ষাটের দশকের জাপানের উত্তাল রাজপথ, প্রায় সাত বছরের পশ্চিমা দাসত্বের পর বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার দেখা মিলেছে (অন্তত কাগজে কলমে)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে জাপানের অর্থনীতির তখন নাজেহাল অবস্থা। ভাঙা অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য এক দিকে শুরু হয় ক্রমাগত শিল্পায়ন ও আধুনিকায়ন, অপরদিকে সাথে সাথে বাড়তে থাকে সামাজিক বৈষম্য; তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করতে থাকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ। এমনই এক প্রেক্ষাপটে শুজি তেরাইয়ামা তার চিরাচরিত বিক্ষিপ্ত ঢঙে গল্প বলে নব্য-উদারবাদী জাপানের গণমানুষের, গল্প বলে দরিদ্র এক কিশোরের জীবন সম্পর্কে মোহভঙ্গের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানি নতুন ধারার চলচ্চিত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী অথচ অবাধ্য নির্মাতাদের মধ্যে শুজি তেরাইয়ামা অন্যতম। তেরাইয়ামার এক্সপেরিমেন্টাল ধাঁচের চলচ্চিত্র অনেক ক্ষেত্রে আভা গার্দিস্ট সিনেমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও বটে। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃত শিল্প সৃষ্টির জন্য প্রথমে বিদ্যমান কাঠামো থেকে বের হয়ে আসাটা প্রয়োজন। ফলে তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রই অপ্রচলিত এবং এক্সপেরিমেন্টাল ধাঁচের। থ্রো আওয়ে ইউর বুকস, র্যালি ইন দ্য স্ট্রিটস (১৯৭১) ও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিক্ষিপ্ত ও পরাবাস্তব এই সিনেমাটির প্লট সংক্রান্ত আলোচনা কিছুটা কষ্টকর। নন লিনিয়ার চলচ্চিত্রটিতে রয়েছে বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের দৃশ্য, পর্দায় কবিতা ও স্থিরচিত্রের ব্যবহার, একাধিক বেনামী চরিত্রের কথোপকথনের দৃশ্য। ফলে গতানুগতিক ধারায় প্লট পর্যালোচনা করে বিশ্লেষণ দাঁড় করানো প্রায় অসম্ভব এবং অনেক সমালোচকের মতে তার প্রয়োজনও নেই। থ্রো আওয়ে ইউর বুকস, র্যালি ইন দ্য স্ট্রিটস শুরু হয় অন্ধকার ঘরে প্রধান চরিত্রের মনোলগ এর মধ্য দিয়ে। সিনেমার মূল চরিত্র কিশোর কিতাগাওয়া এইমেই জীবন নিয়ে স্বগতোক্তি করে। পুরো সিনেমা জুড়ে অর্থবহ জীবনের আশায় সে তার দারিদ্র্য, ছেলেবেলা আর সামাজিক পিছুটানকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। নিজ দেশের একঘেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর জীবন ছেড়ে আধুনিক আমেরিকায় পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখে। এইমেই এর কিছুটা বিপরীত চরিত্র ফুটবল দলের নেতা ওমি, সামাজিকভাবে সফল, আধুনিক, আমেরিকান সংস্কৃতি ও আদর্শে চালিত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। পুরো সিনেমাজুড়ে মূল চরিত্র তাকে অনুসরণ করে সফলতার আশায়। এইমেই এর বিশৃঙ্খল পরিবারের মধ্যে রয়েছে বার্ধক্যের ভারে পাগল প্রায় দাদী, বিকারগ্রস্ত বোন ও বিকৃত মানসিকতার বাবা।
অসংলগ্ন ও উদ্দেশ্যহীন চলচ্চিত্রটিকে বিনোদন বা শিল্পের যেকোনোটি হিসেবেই গণ্য করা যায় কিনা সেই ব্যাপারে অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকই সন্দেহ পোষণ করেন। খাপছাড়া জীবনের বর্বরতার অস্তিত্ব ঘোষণা করাই যেন সিনেমাটির একমাত্র উদ্দেশ্য। সাংবাদিক ইউয়েন গ্লিডোর ছবিটি সম্পর্কে বলেন “শিল্প যা সে সময়ে নিঃসন্দেহে বিপ্লবী ছিল, কিন্তু বর্তমান সময়ের হিসেবে যার সূক্ষ্মতা এবং কাঠামোর অভাব রয়েছে।” ঠিক এই বৈশিষ্ট্যটির জন্যই কিছু বিশেষ মহলে ছবিটি সমাদৃত। নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্রে সাধারণত দর্শকদের আদর্শিকভাবে প্রভাবিত করার যে প্রবণতা দেখা যায় তেরাইয়ামা তাকে বর্জন করে সাবজেক্টিভিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। জাপানি নব্য বাম রাজনৈতিক আদর্শ অনুসারে সিনেমার মাধ্যমে ভাবাদর্শ প্রচারের পরিবর্তে দৈনন্দিন জীবনের বিক্ষিপ্ত কিন্তু বাস্তব চিত্র উপস্থাপন এবং দর্শকের চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাঝেই তেরাইয়ামার চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত সাফল্য নিহিত। তার নিজ ভাষ্যমতে যাকে বলা যায়, “রাজনীতির আশ্রয় না নিয়ে বাস্তব জীবনে বিপ্লব সাধন”।
নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্রে সাধারণত দর্শকদের আদর্শিকভাবে প্রভাবিত করার যে প্রবণতা দেখা যায় তেরাইয়ামা তাকে বর্জন করে সাবজেক্টিভিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানে সক্রিয়ভাবে আমেরিকান সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে শুরু করে মিডিয়া ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আমেরিকার ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রগতিশীল সংস্কৃতি জাপানি সমাজে ছড়িয়ে দিতে থাকে। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রাথমিক টার্গেট সাধারণত মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শহুরে জনগণ। বিশেষ এই জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রাথমিক ভোক্তা হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে ভিনদেশী সংস্কৃতি গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। সিনেমায় এই বিশেষ জনপদের প্রতিনিধিত্ব করে ওমি চরিত্রটি। প্রগতিশীল এই চরিত্রটির তীব্র পুরুষতান্ত্রিক আচরণ দর্শকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন এইমেই এর বোনের গণধর্ষণে সে অংশগ্রহণ করে। ওমির চরিত্রটির মধ্য দিয়ে পরিচালক প্রগতির সার্বজনীন কল্যাণময়তার ধারণাকে অস্বীকার করেন। পরস্পরবিরোধী ভাবাদর্শ পর্দায় উপস্থাপনের মাধ্যমে একদিকে সিনেমাটিতে একপ্রকার নিষ্ক্রিয়তা বজায় রাখেন। অপরদিকে ডকুমেন্টারি ধাঁচের বিভিন্ন দৃশ্য যোগ করার মাধ্যমে দর্শকদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের রাস্তা খুলে দেন।
অপরদিকে, নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের মাঝে সামাজিক পরিবর্তন আসে কিছুটা ভিন্নভাবে। সিনেমার অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এই সাধারণ কর্মজীবী মানুষ। বিভিন্ন দৃশ্যে যৌনকর্মীদের কিংবা নিঃসঙ্গ পুরুষদের ইন্টারভিউর চিত্রে তাদের সাথে দর্শকদের পরিচয় ঘটে। তাদের অধিকাংশই আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে অসচেতন, যুক্তিতর্ক বা আদর্শের বদলে কামনা-বাসনা দ্বারা পরিচালিত এবং যেকোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে আদর্শিকভাবে বিবেচনার পরিবর্তে ব্যক্তিগত লাভ ক্ষতি বা সামাজিক প্রভাবের উপর ভিত্তি করে বিবেচনা করে থাকে। একটি দৃশ্যে রেস্তোরাঁয় জনৈক কবি এক মধ্যবয়স্ক মহিলার জন্য কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। কবিতার প্রতি প্রচণ্ড অনাগ্রহে মহিলাটি ঘুমিয়ে পড়েন। ৬৬ পরবর্তী রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল জাপানের পটভূমিতে ‘অরাজনৈতিক’ গণমানুষের এই চিত্র বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও বৃহত্তর শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনের তীক্ষ্ণ পার্থক্য দর্শকদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে। অথচ রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে দলগুলো বাস্তবতার এই চিত্র বিবেচনা করে না। বিভিন্ন দৃশ্যে এই ন্যারেটিভটি স্পষ্ট করে তোলার মধ্য দিয়ে তেরাইয়ামা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির যে সমালোচনা দাঁড় করান তা জাপানি নব্য বাম আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
যুদ্ধ পরবর্তী জাপানে চিরায়ত মূল্যবোধের পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোতেও আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তেরাইয়ামার এই সিনেমায়। কাহিনির এক পর্যায়ে এইমেই এর দাদিকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর জন্য তার ছেলে একজন ধর্ম যাজককে বাসায় নিয়ে আসে। আধুনিক মূল্যবোধের যাজক মহিলাটিকে প্রভাবিত করার জন্য আমেরিকান সংস্কৃতিতে প্রবীণদের শেষ বয়সে করণীয় সম্পর্কে বুলি ছাড়তে থাকে। ঘটনাটির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের পরিবার ব্যবস্থায় আকস্মিক পরিবর্তন চিত্রিত হয়। ঐতিহ্যবাহী জাপানি সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক একক যৌথ পরিবার ধীরে ধীরে অনু পরিবারে রূপ নেয়।
সিনেমার প্রধান চরিত্র এইমেই মূলত নতুন প্রজন্মের সাধারণ জনগণের আদর্শের প্রতিফলন। জীবনের একঘেয়েমি ও হতাশার জন্য সে দায়ী করে জাপানের সনাতনী সামাজিক কাঠামো, তার নিজ পরিবার ও দারিদ্র্যকে। সে স্বপ্ন দেখে মানব উড়োজাহাজের রূপ নিয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পাড়ি জমানোর। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে। অথচ অস্তিত্ববাদী এই চরিত্রটি ফুটবল দলটির আধুনিকতার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে বারবার ব্যর্থ হয়। জীবনের প্রতিটি স্তরে সে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়। তেরাইয়ামার চলচ্চিত্রের একটি কেন্দ্রীয় থিম তারুণ্যের এই দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ। কৈশোরের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ হলিউডের চলচ্চিত্রেও বেশ প্রচলিত একটি থিম। সাধারণভাবে এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় উঠতি বয়স কিংবা দুই ভিন্ন প্রজন্মের মধ্যকার বোঝাপড়ার অভাবকে। অথচ এই চলচ্চিত্রে তেরাইয়ামা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন কিভাবে পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে এইধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব জন্ম নেয়।
ষাট ও সত্তরের দশকের জাপানে একদিকে নব্য উদীয়মান ভোগবাদ ও পুঁজিবাদ, অপরদিকে চিরায়ত রক্ষণশীলতার ভিড়ে তরুণ সমাজের মাঝে যে দ্বন্দ্বের জন্ম নিয়েছিল তার প্রতিফলনই আমরা দেখি এইমেই এর চরিত্রে। দ্বন্দ্বের পাশাপাশি জন্ম নেয় জীবন সম্পর্কে হতাশা। অস্তিত্ব সংকটে ভোগা এই সকল তরুণদের অসহায়ত্ব থেকেই জন্ম নেয় একপ্রকার বিপ্লবী চেতনা। সেই চেতনা সকল প্রকার কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা করে, পুনরুদ্ধার করতে চায় চিন্তার স্বাধীনতা ও জীবনের তাৎপর্যকে।
কৈশোরের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ হলিউডের চলচ্চিত্রেও বেশ প্রচলিত একটি থিম। সাধারণভাবে এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় উঠতি বয়স কিংবা দুই ভিন্ন প্রজন্মের মধ্যকার বোঝাপড়ার অভাবকে। অথচ এই চলচ্চিত্রে তেরাইয়ামা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন কিভাবে পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে এইধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব জন্ম নেয়।
এই পর্যায়ে সিনেমাতে তেরাইয়ামা পরস্পরবিরোধী কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে অসচেতন গণমানুষের মাঝে বিপ্লবী চেতনার অস্তিত্ব তবে কি প্রমাণ করে? রণজিৎ গুহর ‘সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ’ এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করলে এক্ষেত্রে দাবি করা যায় যে, সাধারণ জনগণেরও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা অভিজাত বা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির চেতনা থেকে কিছুটা ভিন্ন। ভিন্নতার ফলেই হয়তোবা তাদের রাজনৈতিক চেতনা বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে স্বীকৃত নয়। এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা ও জীবনকে অর্থবহ করে তোলার তীব্র প্রচেষ্টায়।
সিনেমার সর্বশেষ দৃশ্যে নায়ক সরাসরি দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলে। “হলের আলো জ্বালানো মাত্র চলচ্চিত্রের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়”, তার আগ পর্যন্ত সিনেমা এমন একটি কল্পনার জগত তৈরি করে যাতে প্রবেশের মাধ্যমে মানুষ দৈনন্দিন জীবনের কঠোর বাস্তবতাকে সাময়িকভাবে অগ্রাহ্য করতে পারে।
শেখ আনিয়া ফাহমিন
চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ