আমেরিকার ‘স্বাধীন’ সিনেমার বিশেষত্ব হলো এই যে স্বাধীন সিনেমাকাররা কমবেশি সবাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হলিউডের আশীর্বাদপুষ্ট হতে চান বা হয়ে পড়েন। সব সময় মুনাফার ও বিস্তৃতির সুযোগসন্ধানী এই ইন্ডাস্ট্রির নতুন মেধাকে করায়ত্ব করার আকাঙ্ক্ষার যেমন মন্দ দিক আছে তেমনি আছে ভালো দিকও। ‘মন্দ’ দিক হলো নতুন বা উদীয়মান পরিচালকেরা খুব দ্রুতই শিখে যান ইন্ডাস্ট্রির তথা আপামর জনতার মন জয় করা ছবি বানানোর কায়দা-কানুন ও এই বিশাল শিল্পের জন্য মনোরঞ্জক ফর্মুলায় ক্রমশ সজ্জিত হয় তাদের বানানো ‘পণ্য’গুলোর ভালো দিক হলো এই যে, মুনাফার স্বার্থেই হোক না কেন, হলিউডের দীর্ঘ ইতিহাস আছে প্রতিভাকে তার নিজ পরিসরে খেলবার অধিকার দেয়ার। স্ট্যানলি কুব্রিক, মার্টিন স্করসেসি, উডি অ্যালেনসহ হালের কুইন্টিন ট্যারান্টিনো; অনেকেরই হলিউডে নিজস্বতা বজায় রেখে ছবি বানানোর যথেষ্ট নজির আছে। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার সাথে নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির সম্মিলন ঘটাতে তারা পেরেছেন, হলিউড সেই ‘স্বাধীনতা’ তাদের দিয়েছে, অবশ্যই এই শর্তে যে সুদে-আসলে তাদের এইসব আলোকিত খোয়াব যেন তাদের জন্মের কর্জ চুকিয়ে দেয়।
অথচ এমন শিল্পীও আছেন যারা হলিউডের এই প্রবল ক্ষুধার কাছে আগ্রহ নিয়ে সাড়া দেন না, বা দিতে পারেন না। তারা জানেন যে, তারা যা বলতে চান তা দেখতে-শুনতে চাওয়ার বা বুঝতে চাওয়ার মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অথবা গোঁয়ারের মতো এদের কেউ কেউ যেসব মানুষের কথা বলবার-কেউ-নাই এই জাতীয় সাবজেক্টদের নিয়েই ছবি বানাতে চান। কোনো প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা যে এদের নেই তা না, সেটা হয়তো অর্থ দিয়ে পূরণ হবার নয়। বরঞ্চ কান বা বার্লিনে পুরস্কার প্রাপ্তি (যেখান থেকে আবার কারো কারো ক্যারিয়ার ভিন্ন দিকে মোড় নেয়) হয়তো তাদের অন্যতম অভিপ্সা।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ছবি (স্ট্রেঞ্জার দ্যান প্যারাডাইজ, ১৯৮৪) দিয়েই কান-এ বাজিমাত করে দেয়া পরিচালক জিম জারমুশ। সম্ভবত নিজের ছবি বানানোর সাহস আর গোয়ার্তুমি নিয়ে কাজ করে যাওয়া গুটিকয়েক সেই পরিচালকদের মধ্যে একজন, এবং এই গোছের গোঁয়ারদের মধ্যে সিনে জগতে এক নেতাবিশেষ। বড় স্টুডিওর সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করতে নারাজ, কেননা ‘কীভাবে সিনেমা বানাতে হবে’ ব্যবসার খাতিরে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র দাদাগিরি সহ্য করতে রাজি নন জারমুশের মত সিনেমাকারেরা। নিজের গল্প, নিজের মতো করে বলতে পারা, তা যত ছোট পরিসরেই হোক—এই আনন্দের আর স্বাধীনতার থেকে বড় তাদের কাছে কিছু নেই। যে ধরনের গল্প, যে ধরনের দর্শকের জন্য তারা বলতে চান, তাতে উপায়ও থাকে না স্বনির্ভর হওয়া ছাড়া। কিন্তু জারমুশের এই সাহস আমেরিকার ফিল্ম জগতে আবার অভূতপূর্বও নয়। তার পূর্বসূরীদের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে অন্তত তাই জানা যায়।
আমেরিকার স্বাধীন চলচ্চিত্র: প্রথম যুগ
পঞ্চাশের দশক থেকে হলিউড নতুন সব সংকটে পড়ে। বিশ্ববাজারে টেলিভিশনের আগমন বিনোদনের খেলা অনেকটাই বদলে দেয়। দর্শক টেলিভিশনের কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক হলে গিয়ে ছবি দেখা কমিয়ে দিল। যারা দেখত তাদের মধ্যে দেখা যেত অধিকাংশই থাকত টিনেজাররা। দর্শকের রুচি বদলানোর এই ধাক্কার সাথে ছিল নির্মাতাদের বদল। ত্রিশ-চল্লিশ দশকের বিপুল প্রতাপশালী পরিচালকেরা (জন ফোর্ড, হাওয়ার্ড হকস, অরসন ওয়েলস, আলফ্রেড হিচকক) ক্রমে অবসরের দিকে চলে যান, অথবা নতুন দর্শক রুচির সাথে যুঝতে না পেরে তাদের কাজের গুরুত্বও হারাতে থাকে। ষাটের দশকে হিচকক কয়েকটা ভাল কাজ করলেও (সাইকো, দ্য বার্ডজ, মার্নি) শেষের দিকের সিনেমাগুলো আগের মত প্রভাব রাখতে পারে না। জঁরা ফিল্মের প্রতি (ওয়েস্টার্ন, ফ্যামিলি ড্রামা, ক্রাইম, মিউজিকাল) দর্শক-নির্মাতা উভয়েরই আগ্রহ কমে যায়। ফলত স্টুডিও ব্যবস্থা অনেকটাই হুমকির মুখে পড়ে যায়, ছবি নির্মাণের ওপর স্টুডিওর আগের একচ্ছত্র আধিপত্যও আর থাকে না।
এর বিপরীতে ইউরোপে ষাটের দশকে নতুন ধরনের সিনেমার উত্থান ঘটে। বড় স্টুডিওর তোয়াক্কা না করে ফ্রান্স ও ইতালির কিছু নির্মাতা নিজের বা সংগৃহিত টাকায় কম খরচে নিজস্ব গল্প বলার প্রয়াস পায়। ফ্রান্সে জঁ-লুক গদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, জাক রিভেত, এরিক রোমার মিলে শুরু করেন ফরাসি সিনেমার নতুন যুগ। ইতালিতে ফেদেরিকো ফেলিনি আর স্পেনে লুই বুনুয়েলের কাজ একদিকে ব্যক্তিক, অন্যদিকে রাজনৈতিক গল্প বলায় চলচ্চিত্রের পূর্বের প্রতিষ্ঠিত কোডগুলোকে ভেঙ্গে গড়ে। নতুন এই সিনেমায় স্টুডিওর বা সেন্সর বোর্ডের অতিরিক্ত খবরদারি নেই (ষাটের দশক থেকেই ইউরোপে সেন্সরশিপ আস্তে আস্তে শিথীল হয়ে আসে), প্রচুর লাভ করার চাপ নেই, ফলে এই ফিল্মমেকাররা তাদের সৃজন কল্পনাকে (ভিশন) বাস্তবে রূপ দেয়ার মধ্যে এক অন্য আমোদ পেয়ে যান। কম খরচে ছবি বানাবার বাধ্যবাধকতায় পড়ে তাদের কাজ নতুন কৌশল ব্যবহারে হয়ে ওঠে আরও সৃজনশীল, লোকেশন, শুটিং ও অপেশাদার শিল্পীর অভিনয়ের দরুন হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত। নান্দনিক বোধের দিক থেকেও এই সিনেমা অনেক আধুনিক, যৌনতার শৈল্পিক ব্যবহারে আগের যে কোন সময়ের থেকে সাহসী।
ফরাসি নুভেল ভাগ ও ইতালির নিও-রিয়ালিজম পরবর্তী ভ্যানগার্ড নির্মাতাদের হাত ধরে সিনেমা হয়ে ওঠে অসম্ভবকে সম্ভবের মাধ্যম। এই মাধ্যম হয়ে ওঠে অন্য সব শিল্পের মিলনভূমি হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ, যাকে ব্যক্তিক-রাজনৈতিক একান্ত বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্যে সফলভাবে ব্যবহার করা যায়। সিনেমার এই পুনর্নিমাণ ধাক্কা এসে লাগে আমেরিকাতেও। এক সময়কার বিশ্ব মাতিয়ে বেড়ানো স্টুডিওগুলো দর্শক না পেয়ে হন্যে হয়ে ওঠে। দর্শকও ততদিনে জেনেছে সিনেমা বলতে এতদিন তাদের যা দেখানো হয়েছে শুধু এই নয়, এর বাইরেও সিনেমা হয়। তাদের রুচি বদলেছে; পর্দায় তারা আরও সাহসী কুহক দেখতে চায় যা শুধু চোখ জুড়াবে না, মনকেও জাগাবে।
এর উত্তর দিতে হলিউডের মোটামুটি এক দশক লেগে যায়। ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে বক্স অফিসে যে খরা চলছিল তা সত্তরের শেষ সময় পর্যন্ত বহাল থাকে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য যা নির্মিত হয়েছিল তার মধ্যে আর্থার পেনের বনি অ্যান্ড ক্লায়েড (১৯৬৭) ও মাইক নিকলসের দ্য গ্র্যাজুয়েট (১৯৬৭) অন্যতম। এর কিছু পরে ডেনিস হপারের ইজি রাইডার (১৯৬৯) ও রবার্ট অল্টম্যানের ম্যাশ (১৯৭০) মুক্তি পায় এবং ঘরে-বাইরে দর্শক-সমালোচক সমাদৃত হয়। উল্লেখ্য, এই ছবিগুলো স্টুডিওর বাইরে অপেক্ষাকৃত কম বাজেটে নির্মিত ছিল। অবশেষে স্টিভেন স্পিলবার্গের জস (১৯৭৫) দিয়েই হলিউডের মুভি বাজার নতুন করে চাঙ্গা হয়, সূচনা হয় এক ‘নিউ হলিউড’ এর। নতুন এই হলিউডের বৈশিষ্ট্য হল জঁরার পুনর্নিমাণ, তার সাথে যুক্ত হয় পরিচালকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা স্টাইল। একে একে হলিউড মেতে ওঠে নতুন এক প্রজন্মের পরিচালকদের সৃষ্টি সমেত এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা (দ্য গডফাদার, ১৯৭২), জর্জ লুকাস (আমেরিকান গ্রাফিটি, ১৯৭৩; স্টার ওয়ার্স, ১৯৭৭)। এই তিন জন পরিচালকই পরবর্তীতে প্রযোজক হিসেবেও সফলতা পান এবং হলিউডের নতুন সুদিন আনয়নে তাদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে ব্রায়ান ডি পালমা (অবসেশন, ১৯৭৬; মিশন ইম্পসিবল, ১৯৯৬) ও মার্টিন স্করসেসি (মিন স্ট্রিটস, ১৯৭৩; ট্যাক্সি ড্রাইভার, ১৯৭৬) সমালোচক-চক্রে প্রশংসা কুড়ান। ডেভিড লিঞ্চের ইরেজারহেড (১৯৭৭) ও এলিফ্যান্ট ম্যান (১৯৮০) মনোঃযৌন-জাগতিক দৃশ্যকাব্য রচনার জন্য সমালোচক সমাদৃত হয়।
এছাড়া সত্তরের দশকে কাজ করে যান অভিনেতা-পরিচালক জন ক্যাসাভেটিস (শ্যাডোজ, ১৯৫৯: অ্যা ওম্যান আন্ডার দ্য ইনফ্লুয়েন্স, ১৯৭৪)। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আইডল স্বরূপ, ক্যাসাভেটিস সত্তরের দশকের আমেরিকার আর্ট সিনেমার জগতে এক প্রতিভাধর নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজের খরচে, নিবেদিত ফিল্ম ক্রু দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ নিয়ে ছবি করার দুঃসাহস সে সময় যে গুটিকতক মানুষ দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে তিনি অন্যতম। হলিউডে একজন সফল অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ক্যাসাভেটিস তার অভিনয়ের বরাতে পাওয়া টাকা থেকে প্রযোজনা করে বানাতেন নিজের ছবি। তার ছবিগুলোতে সাধারণ মানুষের যাপন সম্পর্ক নিয়ে আবেগমথিত যে ড্রামা উপস্থাপিত হয় তাতে তার নিজের অভিনেতা সত্তার পরিচয় স্পষ্ট। হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায়, অন-লোকেশনে তোলা এই চলচ্ছবিগুলো অতুলনীয় এক মানবীয় উত্তাপ বিকীরণ করে, যাকে ‘ড্রামাটিক রিয়ালিজম’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ষাট ও সত্তরের দশকে ক্রিয়াশীল প্রতিভাধর নির্মাতাদের মধ্যে আরও ছিলেন স্ট্যানলি কুব্রিক ও উডি অ্যালেন, দ্বিতীয়জন এখনো প্রতি বছরই ফিল্ম দিয়ে যাচ্ছেন দর্শকদের। ক্যারিয়ারের প্রায় প্রথম দিক থেকেই হলিউডে নিজের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করলেও কুব্রিক সব সময়ই সচেতন ছিলেন নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখার ব্যাপারে। ষাটের দশকে ক্যারিয়ারের শীর্ষভাগ স্পর্শ করা তার ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ (১৯৬৪) ও ২০০১: অ্যা স্পেস অডিসি (১৯৬৮) ছবিগুলো সিনেমার ইতিহাসে মাইলফলক স্বরূপ। অন্যদিকে কমেডিতে নিজস্ব সিগনেচার ছবি রচনা করার দক্ষতা নিয়ে আবির্ভূত হন উডি, যার অ্যানি হল (১৯৭৭) স্বাধীন সিনেমা হয়েও অস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার জিতে নেয় ন্যারেশনের অভিনবত্বের গুণে।
আশির দশক ও জিম জারমুশ
যে পরিচালকদের নাম ও কাজ উল্লেখ করা হল তারাই স্বমহিমায় রাজত্ব করতে থাকেন আশি ও নব্বইর দশকে। সব মিলিয়ে হলিউডের এক রমরমা অবস্থা। হলিউড বুঝতে পেরেছে যে, জঁরার মধ্যে থেকে এবং পরিচালকদের শৈল্পিক স্বাধীনতা দিয়েও লাভ কিছু কম হয় না, বরং নতুন যুগের রেওয়াজ এটাই হতে হবে। নতুন এই নির্মাতারা বিভিন্ন ফিল্ম স্কুল (নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলস) থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে আসায় এই মাধ্যমের প্রতি গভীর সচেতনতা ও প্যাশন তাদের কাজে লক্ষ করা যায়। এই সময়ের সিনেমাতে তাই প্রায়ই পূর্ববর্তী হলিউড পরিচালকদের প্রতি নৈবেদ্য রাখবার নিদর্শন যেমন অনেক, তেমনি কারো কারো কাজে (স্করসেসি, উডি) ইউরোপীয় মাস্টারদের প্রতি দুর্বলতাও প্রকাশ পায় । ইউরোপ অবশ্য হলিউডকে কেবল নান্দনিক ভাষারই যোগান দেয় না, আক্ষরিক অর্থে অনেক ফিল্মমেকারও ইউরোপ থেকে হলিউডে গিয়ে কর্মস্থল খুঁজে নেন। এদের মধ্যে অতি পরিচিতদের মধ্যে আছেন ব্রিটেনের রিডলি স্কট, পোল্যান্ডের রোমান পোলান্সকি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ডেভিড ক্রনেনবার্গও আশির দশকে হলিউডের পরিচিত নাম।
হলিউডের এই ইতিবাচক ভূমিকা স্বাধীন সিনেমার জন্য কী অর্থ তৈরি করে? শক্তিশালী এক মূলধারা সিনেমার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আমেরিকার স্বাধীন সিনেমা কখনোই একটা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় না। সর্বদা বাজারকে নতুনের খোরাক যুগিয়ে চাঙ্গা রাখতে উৎসাহী হলিউডি স্টুডিওগুলো প্রতিভার খোঁজে নিজেই তৎপর থাকে। নবীন ফিল্মমেকাররাও এখানে নিজ গুণে মূলধারায় এক সময় জায়গা করে নেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকেন। ফলে প্রকাশ্য রাজনৈতিক বক্তব্যসম্পন্ন ছবি তৈরির রেওয়াজ নয়, বরং ভিন্নধর্মী বক্তব্য ‘নিশ’ দর্শকের জন্য ভিন্নভাবে প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই অধিকাংশ নির্মাতা কাজ করে থাকেন। স্বাধীন সিনেমা বলতে যদি কম বাজেটের নিজ খরচে তৈরি ও বণ্টিত ছবি বানানো (বা কোনো ছোট প্রোডাকশন হাউজ বা ডিস্ট্রিবিউটরের সাহায্যে) বোঝায়, তবে তা এখনো হয়। মূলধারার চমকদার জঁরা-সিকুয়েল-ফ্র্যাঞ্চাইজ সিনেমার বিপরীতে আমেরিকার স্বাধীন চলচ্চিত্রকাররা তাদের সিনেমা বানানোর জন্য বেছে নেন ভিন্নধর্মী গল্প, যাতে থাকে নিজস্বতার প্রয়োগে ‘অন্য রকম’ কথনের চেষ্টা। ফিল্মমেকারদের অনেকেরই প্রথম দিকের সিনেমার সাবজেক্টও হয় এমন, যা কিনা মূল ধারায় কদাচিৎ দেখা যায়, যেমন: নারীদের জীবন, আমেরিকার কালো-হিস্পানিক সমাজ, সমাজের বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আন্দোলনভিত্তিক নয়, আমেরিকার স্বাধীন সিনেমা তাই হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যের উদযাপন-প্রকাশ-সংরক্ষণধৰ্মী।
নবীন চলচ্চিত্রকারদের তাই সর্বতই চেষ্টা থাকে ফিল্মে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের। তেমনই হয়তো চেষ্টা ছিল জিম জারমুশেরও। নিউ ইয়র্ক ফিল্ম স্কুলে পড়া জারমুশ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ছবি, স্ট্রেঞ্জার দ্যান প্যারাডাইস (১৯৮৪) দিয়েই স্বাধীন সিনেমার ইতিহাস খাতায় জায়গা করে নেন কানের ‘সোনালি পাম’ জিতে। স্ট্রেঞ্জার প্যান প্যারাডাইস এর গল্প চমক লাগানোর মতো সাধারণ। নিউ ইয়র্কের দুই বাউন্ডুলে উইলি আর এডি, সাথে উইলির সদ্য হল্যান্ড থেকে আগত আত্মীয় ইভার প্রায় উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি। পুরো সিনেমা জুড়ে তেমন কিছু ঘটে না, বলা চলে তেমন কিছু না ঘটানোর প্রত্যয় নিয়েই সিনেমাটা বানিয়েছেন জারমুশ। নিয়ত ঘটনশীল। চাকচিক্যময় হলিউডের মুখে এটা বোধ করি জারমুশের ছুঁড়ে দেয়া এক উপহাস। প্রাত্যহিক রস, সমাজের নিম্নবিত্ত-সাধারণ চরিত্র ও ঘটনা থেকে ছবি বানানো, হালকা চালে গল্প বলে যাওয়া জারমুশের যে নিজস্ব স্টাইল সেটা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ক্যারিয়ারের শুরুতেই।
পরের ছবি ডাউন বাই লয়েও (১৯৮৬) তিন কয়েদি চরিত্র নিয়ে গল্প। সাজানো কেসে আটক হওয়া এক রেডিও জকি, বেশ্যালয়ের দালাল এবং এক ইতালীয় পর্যটক—যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন লাইফ ইজ বিউটিফুল খ্যাত কমেডি তারকা রবের্তো বেনিনি। তিন চরিত্রের মধ্যে বন্ধুত্ব-শত্রুতা গড়ে ওঠা ও জেল থেকে পলায়ন সিনেমার সিংহভাগ কাহিনি ধারণ করে। আগের মতোই খুব সাধারণ সংলাপে ছবি এগোতে থাকে, এই তিন চরিত্রের কথোপকথন ও কর্মকাণ্ডই ফিল্মের উপজীব্য। ফিল্মের সমাপ্তি এতটাই সরল যে, তা একভাবে মূলধারার সূচনা-ক্লাইম্যাক্স-উপসংহার ফর্মুলাকে যেমন উপহাস করে, তেমনি কথিত স্বাধীন সিনেমার বেদনার্ত অসমাপ্তির ধারাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
বহিরাগত বা আগন্তুকের উপস্থিতি জারমুশের ফিল্মে এক পৌনঃপুনিক মোটিফ, যা তার প্রথম ছবি থেকেই লক্ষ করা যায়। হল্যান্ড থেকে এসে নিউ ইয়র্কের মাটিতে ইভার পা রাখা, তার ‘আমেরিকান’ কাজিনের সাথে কথোপকথন ফিল্মের মূল মাত্রাগুলোর একটা। একইভাবে ডাউন বাই লতে(১৯৮৬) ইতালীয় পর্যটক-কয়েদি রবার্তো ছবির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে, যাকে ঘিরে ঘটনা বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শুধু কাহিনির চলক হিসেবে নয়, জারমুশের ‘আউটসাইডার’ চরিত্ররা ছবির ভাববস্ত্র প্রকাশেরও অন্যতম উপাদান বটে। ‘অন্যতা’ তার ছবিতে সাধারণ্যের গুণ খুঁজে পায়; ‘অপর’ থাকে কেন্দ্রে, দোষে-গুণে মানবিক হয়ে। এই ‘অপর’ কখনো বিদেশি (নিজ দেশে বা ভিন দেশে), অপরাধ জগতের মানুষ, নারী, বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর-কিশোরী, উপসাংস্কৃতিক কোনো কাল্টের কেউ, গণিকা, শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষ, রক্তচোষা মানুষ, শিল্পী (তারকা অভিনেতা থেকে শুরু করে অখ্যাত গায়ক)। মূলধারার ছবিতে যারাই প্রান্তিক, বিস্তৃত জারমুশের ছবিতে বাস্তব জীবনের আনাচ-কানাচ থেকে তারা সবাই পর্দায় প্রতিভাত হয়। ‘অন্য’ আবার কখনো সাংস্কৃতিক উপাদান—বিদেশি খাবার, গান, কবিতা, সিনেমা, তারকা ইত্যকার রেফারেন্স, যা দিয়ে ভরপুর জারমুশের ছবি। ‘অন্যতা’র এমন ব্যবহারে জারমুশের ছবিতে ‘অন্য’ বলে আর কিছু থাকে না। মার্কিনি সংস্কৃতিতে এই সকল অন্যের উপস্থিতি উদযাপন করাতে তার কাজে ‘অপরের’ জেল্লা যেমন একভাবে খসে পড়ে, তেমনি বারবার দর্শককে এক ক্রমোদ্ভুত বৈশ্বিক সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়। জারমুশের ছবি দেখতে দেখতে আমরা টের পাই কীভাবে প্রযুক্তির ও গণমাধ্যমের কল্যাণে আমাদের মাঝেই জন্ম হয়েছে এক বৈশ্বিক মানুষের। বিভিন্ন সংস্কৃতি ও তার অধিকতর ভিন্ন উপাদানসমূহের জালে আটকে পড়েছে যে আজকের মানবসত্ত্বা, জারমুশের ছবি সেই ‘বৈশ্বিক’ দর্শকের প্রতিই আবেদন জানায়।
জারমুশের ‘আউটসাইডার’ দৃষ্টিভঙ্গি একইসাথে তার নিজস্ব ও পৃথক, আবার তা আমেরিকার ‘ইন্ডি’ সিনেমার এক ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্যও বটে। সমাজের প্রান্তিক মানুষ-অশ্বেতাঙ্গ, অপরাধ জগতের মানুষ, শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ, নানা পেশার শ্রমজীবী সাধারণ যাদের উপস্থিতি মূলধারার মিডিয়ায় খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়, তাদের উপস্থিতিতে সয়লাব ক্যাসাভেটিস, স্করসেসি, স্পাইক লি, ট্যারান্টিনোর ছবিও। কিন্তু জারমুশের ছবিতে এই ‘আউটসাউডার’রা কেবল চরিত্র ও চরিত্রের গল্প হয়েই আসে না, জারমুশের অবলোকন করবার ভঙ্গিও এক আউটসাইডারের। জারমুশের চরিত্রদের যেন কোনো অতীত নেই, তাদের বর্তমান বা তার একটা অংশ জুড়েই থাকে সিনেমার বিস্তৃতি। চরিত্রদের এই আংশিক প্রকাশ জারমুশের ন্যারেটিভ স্টাইলের মধ্যেই প্রোথিত, নাটকীয়তাহীন মিনিম্যালিস্ট কমিক ইফেক্ট তৈরিই যখন তার প্রধানতম প্রয়াসগুলোর একটা।
জারমুশ ও তার সমসাময়িক আমেরিকান নির্মাতারা
জারমুশের কাজের মধ্যে মিনিম্যালিজম যেমন সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, তেমনি এই বৈশিষ্ট্যই জারমুশকে তার সমসাময়িক নির্মাতাদের থেকে আলাদা করে। সত্তরের দশক থেকেই যারা স্বাধীন নির্মাতা হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তাদের কাজে নাটকীয়তা সব সময়ই প্রধান ছিল। ১৯৭৩ এ মিন স্ট্রিটস দিয়ে যাত্রা শুরু করা আমেরিকায় ইন্ডি সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ মার্টিন স্করসেসি ‘ফিল্ম নোয়া’ জনরায় নতুনত্ব যোগ করেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬), রেইজিং বুল (১৯৮০), গুডফেলাজ (১৯৯০) দিয়ে ফিল্মের ইতিহাসে পাকাপাকি ঠাঁই করে নেয়ার সাথে সাথে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন স্বাধীন সিনেমার একজন গুরু হিসেবেও। এই ফিল্মগুলো যতটা না স্বাধীনভাবে নির্মিত তার চেয়ে নির্মাণকৌশলের অসাধারণত্বের কারণে, স্বাধীন সিনেমার মর্যাদা তারা বেশি করে পেয়ে যায়। তার সিনেমা একই সাথে শিল্প মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে যেমন উদযাপন করে, তেমনি বেশির ভাগ ছবিই অত্যন্ত ব্যবসা সফলও বটে। ৯০ এর দশকে বক্স অফিসে তেমন গুরুত্ব বজায় রাখতে না পারলেও নতুন শতকে দ্য এভিয়েটর (২০০৪), দ্য ডিপার্টেড (২০০৬), শাটার আইল্যান্ড (২০১০) বক্স অফিসে স্করসেসিকে একজন নেতৃত্বস্থানীয় হলিউড পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, এমনকি অস্কারও জুটিয়ে দেয় (দ্য ডিপার্টেড, ২০০৬)। আশির দশক থেকে কাজ শুরু করা, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া আরেক প্রথিতযশা নির্মাতা স্পাইক লির প্রথম ছবি শি’জ গটা হ্যাভ ইট (১৯৮৬) ব্ল্যাক-আমেরিকান ফিল্মমেকারদের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করে। উল্লেখ্য যে, ছবিটা অত্যন্ত কম বাজেটে নির্মিত হয়েও ব্যবসাসফল হবার যে নজির স্থাপন করে, তা পরবর্তী প্রজন্মের নবীন নির্মাতাদের জন্য এক উদ্দীপনার উৎস হয়ে আছে। প্রথম ছবি দিয়েই স্বাধীন নির্মাতা হিসেবে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয়া লি গত প্রায় ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে তার এই সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। একই সাথে তিনি তার নিজের কমিউনিটির প্রতিও নিয়ত বিশ্বস্ত থেকেছেন আমেরিকার কালোদের নিয়ে একের পর ছবি বানিয়ে। বড় বাজেটে বৃহত্তর সমাজের রুচিবোধ মাথায় রেখে ছবি তিনি কমই বানিয়েছেন। পর্দায় কালোদের বর্ণাঢ্য উপস্থিতি, নাটকীয়তা ও হাস্যরসপ্রধান লি’র সিনেমাগুলো স্বাধীন চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। নব্বইয়ের দশকে স্বাধীন চলচ্চিত্রের আকাশে নতুন যে তারকার জন্ম হয় তার নাম কুইন্টিন ট্যারান্টিনো। স্বশিক্ষিত (অর্থাৎ কোনো ফিল্ম স্কুল পড়ুয়া নন) এই পরিচালক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ছবি পাল্প ফিকশন দিয়ে ১৯৯৪তে কান উৎসব মাতান; ছবিটা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল স্বাধীন ছবিগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃত একই সাথে কাহিনিকথন ও আঙ্গিকের দিক দিয়েও সৃজনশীল স্বাধীন চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। সত্যি বলতে,আশির দশকে স্বাধীন চলচ্চিত্রের চিত্রপটে জারমুশ যদি নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন, ট্যারান্টিনো নব্বইয়ের দশকে আমেরিকার (এমনকি সারা বিশ্বেরও) স্বাধীন সিনেমার কান্ডারি হিসেবে প্রকাশলাভ করেন।
আঙ্গিকের দিক থেকে ট্যারান্টিনোর ছবি জারমুশের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে তাঁবু গাড়ে। আমেরিকার ‘পাল্প’ বা সস্তা জনপ্রিয় গল্প আর ‘বি-মুভি’র ধারাকে কুর্নিশ জানিয়ে ট্যারান্টিনো স্টাইলিশ ‘ফিল্ম নোয়া’ বানানোর অভিনব তরিকা বাতলান। স্করসেসির মতোই ট্যারান্টিনোও মূলধারার ছবির প্রতি বিশেষ বিরাগ পোষণ করেন না, সিনেমার প্রতি প্যাশনেও ঘাটতি নেই। তার চরিত্ররা যতটা বাস্তব জগতের, তার থেকে বেশি যেন তারা পাল্প বা জনপ্রিয় উপন্যাস-সিনেমা হতে উদ্ভুত। যেখানে বি-মুভির সাথে ট্যারান্টিনো তার ছবির পার্থক্য তৈরি করেন তা হলো তার মাধ্যম-সচেতনতায়। ফিল্ম নোয়া এবং অ্যাকশন ঘরানার ছবির প্রচলিত রীতির প্রতি ট্রিবিউট দেয়া এবং ফিল্ম কনভেনশনের ভাঙা-গড়ার সচেতন প্রয়াসে তার সিনেমা উজ্জ্বল।
ট্যারান্টিনোর ছবির মেলোড্রামা, ভায়োলেন্স, সিনেমাটিক ভাষার মারপ্যাচ—সকল আতিশয্যের বিপরীতে জারমুশের ছবিতে পরিলক্ষিত হয় প্রাত্যহিক, সাধারণ অথচ কৌতূহলোদ্দীপক উপস্থাপনা, অদ্ভুত চরিত্রের সন্নিবেশ, এমনকি দার্শনিক জীবনবোধ (নাইট অন আর্থ, ১৯৯১: কফি অ্যান্ড সিগারেটস, ২০০৩; ঘোস্ট ডগ, ১৯৯৯; পেটারসন, ২০১৬ দ্রষ্টব্য)। সিনেমা ছাড়াও অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের প্রতি যে গভীর ভালবাসা লালন করেন তিনি, তার পৌনঃপুনিক প্রতিফলন ঘটেছে তার একাধিক ছবিতে। কবি ও কবিতার রেফারেন্স যেমন তার সিনেমায় ব্যবহৃত, তেমনি খোদ একজন কবি নিয়েও ছবি বানান এই পরিচালক। অবশ্য জারমুশের কবি সদা দৃশ্যমান থেকেও নিভৃতচারী, সাধারণ ঘটনাবহুল জীবন তার প্রেরণার উৎস।
সংগীত জারমুশের প্যাশনগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং তার চলচ্চিত্রে বিচিত্র সংগীতের ব্যবহারে তা স্পষ্ট। এছাড়াও গায়ক মিউজিশিয়ানদের ছবিতে কাস্ট করার ইতিহাসও দীর্ঘ। শুরু থেকেই টম ওয়েইটস (ডাউন বাই ল), জনি ডেপ (জারমুশের দাবী জনি ডেপকে আগে গায়ক তারপর অভিনেতা বিবেচনা করা উচিত, কারণ তিনি প্রথমে মিউজিশিয়ানই ছিলেন), ইগি পপের মত শিল্পীদের সিনেমায় কাস্ট করেন তিনি। এছাড়া গিম্মি ডেঞ্জার (২০১৬) নামে ‘দ্য স্টুজেস ব্যান্ড’ কে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন তিনি।
সমসাময়িকদের থেকে বিষয়বস্তু, আঙ্গিক ও কথনশৈলীতে জারমুশের সিনেমা যেমন অনন্য, তেমনি আরও একটি দিক থেকে তিনি নিজেকে সচেতনভাবে আলাদা করেন। আর তা হলো কোনো বড় স্টুডিও বা বিপণন সংস্থার ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার প্রত্যয়। সমসাময়িক সব নির্মাতারই যেখানে বড় মাত্রার চলচ্চিত্র পরিচালনার ইচ্ছা আছে এবং সে অনুযায়ী কখনো বাজার, কখনো নির্দিষ্ট ভোক্তা ও রুচি উপযোগী সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতাও হয়েছে, সেখানে জারমুশ এসব উদ্দেশ্যকে তুচ্ছ করেছেন বরাবরই। তার এই অনীহার ব্যাখ্যা দিয়েছেন “হলিউড স্টুডিওগুলোর সমস্যা হচ্ছে যে এরা ভীতু। দর্শক যাচাই করতে না পারলেই এরা ভয়ে পিছিয়ে যায়। ‘স্ক্রিপ্টটা পড়তে দ্য গ্র্যাজুয়েটর মতো লাগছে, তবে ছবিটা লাভ স্টোরির মতো হওয়া চাই’! কি আশ্চর্য, ছবিটা অন্যরকম কিছু হতে পারে না? … স্টুডিও সিস্টেম থেকে যে নতুন কিছু বেরিয়ে আসে সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। কারণ তারা যেসব ছবি বাজারজাত করার কল্পনা করতে পারে না, সেগুলোর কথা শুনলেই ভয় পায়। শৈল্পিক কোনো কিছু সাহস করে করতেই চায় না।” তবে স্টুডিওর বিরুদ্ধে এহেন বিষাদগার করা জারমুশও যে স্টুডিওর বাইরে সব ফিল্ম করেছেন তা নয়। একই সাক্ষাৎকারে তার অ্যামাজন স্টুডিওর সাথে করা দুটি ফিল্মের প্রসঙ্গও আসে এবং জারমুশ প্রকাশ করেন হলিউড স্টুডিওগুলোর সিনেমা সম্বন্ধে অকাট মুর্খতার কথা—যেখানে তার ফ্রান্সের একজন পরিবেশক রাশিয়ান পরিচালক ঝিগা ভের্তভের সমঝদার হন সেখানে হলিউডের প্রযোজক ভেতৰ্ভ মডেল না পরিচালক তা-ই ঠাহর করতে পারেন না! উত্তেজক এমন কটাক্ষে একদিকে যেমন জারমুশের রসাত্মক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়, তেমনি হলিউডের ব্যবসামুখী মনোভাবের প্রতি দীর্ঘদিনের জমাট ক্ষোভেরও উদগীরণ ঘটে।।
জারমুশ এভাবে খুব নিভৃতে বিদ্রোহ করে যান তার কাজের মাধ্যমে। এই বিদ্রোহ বোধহয় দুমুখী। একদিকে যেমন ইন্ডাস্ট্রির জাঁকজমককে তিনি অবজ্ঞায় পাশ কাটিয়ে যান, তেমনি ‘ইন্ডি’র প্রচলিত রীতিনীতি ও ধারাগুলো থেকেও দূরত্ব বজায় রাখেন। তার ফিল্মগুলো আর্ট সিনেমার কৌশল ও ভাব-গম্ভীরতার গুরুভারকে বিশেষ তোয়াজ করে না। তারা গল্পে ও আঙ্গিকে হয় তার নিজস্ব শিল্পবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল অনুগত, ফলত স্বতন্ত্র ও মৌলিক। শিল্পীর এই স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যই জারমুশের সব থেকে বড় আরাধ্য বিষয়।
নির্ভীক এই শিল্পী তার কাজে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমগুলোর (গান, কবিতা) যোগাযোগ ঘটাতে তাই কোনো দ্বিধা করেন না। সারা জীবন শিল্পচর্চায় নিয়োজিত থেকেও তরুণ এই পরিচালক নিজেকে এক আনাড়ি শিল্পানুরাগীর থেকে বেশি কিছু ভাবেন না।
হয়ত তিনি তাই-ই। আনাড়িই সই, তবু নিজস্বতা বজায় রেখে শিল্পের চর্চা জারি রেখেছেন—এটাই নিজের প্রাপ্তি বলে যে পরিচালক মনে করেন, তিনিই জিম জারমুশ।
লেখক
ফাহিমা আল ফারাবী
চলচ্চিত্র গবেষক
সহায়:
(১) বর্ডওয়েল, ডেভিড, ও থমসন, ক্রিস্টিন, ফিলা আর্ট অ্যান ইন্ট্রোডাকশন, ২০১২, ম্যাথ-হিল এজুকেশন।
(২) নোয়েল-স্মিথ, জফরি, মেকিং ওয়েভস নিউ সিনেমাস অব দ্য নাইন্টিন সিক্সটিজ, ২০১৩, ব্লুমসবিউরি
(৩) মোন্যাকো, জেমস, হাউ টু রিড আ ফিল্ম, ২০০৯, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
(৪) লেভি, ইমানুয়েল, সিনেমা অব আউটসাইডার্স: দ্য রাইজ অব আমেরিকান ইন্ডেপেন্ডেন্ট ফিলা, ১৯৯৯, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস
(৬) স্টার্ম, রুডিজার, ২০১৬, নভেম্বর ২৩, জিম জারমুশ: হোয়াট আর দে অ্যাফ্রেইড অফ? http://the-talks.com/interview/jim-jarmusch/
(৭) রেচেল, টি কোল, ২০১৭, জুলাই ১০, জিম জারমুশ অন নট ওয়েস্টিং টাইম, https://thecreativeindependent.com/people/jim-jarmusch-on-not-wasting-time/
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)