ভাষান্তর ও সম্পাদনা: ফারিহা যাহিন বিভা
১৮৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক দুপুরে তুরিনের পিয়াৎজা কার্লো আলবের্তোর ছয় নম্বর দরজা দিয়ে বের হয়েছিলেন নিৎশে; হয়তো দিকভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে, হয়তোবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে!
সেদিন পিয়াৎজা কার্লো আলবের্তোর সামনে হয়তোবা গুসেপ্পি বা ইতর বা কার্লো নামের এক গাড়োয়ান তার একগুঁয়ে ঘোড়াটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কোনো এক অজানা কারণে ঘোড়াটি গো ধরে ছিল। এক পর্যায়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। উদ্যত চাবুক এসে কামড় বসায় পশুটির ত্বকে। এই দৃশ্য দেখে কোমলমতি দার্শনিক শিশু নিৎশে, ঘোড়াটির গলা জড়িয়ে ধরে পড়ে গিয়েছিলেন। ঘটনাটির পর নিৎশে বেশ অসুস্থ হয়ে যান। টানা দুইদিন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে ছিলেন। এরপর নিৎশের মুখে প্রথম যে বাক্য উচ্চারিত হয়েছিল তা হলো, “হায় জননী , কী নির্বোধ আমি !”
সেদিন পিয়াৎজা কার্লো আলবের্তোর সামনে গাড়োয়ান যখন তার চাবুক দিয়ে একরোখা ঘোড়াটির ত্বকে কামড় বসাচ্ছিলো, বোবা প্রাণীটির বেদনায় নিৎশে প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু এই দুঃখ কি শুধু সেই ঘোড়াটির জন্যই ছিল নাকি এই দুঃখ সমগ্র দুনিয়ার সব অন্যায় অবিচার হতাশা আর ঈশ্বরের সব জেনেও চুপ করে থাকার বিরুদ্ধে?
কিন্তু সেই ঘটনার পর ঘোড়াটির কি হয়েছিল? এমন এক দার্শনিক শূন্যতা নিয়ে সিনেমাটি; দ্য তুরিন হর্স। পোড়খাওয়া চামড়ার পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক বৃদ্ধ গাড়োয়ান তার বৃদ্ধ বিষণ্ণ বিশালাকার ঘোড়াটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এই ঘোড়াটি হয়তো নিৎশের সেই ঘোড়া নয়, এই গাড়োয়ানও সেই গাড়োয়ান নয় আমরা জানি। কিন্তু হয়তো সেই ঘোড়া বা গাড়োয়ানের সাথে সিনেমায় এই পোড়খাওয়া চামড়ার পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ আর তার ঘোড়াটির কোনো অদৃশ্য সাদৃশ্য বিদ্যমান। হয়তো এই চরিত্ররা সকলেই সমানভাবে অত্যাচারিত।
দুনিয়া যেমন সৃষ্টি হয়েছিল ছয় দিনে ঠিক তেমনই ছয়টি দিনের বিবরণ এই সিনেমায়। বৃদ্ধ গাড়োয়ান আর তার ফ্যাঁকাসে মেয়েটি সিদ্ধ আলুর খোসা ছাড়ায়, ঘোড়াকে খাবার দেয়, কাঠ কেটে আনে, পাতকুয়ো থেকে পানি তুলে আনে। কিন্তু প্রতিদিনই একটু একটু করে অবনতি হয় সবকিছুর। বুনো হিংস্র ঝড় বাড়তেই থাকে, আহার গ্রহণ বন্ধ করে বৃদ্ধ ঘোড়াটি, কোনো ভাবেই বৃদ্ধ তার মেয়েকে নিয়ে শহরে যেতে পারে না, যদিও ঘটনাক্রমে শোনা যায় শহরও ধ্বংস হয়ে গেছে। কুয়োর পানি শেষ হয়ে যায় আর শেষদিন সকাল হয় না, সূর্য ওঠে না, ফুরিয়ে আসে লন্ঠনের গ্যাস।
সিনেমাজুড়ে বারবার ফিরে আসে বিষণ্ণ বৃদ্ধ ঘোড়াটি। কেমন স্থির, কেমন অসাড় হয়ে যায় সে! সে চলছে না,কিছু খাচ্ছে না। নিশ্চিত এক পরিণতির জন্য যেন সে অপেক্ষা করে আছে…!
বেলা তার একজন কবি, একজন দার্শনিক আর তার প্রকাশের মাধ্যম সিনেমা। অত্যন্ত ধীরগতির দার্শনিক ঘরানার চলচ্চিত্রকে হাঙ্গেরিয় এই নির্মাতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে শনাক্ত করা যায়। লম্বা শট, ধীর কম্পন, ধীর মুভমেন্ট এসব মিলিয়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ তিনি নির্মাণ করেন, মানবজীবনের যেসব নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্রগুলোর মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব যেভাবে তিনি তুলে আনেন, সেই কবিতার দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো সম্ভব না। সর্বশেষ সিনেমা দ্য তুরিন হর্স আর বেলা তার-এর চলচ্চিত্র ভাবনা নিয়ে নিম্নোক্ত এই সাক্ষাৎকারটি The East European Film Bulletin ম্যাগাজিন থেকে নেয়া।
সাক্ষাৎকার
১৮৮৯ সালের ৩রা জানুয়ারি তোরিনোতে, পিয়াৎজা কার্লো আলবের্তোর সামনে একটি ঘটনাটির পর নিৎশে বেশ অসুস্থ হয়ে যান। কোনোদিন সেই অবস্থা থেকে পুরোপুরি উত্তরণ ঘটেনি। আপনার সিনেমা দ্য তুরিন হর্স (২০১১) ঠিক এই ঘটনাটি স্মরণ করেই শুরু! সিনেমার বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিৎশের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কী ? তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা যা তাকে মানসিক ভারসাম্যর দিকে ঠেলে দেয় , সেই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
বেলা তার: আমার এই চলচ্চিত্রটির চিন্তা ভাবনা খুব সরল। আমরা একটা প্রশ্নকে ঘিরে গল্পটা বানিয়েছিলাম, সেটি হলো—ঘটনাটির পর সেই ঘোড়াটার কী হলো! আর নিৎশের সম্পৃক্ততার বিষয়ে বলতে হলে বলবো যে, যদিও সিনেমাটি নিৎশেকে নিয়ে নয়; তবে এই ঘটনার ছায়া পুরো সিনেমাটি জুড়েই আছে।
আপনার অধিকাংশ সিনেমাই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বানানো। এবার কেন আপনার ভিন্ন সময়ের গল্প বলতে ইচ্ছে হলো?
বেলা তার: আমার কোনো সিনেমাই নির্দিষ্ট কোনো সময়ের ভেতর আবদ্ধ না। তেমন এই সিনেমাটাও না। তবে এর সাথে ১৮৮৯ সালের একটি যোগসূত্র আছে, আর তার একমাত্র কারণ হলো ফ্রেডরিক নিৎশে।
নিৎশের লেখায় নান্দনিকতা এবং শিল্প—এই ধারণাদ্বয় বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। তার মতে, শিল্প হলো অনুভূতির নান্দনিক প্রকাশ। আপনি কি এ ব্যাপারে নিৎশের সঙ্গে একমত হবেন যে—শিল্পের মাঝে বার্তা খুঁজতে যাওয়াটা আসলেই ভুল?
বেলা তার: আসলে আমার সিনেমা কোনো মেসেজ দিতে চায় না। ক্যামেরা হলো একটা চোখ। আশপাশে যা ঘটে তাই দেখে। আর সে অনুযায়ী জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখায়। দর্শকদের আমি কোনো মেসেজ দিতে চাই না বরং আমার কাছে দুনিয়াটা যেমন তাই দেখাই। ক্যামেরার নিজের একটা দেখার চোখ আছে। সেই চোখ সামনে যা আছে তাই দেখে। সাহিত্য আর সিনেমা এই দুটিকে এখানেই আলাদা করা যায়। সাহিত্যে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারবেন কিন্তু ক্যামেরা তাই দেখাবে যা এর সামনে চলছে।
লেন্স দিয়ে আপনি কি দেখাবেন সেটা তো একান্তই আপনার ব্যাপার ?
বেলা তার: তা ঠিক। কারণ আমরা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাই না। আমরা গল্পের মতো করে একটা আয়না বানাই যার দিকে তাকালে জীবন দেখা যায়।
আপনি আপনার সিনেমার দৃশ্যায়নে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পছন্দ করেন? নিৎশের মতে, শিল্প হলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আর স্বতঃস্ফূর্ততার সংমিশ্রণ। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
বেলা তার: আমি আসলে প্ল্যান ছাড়া কিছু বানাই না। সিনেমায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী কী হবে সবকিছু আগে থেকেই আমার মাথায় থাকে, চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। স্ক্রিপ্ট নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকে তাই আমি জানি, আমার কী ধরনের অভিনয়শিল্পী প্রয়োজন; সেট কীরকম চাই। যদি কিছু পরিবর্তন করি তা কেবল আমার অভিনয়শিল্পীদের সুবিধার্থে—যেন তারা স্বাভাবিক ও সাবলীল হতে পারে। কিন্তু তাছাড়া আমি আমার ক্যামেরার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখি।
আপনার যদিও সব পূর্বপরিকল্পিত থাকে—এডিটিংয়ের উপর তাহলে আপনার নির্ভরশীলতা কতটুকু?
বেলা তার: খুব কম। শুট করার সময় আমার এডিটর সেটেই থাকে এবং প্রোডাকশনের দিকে নজর রাখে।
আর স্ক্রিপ্টের উপর? আপনি লাসলো ক্রাশ্নাহোরকাই এর সাথেই বারবার কাজ করেন; দ্য তুরিন হর্স–এও তিনি আছেন। উনার লেখার কি কোনো আলাদা প্রভাব থাকে আপনার সিনেমার ভিজ্যুয়ালে?
বেলা তার: ঠিক তা নয়। লাসলোর কাজ হলো লেখালেখি করা, আমার কাজ হলো দেখানো। ওর লেখা সাহিত্যটাকেই আমি সিনেমার ভাষায় রূপান্তরিত করি। আমি আমার মতো করেই আমার সিনেম্যাটিক ভাষায় ছবি বানাই। সঠিক দৃশ্য বাছাইয়ে এবং ছবির ইমোশনটাকে গাইড করতে ওর লেখা স্ক্রিপ্ট অবশ্যই আমাকে সাহায্য করে।
দ্য তুরিন হর্স-এর আইডিয়া কী করে পেলেন?
বেলা তার: সাধারণত, লাসলো আর আমি একসাথে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি; আর সেখান থেকেই অনেক রকম আইডিয়া বের হয়ে আসে। এরপর সেই আইডিয়া আমরা লিখে রাখি আর আলোচনা করে ডেভেলপ করতে থাকি। কিন্তু দ্য তুরিন হর্স ভিন্ন ছিল। ও যেভাবে লিখেছে, সেটিকে আসলে স্ক্রিপ্ট না বলে, গল্প বলা উচিত।লাসলো নিৎশের ঘোড়াটি নিয়ে একটা গল্প লিখেছিল। গল্পের শেষে সে একটা প্রশ্ন করে- যে প্রশ্নটা ঘিরেই আমাদের ছবিটা, ঘোড়াটার কী হয়েছিল এ ঘটনার পর। পুরো ছবি জুড়ে আমরা এর কাল্পনিক উত্তর বের করার চেষ্টা করেছি।
এই ছবির মুক্তির জন্য বার বার তারিখ পেছানো হয়েছে। কী সমস্যা হয়েছিল?
বেলা তার: লোকেশন আর আবহাওয়ার জন্যে। ছবিতে মূলত আমরা ছয়দিনের গল্প বলেছি আর প্রতিদিনই আমাদের একই রকম ওয়েদার দরকার ছিল শ্যুটের জন্য। একারণে বারবার আমাদের শ্যুট পেছাতে হয়েছে।
এসব ঝামেলার কারণে গল্পে কোন পরিবর্তন এসেছে কি?
বেলা তার: না, এগুলো তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি গল্পে।
আপনি নতুন অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার জন্য বিখ্যাত। অভিনয়ের ব্যাপারে আপনার ভাবনা কী?
বেলা তার: আমার মতে তারা আসলে অভিনয় করেনা। আমি তাদের নাটকীয়তা বাদ দিয়ে সৎ থাকতে বলি। ডিরেক্টর হিসাবে আমার কাজ হলো এই সৎ থাকার আবহটা তৈরি করা। আবহটা তৈরি করতে পারলেই বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা আর একজন ফ্যাক্টরিতে কাজ করা মহিলাও একসাথে কাজ করতে পারে। কারণ তারা নিজেদের একই পরিস্থিতিতে সাঁতার কাটা দুটো মাছ ভাবে। একে অপরের ভাব বোঝে আর এতেই ছবিটা জ্যান্ত হয়।
আপনি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আপনি চান না- দর্শক আপনার সিনেমা দেখার সময় বেশি মাথা খাটাক। আপনার কি মনে হয় না, আপনার কাজের জন্য সমালোচনা প্রয়োজন?
বেলা তার: সিনেমা নিয়ে লেখালেখি করা তো আর আমার কাজ না। আমার সিনেমা দেখতে কারো কারো ভালো লাগে আবার কারো ভালো না লাগলে সেটাও গ্রহণ করা লাগে। কিন্তু আমি কারো মতামত বা চিন্তাভাবনার উপর কোন প্রভাব ফেলতে চাই না। সিনেমা হলে আলো জ্বলার সাথেসাথেই আমার কাজ শেষ। এরপর কে কীভাবে নিবে, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
আপনার সিনেমায় আপনি দর্শকদের কী দেখাতে চান?
বেলা তার: আমি দর্শকদের মানুষ দেখাতে চাই। হয় কি যে, আমাদের অনেক কিছু করার সামর্থ্য থাকলেও- সমাজ আর পরিপার্শ্বের কারণে কিছুই করতে পারি না। আমি দেখাতে চাই, আমাদের প্রত্যেকেরই যথাযথ মর্যাদা পাওয়ার এবং সুখী জীবন যাপনের অধিকার আছে। এই পৃথিবীতে যদিও সব মানুষের তা পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই কিন্তু আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা প্রত্যেকেই এক, সবার অধিকার সমান।
আপনি সবসময় মূলধারার সিনেমার কঠিন সমালোচনা করেন। কেন?
বেলা তার: এই সিনেমাগুলো সব একইরকম- একশান, কাট, একশান, কাট। এই সিনেমাগুলোতে গল্প ধরে ধরে এগোলেই সিনেমা হয়ে যাবে- এমনটা ভাবে তারা। কিন্তু, খালি মূল চরিত্র কী করছে- সেটাই গল্প না; সবকিছুই গল্প হতে পারে। পিছনে একটা মানুষ অপেক্ষা করছে- সেটাও একটা গল্প হতে পারে। এমন অনেক কিছুই আছে, যা আমাদের বাস্তব জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু ফিল্মমেকারদের কাছে তা বোরিং। আমার কাছে ওসব বোরিং লাগে না। আমার ছবিতে আমি জীবনের যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা করি।
আপনি কি নিজেকে হাঙ্গেরিয়ান সিনেমার অংশ মনে করেন?
বেলা তার: অবশ্যই। আমি একজন হাঙ্গেরিয়ান; হাঙ্গেরির জন্য কিছু করতে পেরেছি- ভাবতেই ভালো লাগে আমার। তবে আমি হাঙ্গেরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অংশ হতে চাই না। আমি সবসময় ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করি।
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)