খুব একটা প্রভাবিত করেছে এমন নয় বিষয়টা। আমি ব্যক্তিগতভাবে আরও নানান মিডিয়াম ইউজ করতে চাই ফিল্মে। আমার যেরকম আর্ট বা পেইন্টিংস ব্যবহার করার ইচ্ছা হয় কিন্তু যেহেতু এগুলোতে আমি অভ্যস্ত না বা পারি না কাজগুলো, তো সেই কারণে আমি ওগুলো যোগ করতে পারি না ফিল্মে। যেটুকু করতে পারি, সেটাই করি আরকি।

লা জেতি (১৯৬২) সিনেমার একটি দৃশ্য।

না না সেটা তো বটেই। এই যে ধরেন, দিল্লিতে আপনি যখন পড়তেছেন তখন তো আপনি টেম্পোরারি মাইগ্রেন্ট। একটা ডিসটেন্স সবকিছু থেকে, মানে নিজের পরিচিত জায়গা থেকে, সময় থেকে। একটা সার্টেন টাইম পরে শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে আবার আবিষ্কার করা। আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লিতে আমি দেখতেছি যে আপনি অনেক ধরনের ‘বিচ্ছিন্নতা’ নিয়ে কাজ করতেছেন। এই বিচ্ছিন্নতার বুনন আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি এর থেকে হাজির থাকে। যেমন, আপনে ওভার দ্য টাইম নিজের দিনযাপন এর লিপি করতেছেন ভিডিও এর মধ্যে দিয়ে। ফিলও আবার সেগুলো জুড়ে দিছেন কাহিনির ঘটমান বর্তমানের সাথে।

আমার কাছে মনে হইছে এই বিচ্ছিন্নতাগুলো একটা ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ কে আপনার ফিলে এবং সেলফ-এক্সপ্লোরেশনে। একজন মিনিমালিস্ট, গেরিলা ফিল্মমেকার হিসেবে এই পারসোনাল আর্কাইভিংয়ের প্রসেসটা ক্রিয়েটিভলি আপনাকে হেল্প করেছে। যেটা একই সাথে অবজারভেশনাল এবং সেলফ রিফ্লেক্সিভ ডকুমেন্টারি ধারার অনুপম দিক মেলে ধরেছে। তা, কোর্সের শুরু থেকেই কী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিসিলেন যে, আপনি আসলে আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি করবেন শেষ পর্যন্ত বা এভাবে এক্সপ্লোর করবেন? নাকি ইন প্রসেস অব টাইম আপনি আসলে বুঝতে পারেন যে, ক্যামেরার লেন্সটা আপনে নিজেই নিজের দিকে তাক করে রাখছেন?

হুমায়রা: এটা আসলে কাইন্ড অফ এটারই মিক্সচার। ‘দেখা’র ব্যাপারটা তো ইম্পর্ট্যান্ট এখানে। কে কীভাবে দেখে। যেমন, আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লিতে অনেক কটেজ আছে যেগুলো থ্রু দ্য ইয়ার আমি নিচ্ছিলাম। কারণ, আমাদের একটা লিমিটেশন ছিল যে, ছয়দিনে এটি করতে হবে। এবং আরও কিছু লিমিটেশন ছিল যেমন নির্দিষ্ট এলাকা বা জোনের মধ্যে শুট করতে হবে। তখন আমি আসলে ডিপ্লোমা ফিল্মের জন্য উর্দু ও ফার্সি ভাষার কবি মির্জা গালিব এর ওপর পড়াশোনা করতেছিলাম। আমার খুবই পছন্দের টপিক, সেটা করতে করতে অতি বেশি পড়াশোনা করে আমার বিরাগ তৈরি হয়ে গেল, সামহাও আমার একটু মেজাজ টেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তারপর আমি দেখলাম যে, না এটার ওপর তো আমি কাজ করব না। কিন্তু ঐটা রিসার্চ করতে গিয়ে নামি অনেককিছু গুলিয়ে ফেলেছি মানে গালিবের কবিতা, গালিবের জীবন, অস্তিত্ব, সুফিবাদ, ইসলাম এবং নিজের সত্ত। তখনো কিন্তু আমি ছবি তুলতেছিলাম, প্রতিদিনের। ডকুমেন্টেশন তো আমি করতেছিলামই প্রথম থেকেই, যখন আমি প্লেনে যাচ্ছি, আসছি, যে কলোনিতে থাকি। আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় যা ইমেজ দেখি প্রায় সবকিছুই কিন্তু আমি ডকুমেন্ট করতেছি।

আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি আমার মধ্যে দানা বাঁধা শুরু করছে যখন এই যে দিল্লির ‘হপ অন হপ অফ’ বাস সার্ভিসে ঘোরাঘুরি করা শুরু করলাম। হপ অন হপ অফ বাস সার্ভিসটা দিল্লির সিটি ট্যুরিজমের একটা পার্ট। যেখানে বাসে চড়ে সারাদিন ঘুরে ঘুরে। শহরের দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করানো হয়। তখনই আমার মাথার মধ্যে অদ্ভুত একটা হাতিয়ার এর ভাবনা আসে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি দেখে। 

ট্যুরিজম ইন্ডিয়ায় একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি এবং এটার যেমন ঐতিহাসিকতা আছে তেমনি রাজনৈতিকতাও আছে। এবং এই দুইয়ের মাঝে একটা ন্যুয়ান্স স্পেস আছে। এই বিষয়টা ঘুরে ঘুরে আমার চিন্তার মধ্যে আসতে থাকে এবং একটা স্যাটায়ার টাইপ। চিন্তাভাবনার স্কোপ আছে বিষয়টা বুঝে উঠলেও, আসলে স্থির কিছু ছিল না মাথায়, আমি কি করব জানতাম না। তো, এর মাঝে আমাদের ডিপ্লোমা ফিল্ডের আউটলাইন জমা দেয়ার টাইম হয়ে গেল মানে তখন তো কনক্রিট একটা কিছু জমা দিতেই হবে। অ্যাজ আ কোর্সওয়ার্ক, ডিপ্লোমা ফিল্মের কাজটা যেমন আমাকে একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আইডিয়া ভিজ্যুয়ালাইজ করার সুযোগ সুবিধা দিচ্ছিল তেমনি কনক্রিট কিছু ব্যাপারও ছিল। যেমন, একটা কমপ্লিট প্রপোজাল দিতে হবে, একটা কমপ্লিট স্ক্রিপ্ট দিতে হবে।

এখন আমি তো বিপদে পড়ে গেলাম, হায়! হায়! অবস্থা! আমি তো মির্জা গালিব করব না, আবার অন্য কী করব সেটাও জানি না, তখন আমি এরকম খুবই অ্যাবস্ট্র্যাক্ট একটা আইডিয়া মেটায় দেখা-না দেখা-অদেখা এর যে বিভাজন এবং আমার পারসোনাল এক্সপেরিয়েন্স থেকে আমি আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লির আউটলাইন সাবমিট করি। এবং ট্রিটমেন্টে এটাও জানাই যে, আমি থ্রু আউট দ্য ইয়ার যেসব ছবি তুলছি ভিডিও করছি এটাও আসলে এই কাজের মধ্যে থাকবে। এভাবেই ফটোগ্রাফ জুড়ে দেয়ার আইডিয়াটা ডেভেলপ হয় তখন।

এবার তাহলে, আপনার দ্বিতীয় ফিল্ম বাগানিয়া নিয়ে আলাপ করা যাক। সিলেটের চা-বাগান ও শ্রমিকদের নিয়ে এবং ভিত্তি করে করা বাগানিয়ার আইডিয়া ডেভেলপিং প্রসেসটা কীভাবে শুরু হলো?

হুমায়রা: প্রথমবার আমি ২০০৭ এ প্রশিকা থেকে একটা ওয়ার্কশপ করার জন্য চা-বাগান যাই। ইউনিভার্সিটির ফাইনাল দিছি মাত্র তখন। পড়ালেখা শেষ কিন্তু ছাত্র শেষ হয় নাই—এইরকম একটা সময়ে। এরপর আরও ঘুরতে যাওয়া হয় বিভিন্ন সময়ে। এরকম করতে করতেই ধর আমি চা-বাগানের কিছু পরিবারের সাথে জড়ায়ে পড়ি। মানে যারা চা-বাগানের শ্রমিক পরিবার আর কি।

আর তখন চা-বাগানে কিছু ক্রাইসিসও চলতেছিল। ডায়রিয়ার প্রকোপ ও আরও নানারকম সমস্যা। তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসিতে স্টুডেন্টদের একটা সংগঠন ছিল বিভিন্ন মানবিক সাহায্য সহায়তা করত। একটা সংগঠন ছিল স্যালাইন বানাও। ওইখান থেকে আমি ২০০০ প্যাকেট স্যালাইন নিয়ে একা একা ট্রেনে করে চা-বাগান গেছি। মানে, আমি এতটাই বিচলিত হয়ে গেছিলাম যে এখন আমাকে এখানে উদ্ধারকর্তা হিসেবে নামতে হবে এমন একটা মানসিক অবস্থা তৈরি হয়। তো যাই হোক, এরকম অনেক ইন্টারেস্টিং গল্প আছে আরকি। তো তখনো ওদের সাথে ছবি বানানো বা ভবিষ্যতে এমন কিছু করব আমার মাথাতেও ছিল না।

পুরো ব্যাপারটাই যেহেতু নতুন আমার জন্য, মানে যে ব্যাকগ্রাউন্ডে আমি বড় হয়েছি, সেখান থেকে চা-বাগান তো একটা কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট জোন। সেই জায়গা থেকে এই যোগাযোগটা নতুন অভিজ্ঞতা। যেমন, তেমনি জীবনের জন্য লার্নিং পয়েন্টও। ওইখানে যেয়ে ওদের সাথে জীবনযাপন, জীবনটা দেখা আমার কাছে ভালো লাগত। তো, ওইটাই করতেছিলাম। চা-বাগানে যেয়ে ছবি-টবি করা বা অন্যরকম চিন্তা এগুলো মাথায় ছিল না।

এই আসা-যাওয়া করতে করতেই দিল্লিতে ডিপ্লোমা কোর্সের খবর পাই এবং যাওয়ার জোগাড়যন্ত্র শুরু করি। ফলে, ঢাকার লাইফ, চা-বাগান সবকিছু পিছনে ফেলে দিল্লি চলে গেলাম । এবং যাবার আগে, বেঙ্গল চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম এর ‘নবীন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রকল্প’তে ফিল্ম প্রজেক্ট জমা দেয়ার ইনভাইটেশন পাই। সেই সিলসিলায় চা-বাগান নিয়ে আমি একটা স্টোরি ডেভেলপ করে জমা দিয়ে যাই।

এরপরে তো বেঙ্গল চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম খুবই স্লো একটা প্রসেসে আগায় দিল্লিতে আমার কোর্স চলতে থাকে আবার ঢাকায় এটাও চলতে থাকে। তাতে করে যেটা হয়, আমি কোর্সটা শেষ করে ফিরে আসতে আসতে বাগানিয়ার ফান্ডিং প্রসেসটা কমপ্লিট হয়ে যায়। আমি ২০১৪-তে ঢাকা ব্যাক করি । এরপর ২০১৫ এর শেষের দিকে বেঙ্গল চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম ফান্ড রিলিজ করা শুরু করে।

বাগানিয়া (২০১৯) প্রামাণ্যচিত্রের পোস্টার।

বাগানিয়া আপনার অন্য দুইটা কাজ থেকে একদম ভিন্ন। বিষয়গত দিক থেকে বিচার করলে বাগানিয়াতে এথনোগ্রাফি আছে, সময়-অনুক্রমিক অবজারভেশন আছে। একটা সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার আছে। ডেমোগ্রাফিক বিবরণ আছে। কালচারাল আর্কাইভেশন আছে। কিন্তু সমসাময়িক ফিল্ম ফেস্টিভালগুলো যেমন সিনেম্যাটিক প্রোডাক্ট দেখতে চায়, যেমন: ফিল্মমেকার একটা প্রবলেমকে ফোকাস করবে, প্রবলেমটা ডালপালা মেলতেছে সেটা তুলে ধরবে, যেখানে নন-ফিকশনাল হিরো-হিরোইন থাকবে, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবনযুদ্ধে জয়ী হবে। সবশেষে একটা সমাধান থাকবে। এসবের কিছুই আসলে আপনি দেখান নাই।

হুমায়রা: নাহ, যদিও এগুলোর প্রচুর সম্ভাবনা ছিল ওইখানে।

বটেই প্রচুর সম্ভাবনা ছিল বৈকি। তবে আমার কাছে যেটা মনে হইছে। ভিজ্যুয়ালি বাগানিয়া আপনার অন্য কাজের তুলনায় শৈলীগতভাবে আলাদা। যেখানে আপনি প্রচুর পরিমাণে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শট ইউজ করছেন এবং লং টেক নিছেন এবং ক্লোজআপ শট ব্যবহার করছেন। এমনতর ট্রিটমেন্টের দিকে ঝুঁকলেন কেন?

হুমায়রা: প্রথম কথা হচ্ছে পুরো ফিল্মটাই অবজারভেশনাল মেথডে করা, আমি জেনে বুঝেই কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার রাখিনি। এডিটিংয়ে যখন বসেছি, অনেক স্কোপ ছিল সাক্ষাৎকার যোগ করার। আমি চেষ্টাই করেছি অবজারভেশনাল মুডকে প্রাধান্য দিয়ে গল্পের বিস্তার যতটুকু সম্ভব করা যায় তা করতে। আর একটা জায়গা হচ্ছে যে, আমার কাছে সবসময় মনে হয় ‘লোকেশন’ একটা আইডিয়া সেট করে দেয় শুরু থেকেই। কিন্তু তারপরেও ফিল্মের কন্টেন্ট ও কনটেক্সট ফর্ম বা ফিল্মের আঙ্গিককে অনেক প্রভাবিত করে। সেই জায়গা থেকে চা-বাগান ও চা-বাগানে বসবাসরত শ্রমিকদের যে জীবনযাপন আমি ফিল্মে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। সেখানে দৃশ্যতই আমি ‘ক্যালেন্ডার ইমেজ’ বা শহুরে চোখে প্রকৃতি চেখে দেখার বড়লোকি দৃষ্টিভঙ্গিকে ইগনোর করার চেষ্টা বরং, বিউটি শট বাদ দিয়ে আমি ভিন্নরকম একটা গল্প বলতে চাইছি এখানে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বাগানিয়া এই চ্যালেঞ্জটা দাবি করে।

যে কারণে আমি বাগানিয়াতে যেমন চোখের জন্য আরামদায়ক এমন লেন্স ও শট কোনোটাই ব্যবহার করিনি। ঐখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাকে আসলে প্রোভোক করেছে এভাবে ভাবতে। আমি অবশ্যই অস্বীকার করব না যে, এত সুন্দর সুন্দর এবং অদ্ভুত অদ্ভুত সব রেডিমেড ফ্রেম বাদ দেয়াটা বাগানিয়াতে একটা বড় সংযমের ব্যাপার ছিল আমার জন্য।

চা-বাগান, চা-বাগানের ফোর্সড লেবার এর ইতিহাস তুলে ধরেন নাই। এমন অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে?

হুমায়রা: আমার কাছে একটা ব্যাপার মনে হয়েছে যে, এভাবে দেখলে চা-বাগানের হিস্ট্রির একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে ফোর্সড লেবার জনগোষ্ঠী যাদেরকে বাধ্য করে নিয়ে এসেছে ব্রিটিশ রাজ এবং তখন শুধু তো বাংলাদেশ না বা এই ভূখণ্ডে বা ভারতে না বরং পৃথিবীর আরও বিভিন্ন অঞ্চলে এই সমস্ত জবরদস্তিমূলক ঘটনা ঘটেছে। এটাতো কারও অজানা কিছু না। আমি এখানে একটা কাউন্টার পজিশন নিয়েছি যে, সবসময় এরকম জানাইতে হবে কেন। কারণ, আমি তো গল্পটা পোয়েটিক্যালি বলতে চাইছি। সেক্ষেত্রে, ঐতিহাসিক তথ্যের ডিসপ্লে করাটা আমার কাছে অযাচিত বলে মনে হয়। কেননা, আমি মনে করি এতে গল্প বলার পোয়েটিক রিদম ব্রেক হয়।

বেশ বড় দুইটা ফেস্টিভালে বাগানিয়া প্রি-সিলেক্টেড হইছিল বিভিন্ন জায়গা থেকে যে ফিডব্যাকটা বেশি পেয়েছি যে, বেশির ভাগই গল্পের লোকেশনটার মোমেন্টামটা বুঝতেছে না এবং সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। ফিল্মটা করার সময় যে বিষয়গুলো নজরে রাখি নাই, তা নয়। কিন্তু, করবার সময় মনে হইছে, না আমি এভাবেই করে দেখতে চাই। আমার কাছে মনে হয়, এটা আমার স্বাধীনতার জায়গা।

বাগানিয়া প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য।

আপনার ডকুমেন্টারি ফিল্ম চর্চায় পলিটিকস প্রকটভাবে মুদ্রিত হয় না পরন্তু, পলিটিক্যাল স্যাটায়ার থাকে। যেমন আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লিতে একজন মাছ বিক্রেতা বলছে, “নদীর ইলিশ নাই, মোদির ইলিশ আছে”। যদিও, পলিটিক্যাল আলাপকে গল্পের ফোরগ্রাউন্ডে রাখলে অধিকাংশ সময় দর্শক গল্পটার দিকে নজর দেয় না। আবার লেয়ার বা ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখলে গল্পটা দেখতে গিয়ে পলিটিক্যাল যে কমেন্ট্রি আছে সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আবছায়া হয়ে যায়। 

হুমায়রা: খুব মজার ব্যাপার এটা। সবাই ধরেই নেয় যে, ডকুমেন্টারি হ্যাজ টু বি লাইক দিস বা মাস্ট বি পলিটিক্যাল। পলিটিক্যাল একটা মুভমেন্টের জায়গা থেকে বা একটা মুখপাত্র হিসেবে ডকুমেন্টারি কাজ করবে। আমি মনে করি, ডকুমেন্টারি ফিল্ম ধারা হিসেবে অলরেডি এমন দায়ভারে জর্জরিত। সেই জায়গা থেকে আমি অনেকের কাছ থেকেই বিশেষ করে আমাদের দেশে এবং ইন্ডিয়াতেও ওদের কাছ থেকে খুব পজিটিভ কখনো কিছু শুনিনি অভিযোগ—আমার কাজের মধ্যে পলিটিক্যাল কোনো অ্যাপ্রোচ নাই, আমি যে একটা স্ট্যান্ড নিচ্ছি—সেটা নাই। তার মানে যেন এটা থাকতেই হবে! 

তো প্রথম কথা হলো আমি মনে করি না যে থাকতেই হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমি ব্যক্তিগত চরিত্রটা যেমন, আমি যে চরিত্রটাকে প্রকাশ করব, সেভাবেই ফিল্মে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসবে। ব্যক্তিগত চরিত্রের এবং ব্যক্তিগত জায়গা সরাসরি পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন এর কোনো ইতিহাস আমার নাই। তারপরেও, আমার একটা পলিটিক্যাল ভিউ আছে। সে জায়গা থেকে স্যাটায়ার এর ব্যবহার আমার কাছে বেশ কার্যকরী মনে হয়।

ডিয়ার মম, আপনার চলমান প্রজেক্ট বিলকিস এবং বিলকিস এর একটা পার্ট। যেখানে আপনি ও আপনার মা প্রধান চরিত্র। এ ধরনের অন্তর্মুখী বয়ানের ভাবনার শুরুটা কীভাবে হলো?

হুমায়রা: ওইটাও আসলে এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিসের জায়গা থেকে শুরু হয়। এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রতিটা কাজই আমি এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিসের জায়গা থেকে করি। কোনো একটা সময় আমার যদি মনে হয়, আমার কোনো এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিস নাই তাহলে হয়তো আমি আর কাজ করব না। সেটা আসলে আমাদের হয় না। নাম দুইটা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমার মায়ের সারনেম, আমার নিজেরও সারনেম। এই ফ্যামিলির যে হেরিটেজ, তার ধারাবাহিকতা, যেখানে প্রচুর কনফ্লিক্ট গড়াগড়ি খাচ্ছে, অ্যাজ এ ফিল্মমেকার সেখানে দাঁড়ায় থাকবার জন্য যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও প্রতিরোধ জারি আছে—তার সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে যে এটা সোসাইটির একটি ইম্পর্টেন্ট একটা অধ্যায় আসলে। আমি এই ডকুমেন্টেশনের জায়গা থেকেই ডকুমেন্ট করা শুরু করছি। সেখান থেকেই আসলে শুরু হয়েছে।

ডিয়ার মম (২০২২) প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য।

ডিয়ার মম তথা বিলকিস এবং বিলকিস শুধুই মা-মেয়ের গল্প না। বরং আমি বলব যে, এখানে আপনি তথাকথিত সুবিধাজনক সামাজিক শ্রেণিতে অবস্থান করেও ক্যামেরার লেন্সটা অন্য শ্রেণির দিকে তাক না করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিছেন। যেটা কিনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত দেখা যায় না। কথার কথা, যেসব ফিল্মমেকাররা বাংলাদেশে বসে ফিকশন বানাচ্ছেন তাদের গল্পের জায়গায় তো তার শ্রেণিটা নাই, তার কালচারাল, তার পলিটিক্যাল, তার সোশ্যাল, ফাইনান্সিয়াল যে ক্লাস সেটাকে তো সে দেখাচ্ছে না। সে দেখাচ্ছে এরকম কোনো একটা বেকার মানুষকে, কোনো একটা ক্যানভাসারকে, সে দেখাচ্ছে কোনো একটা গার্মেন্টস ব্যবসায়ীকে তথাপি সে তো নিজের ক্লাসকে দেখাচ্ছে না, নিজে কীভাবে সপ্তাহটা যাপন করে সেটার ভিজ্যুয়ালাইজেশন তো সে করতেছে না।

হুমায়রা: সবই কল্পনা এবং কল্পিত একটা ক্লাস। যেমন ধর, যে মিডল ক্লাস দেখা যায় ঐসব ফিল্মে, সেই মিডল ক্লাসটাকে আমি কখনও দেখি নাই আমার আশেপাশে। যদিও আমি মিডল ক্লাসে বিলং করি।

ডকুমেন্টারি ফিল্মের ক্ষেত্রে প্রায়শই তুমি দেখে থাকবা নির্মাতা অধনস্ত শ্রেণির উপরে ক্যামেরার লেন্স তাক করে রাখছে। এই লেন্সই যদি নিজের দিকে ফেরানো হয় তখনই কিন্তু নানান রকম অস্বস্তি, সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মানে, তুমি যদি ঐ জায়গায় নিজেকে ফেলে ভাব তখনই যেন সর্বনাশের পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠে। এই যে ভণ্ডামি, এইটা আমার মধ্যে ভয়াবহ রকম বিতৃষ্ণা তৈরি করছে। এবং বিইং আ মিডল ক্লাস কিংবা বিইং আ উইম্যান তুমি নিজের দিকে ক্যামেরা ঘুরাইতে পারতেছ কিনা কিংবা সেই গাটস তোমার আছে কিনা বা নিজের মায়ের দিকে ক্যামেরা ঘুরাইতে পারতেছ কিনা বা যেরকম ফ্যামিলিতে আমরা বিলং করি সেখানে এইরকম নিষ্পত্তি করার গাটস আসলেই আমাদের ফ্যামিলি রাখে কিনা—আমার কাছে মনে হয় এইটাই অনেক বড় পলিটিক্যাল প্রশ্ন।

এই যে এথিক্সের জায়গা থেকে দ্বন্দ্ব ও সংকট সামলানো এবং অন্য শ্রেণির গল্প দিয়ে সমাজ ও সময় বিচারের খেলায় আরাম বেশি লাগে; পরন্তু, সেই আরাম কেন হারাম হয়ে যায় যখন তুমি নিজের ক্লাসের চোখে চোখ রেখে আলাপ চালাইতে পার না। আমার মনে হয় ওই আলোচনাগুলো অনেক বেশি করা দরকার। এই মুহূর্তে এই আলোচনাগুলো আমাদের এখানে মিসিং।

একজন মুক্ত ফিল্মমেকার হিসেবে টিকে থাকার পিছনে বিভিন্ন ফিল্ম মার্কেট, ফিল্ম বাজার ও ডকল্যাব এ পিচিং একটা জরুরি ঘটনা আপনার জন্য। বাজারে পিচিংয়ের যে কায়দা কানুন এটা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

হুমায়রা: বাজার বা ল্যাবের সুবিধা হলো বিভিন্নরকম প্রডিউসারদের সাথে কথা বলতে পারার সুযোগ। স্বজ্ঞার ভিত্তিতে বিভিন্নরকম স্ট্র্যাটেজি বের করতে হয় এক্ষেত্রে। কথা হচ্ছে এগুলোতো উন্মুক্ত বাজার নয়, বিভিন্ন রকম ক্যাটাগরি আছে তাই না। ওটা বোঝা তো দরকার।

দ্বিতীয় কথা, আমি কী চাচ্ছি বা আমার প্রোডাকশনটা কোন পর্যায়ে আছে, সেটার ব্যাপারে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। পুরো ব্যাপারটা যে আমাদের চয়েজের উপর বসে আছে ব্যাপারটা এমন না। মানে, আমি চাচ্ছি বাজারে যেতে, বাজারে চলে গেলাম। ব্যাপারটা তো ওরকম না আসলে। যেমন, আমি যখন গোয়া ফিল্ম বাজার-এ গেছি তখন বাগানিয়ার কাজটা যেহেতু শেষ হয়ে গেছিল, তো ওইটা ওইসময় ভিউয়িং রুমে ছিল। কারণ, ভিউয়িং রুমে সেসব কাজগুলো প্রদর্শনের জন্য রাখা হয় যেসব প্রজেক্ট হয় বানানো শেষ বা পোস্ট-প্রোডাকশন পর্যায়ে আছে।

তো আমার কাছে মনে হইছে বাগানিয়ার কাজ যেহেতু শেষ হয়ে গেছে, এটা এখন ভিউয়িং রুমে যেতেই পারে। আবার ধর যে, বিলকিস এবং বিলকিস যখন প্রি-প্রোডাকশন পর্যায়ে ছিল তখন ফারদার ডেভেলপমেন্ট এর জন্য বার্লিন ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসে অ্যাপ্লাই করেছি।

ট্যালেন্ট ক্যাম্পাস বল বা ডকল্যাব বল কোনোটা থেকে ফান্ড পাওয়া যায় না, কিন্তু বিভিন্ন রকম সুযোগ সৃষ্টির রাস্তায় উঠানো যায় প্রজেক্টটাকে। আমার কী প্রয়োজন এটা অনুযায়ী আমি ডিসাইড করি কোন বাজারে গেলে সেটা আমাকে হেল্প করতে পারে।

আর এমনিতে তো ধরেন এখন তো মানুষ কথায় কথায় বলতেছে যে ফেস্টিভালের জন্য ছবি বানাচ্ছি। ফেস্টিভালে যাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে, যেখানে নিজের দেশে ছবি দেখানো বা নিজের দেশে ছবি করে বেঁচে থাকাটা এখনো সহজ নয়!!

হুমায়রা: এগুলো খুবই উইয়ার্ড। আমিও শুনছি। আর সবচাইতে বড় কথা যেটা, ফেস্টিভাল তো তোমাকে খাওয়া-পরা দেবে না। আমার মনে হয় যে বিশেষ করে গত দশ বছরে ইয়াংদের মধ্যে একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছে ফেস্টিভালকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার এবং ফেস্টিভালের জন্য ছবি বানানোর। সবচাইতে বড় ফেস্টিভালে গেলেও, তুমি আসলে কী পাচ্ছ—এই ব্যাপারে তুমি ওয়াকিবহাল আছ কিনা। তো আমার কাছে মনে হয় এই জায়গায় নিজের সাথে বোঝাপড়াটা খুব জরুরি

আর একটা ফিল্ম মানে জীবন, যাপন, করণ—সবমিলায় একটা লম্বা জার্নি। আমার প্রথম কথা হলো আমি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, কনসিস্টেন্সি বজায় রেখে ছবি করে যেতে পারছি কিনা। এটা আমার কাছে প্রথম প্রশ্ন। এবং টিকে থাকার সাথে সাথে আমার একটা সিগনেচার অ্যাস্থেটিকস, পার্টিকুলার পলিটিকস তৈরি হলো কিনা—এই ব্যাপারগুলো যত্ন ও আন্তরিকতার সাথে নজর করা উচিত। তার সাথে অবশ্যই টিকে থাকার প্রশ্নে বড় ফেস্টিভালে অংশগ্রহণের জরুরত তৈরি হয়, নিজের পরিচয় শক্তপোক্ত হবার একটা ব্যাপার যোগ হয়। নিশ্চিতভাবে হেয় হয়। তার মানে এই নয় যে ‘ফেস্টিভাল’ আমার ফিল্মমেকার পরিচয়কে নির্দিষ্ট করে দেবে।

একটা মজার ব্যাপার দেখ, ২০১৪-১৫ তে আই অ্যাম ইয়েট টু সি দিল্লি নির্মাণ করি। আজ ছয় বছর পরেও এখনো এটা কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হচ্ছে। তো আমার কাছে ওটাই মনে হয় যে, একটা ফিল্মের লাইফ কিন্তু অনেক লম্বা। এবং এটা নিয়ে কতটা ডিসকাশন হলো, বা কতটা কথা সোসাইটিতে তুমি বলতে পারছ বা দর্শককে ইনভলভ করতে পারছ এটা অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। এবং অ্যাজ আ ফিল্মমেকার, তোমার জার্নিতে এই ডিসকাশন কতটুকু নতুন বোঝাপড়া যুক্ত করছে সেটা বিবেচনা করা খুব জরুরি।

যাইহোক, এই আলাপ তো শেষ হবার নয়। তবু, পরিসরের খাতিরে আজ মনে হচ্ছে এখানেই ইতি টানতে হবে। ধন্যবাদ রুমু আপু। 

হুমায়রা: খুব ভাল লাগল আজকে কথা বলে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও ভূমিকা: ইমরান ফিরদাউস। চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংস্কৃতিবীক্ষক ও শিল্পসমালোচক বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনিতে স্ক্রিন স্টাডিজে পিএইচডি করছেন।

সহায়:

ফুকো, নিশেন (১৯৭৭)। ট্রান্সগ্রেশন। ল্যাঙ্গুয়েজ, কাউন্টার মেমোরি, প্র্যাকটিস: সিলেক্টেড এসেজ অ্যান্ড ইন্টারভিউজ বাই মিশেল ফুকো, সম্পাদনা: ডি এফ বুচার্ড। নিউইয়র্ক: কর্ণেল  ইউনিভার্সিটি প্রেস।

(সাক্ষাৎকারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত প্রকাশনা ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)

 

Leave a comment