গান্ধিজি সপ্তাহান্তে একদিন নিশ্চুপ থাকতেন। বিরত থাকতেন কারো সাথে কোনো রকমের বাক্যালাপ থেকে। পারসোনা (১৯৬৬) চলচ্চিত্রের এলিজাবেথ ভোগলার যেমনটা পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে থাকতে চেয়েছেন, কথা না বলে। জাগতিক যোগাযোগ থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন থেকে। নিশ্চুপ থেকে অগোচরে সমস্ত কিছু অবলোকন করে। যোগাযোগের যে গাঢ় ভার তা বহন করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন। ‘না, এটা করো না’—গরম পানি ছুড়ে মারতে উদ্যত আলমাকে তিনি বলেছিলেন—যা পুরো চলচ্চিত্রে তার একমাত্র সংলাপ। যেন তিনি সমস্ত ব্যাথার অনুভব থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। আলমার সাথে সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা থেকে তার এই নীরবতা বা শারীরিক ব্যথানুভবই তীব্রতর।
তিনি আলমাকে অনুরোধ করেছেন যেন তাকে শারীরিক যন্ত্রণা না দেয়, কিন্তু আলমাই বা কে? আলমা কি তার পরিচর্যাকারি নার্স নাকি সেই বরং রোগী কিংবা অন্য কিছু? সে কি এলিজাবেথের ভেতরকার কিছু? তার অন্তর্গত সত্তা?
এলিজাবেথ একজন অভিনেত্রী। পর্দার সামনে তাকে নানা চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। যেরকম অভিনয় আমাদের প্রতিনিয়ত করে যেতে হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমাদের ভেতরকার অস্তিত্বশীল সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘Persona’ শব্দটির ল্যাটিন অর্থ ‘Mask’ অর্থাৎ মুখোশ—যা এলিজাবেথকে পর্দায় নিয়তই পাল্টাতে ও ধারণ করতে হয়। যেকোনো মানুষকেই সামাজিক অস্তিত্বের প্রয়োজনে মুখোশ ধারণ করতে হয়। ফলে মুখোশের ভেতরকার সত্তার বেদন, নিগ্রহ, নির্যাতন থাকে অব্যক্ত। ব্যক্তির অবদমিত ও অব্যক্ত সকল আকাঙ্ক্ষা পরিত্যক্ত হয় সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিপার্শ্বের দ্বারা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, যৌনতার মুক্ত বিচরণ বাধাপ্রাপ্ত হয় সামাজিক চুক্তিতে। কিন্তু সকলের সম্মুখে এই সমস্ত নিয়ম গ্রহণ করতে হয় স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে। ক্লান্তিকর এই অভিনয় আমাদের সামাজিক চরিত্রের অন্যতম অংশ।
এলিজাবেথের এই অবদমিত বেদনার অব্যক্ত সমস্ত কথাই আমরা আলমার আলাপে খুঁজে পাই। এলিজাবেথ মা হতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাকে হতে হয় কিন্তু অন্যদিকে আলমা গর্ভপাত করে (যদিও তা নিয়ে সে অনুতপ্ত)। আলমার বাচালতা যেন এলিজাবেথেরই অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার ভাষা। যেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী এলিজাবেথ ভোগলার এমনতর সাধারণ জীবনই যাপন করতে চেয়েছিলেন বা চান। এতোটাই উশৃঙ্খল, সরল ও সাধারণ যে অনায়াসে সমুদ্রের কিনারায় বসে অচেনা এক বালকের সাথে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়া যায়। আলমার বিভিন্ন কথাবার্তা এতটাই অসংলগ্ন মনে হয় যে একপর্যায়ে দ্বন্দ্বে পড়তে হয় আলমাই মূলত রোগী কি না? নাকি আলমা এলিজাবেথের না বলা কথা বলে দিচ্ছে?
তার আকাঙ্ক্ষাকে যেমন আলমার ভেতর দিয়ে প্রকাশ হতে দেখি, তেমনি অনুশোচনা ও অনুতাপের কাঠগড়ায় নিজেকে আলমার মুখোমুখি দাড় করাতেও দেখি। পরবর্তীতে মি. ভোগলার যখন আলমাকে কাছে টেনে নেয় তখন প্রথমে সে এলিজাবেথ নয় বলে ইতস্তত বোধ করলেও পরক্ষণেই তাকে সমর্পিত হতে দেখি। এরপর তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতো আলাপ চলতে দেখি।
পরিচালক ইংমার বার্গম্যান পারসোনা ছবিটি নির্মাণের সময় নিয়ে তার আত্মজীবনি ‘দ্য ম্যাজিক ল্যান্টার্ন’-এ লেখেন—
“ … দুজন নারীকে নিয়ে লেখা একটি সিনেমা প্রস্তাব করলাম…গল্পটি ছিলো—বড় হ্যাট পরা দুজন নারী সাগর কিনারায় বসে একে অন্যের হাত নিয়ে পর্যালোচনায় মগ্ন…তাদের একজন আমার মতো নিশ্চুপ, আরেকজন বাকপটু, গায়েপড়া ও যত্নবান সেটাও অবশ্যি আমারই মতো…”
অর্থাৎ, একই সত্তার ভিন্ন দুটি রূপ। যার একটি খোলসযুক্ত, মুখোশ পরিহিত, জাগতিক অন্যটি অত্যন্ত সস্নেহে গোপন, শৃঙ্খলহীন। এলিজাবেথ নীরব-নিশ্চুপ কিন্তু তার কারণ মানসিক বা শারীরিক নয়। চিকিৎসক তাকে উভয় ক্ষেত্রেই সুস্থ ঘোষণা করেন। তার এই নির্বিকারত্ব কোনো রোগ নয় বরং জগতের সমস্ত মানবিক বিপর্যয় ও অধঃপতনেরই প্রতিক্রিয়া। পৃথিবীজুড়ে ঘটতে থাকা যুদ্ধসমূহ যেসবের অমানবিকতার দৃশ্য চাক্ষুষমান হলে, বিবরণ শ্রবণ করলে নির্বিকার ভিন্ন কিছুই করার থাকে না। সমস্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যখন ব্যর্থ হয়ে যায় তখন পৈশাচিকতার বিপরীতে থাকে শুধু নীরব দেখে চলা। এ নীরবতা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রাস্তায় জনসম্মুখে দগ্ধ হতে থাকা বুদ্ধ ভিক্ষুর জলন্ত দেহ দেখার প্রতিক্রিয়া। এ নীরবতা বন্দুকের নলের সামনে অজস্র ইহুদি নারী ও শিশুর অপেক্ষার আর্তনাদের প্রতিক্রিয়া। এলিজাবেথ টিভিতে দেখতে থাকে সেই জ্বলন্ত লাশের দৃশ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি নারী ও শিশুর ছবি আলোর সামনে বারবার নেড়েচেড়ে। এমনতর বিপর্যয়ে, রাষ্ট্রের এহেন নগ্নরূপে, মানবিকতার নিকৃষ্টতর স্খলনে নিজ আত্মার সাথে কথোপকথন ব্যতীত আর কোনো পথ খোলা থাকে না। আর এই আপন অন্তঃস্থলই হচ্ছে ‘আলমা’। বলে রাখা ভাল ‘Alma’ শব্দের স্প্যানিশ অর্থ ‘Spirit’ আর ইতালিয়ান অর্থ ‘Soul’।
পর্দার বিভিন্ন দৃশ্যে এলিজাবেথকে আলমার সাথে খুবই কাছাকাছি অবস্থানে দেখি—যেন তারা মিশে যাচ্ছে একে অন্যের সাথে। অঙ্গভঙ্গিতে, আবেদনে, কামনায় যেন তারা একই সত্তা। শেষদিকে আরো পরিষ্কার রূপ দেখতে পাই একটি দৃশ্যে, দুজনের মুখাবয়বের সংমিশ্রণে। এলিজাবেথের মুখের ক্লোজ শটের পাশাপাশি আলমার মুখ ভাসতে দেখি। এক পর্যায়ে এলিজাবেথ আর আলমার মুখ আধা-আধি মিশে একটি মুখাবয়বে পরিণত হয়। যেন তারা একক অভিন্ন সত্তা।
অজস্র ক্লান্তি আর বেদনাবিভোর সত্তা এলিজাবেথ ভোগলার। রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি—সমস্ত পর্যায়ে সে তাড়িত। সন্তানের সাথে অন্যায়-অত্যাচারের পীড়ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, যে সন্তানকে সে জন্মগ্রহণের পূর্বেই হত্যা করতে চেয়েছে। জ্বলতে থাকা লাশের দৃশ্যের বিপরীতে নির্বিকারত্বের পীড়ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। জনপ্রিয়তার বিপরীতে স্বরূপ উন্মোচন করতে না পারার অবদমন তো আছেই। সমস্তকিছুর বিপরীতে সে খুঁজে নেয় আত্মার আশ্রয়। নিজেরই অপর একটি সত্তা। যার কোনো বাঁধা নেই চপলতায়, অনর্গল কথা বলায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিংবা স্বাধীনতায়। আর তাই হচ্ছে ‘আলমা’। যে আলমা’র একমাত্র মনোযোগী শ্রোতা এলিজাবেথ। সকল সাধনাতেই নিজের সাথে যোগাযোগের জন্য প্রথমে নিশ্চুপ হতে হয়। আর তাই যেন নিশ্চুপ থেকে নিজের সাথেই নিজের গভীরতর যোগাযোগ করছে এলিজাবেথ। যেন কোনো ধ্যান। যে ধ্যান স্বরূপ উপলব্ধির।
শব্দ দিয়ে যেকোনো অনুভূতির ব্যাখ্যাদান মাত্রই স্থুল চেষ্টা। চলচ্চিত্রের রয়েছে অনুভবের শক্তি। এসব ব্যাখ্যার চাইতে অনুভবের ভাব পবিত্র। পারসোনা চলচ্চিত্রেরও চরিত্রসমূহের ভেদ-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের চাইতে তাদের অন্তর্গত যাত্রা ও মনোবীজই মূল। দর্শকেরও উচিত যেকোনো ব্যাখ্যা বিস্মৃত হয়ে পুনঃসার অন্বেষণ করা। চলচ্চিত্রটির দৃশ্যের সংকলন, ঐকতান, কাব্যময়তা ও চরিত্রগুলোর অভিব্যক্তি অনুভব করা। স্বয়ং বার্গম্যানের একটি কথা দিয়ে এ আলোচনা শেষ করা উচিত—
“…নিছকই বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো চলচ্চিত্র আমি বানাতে চাই না। আমি চাই দর্শকের অনুভবশীলতা, ইন্দ্রিয়গোচরতা। চলচ্চিত্র বোঝার চাইতে এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।…”
শিবলুল হক শোভন
২য় বর্ষ, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।