Skip to content Skip to footer

“ছবি প্রযুক্তিগতভাবে ত্রুটিহীন হোক বা না হোক, তাতে প্রাণ থাকতে হবে।”—ইয়াসমিন কবির

ইয়াসমিন কবির প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন ব্যক্তিগত তাড়নার জায়গা থেকে। চৌকস হাতে তিনি অকৃত্রিম দৃশ্য ধারণ করেন। সৃজনশীলতাকে দেখেন অন্তর্দৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। পরবাসী মন আমার (২০০০) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন। প্রবাসী শ্রমিকের জীবন, বীরাঙ্গনার জীবন অথবা জাহাজভাঙা শ্রমিক তার ক্যামেরায় ধরা দেয় সাবলীলভাবে। ফ্ল্যাশব্যাকের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা, নির্মাতা হিসেবে তার স্বপ্ন এবং পদ্ধতির কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ করিম চৌধুরী।

ছবি নির্মাণ একজন নির্মাতার কাছে অনেক কিছু হতে পারে। হতে পারে এটা আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা। হতে পারে ছবি তার সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। আপনার ক্ষেত্রে প্রণোদনা কী? কী আপনাকে নতুন ছবি শুরু করার জন্য টেনে আনে?

ইয়াসমিন কবির: যা আবেগকে ছুঁয়ে যায় তা আমাকে অনুপ্রাণিত করে ছবি বানাতে। ছবি নির্মাণ আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা হতে পারে, যেন পর্দা সরিয়ে অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। আমার মনে হয় সামাজিক দায়বদ্ধতার চাপে ছবি বানানো উচিত নয়, বানানোর আগ্রহ আসতে হবে ভেতর থেকে।

আপনার ছবিগুলোতে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত আবহাওয়া থাকে। আপনার এই বিশেষ নির্মাণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাই।

ইয়াসমিন: সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে খোলা, অলিখিত মন নিয়ে কাজ করা। কোনো অবস্থার মধ্যে পূর্ব ধারণা, বিস্তারিত প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা এবং সবজান্তা ভাব নিয়ে প্রবেশ করলে এগুলো স্বতঃস্ফূর্ততার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। মাঝেমধ্যে তুচ্ছ খুটিনাটি এবং অতিরিক্ত প্রযুক্তি ছবির প্রাণ বিনাশ করতে পারে। ছবি প্রযুক্তিগতভাবে ত্রুটিহীন হোক বা না হোক, তাতে প্রাণ থাকতে হবে। অনেক সময় সৃষ্ট ছবি একজন নিখুঁত চেহারার মানুষের মতো অঙ্গসৌষ্ঠবে যথাযথ হতে পারে, কিন্তু আত্মাহীন।

ফিকশন ফিল্মে অধিকাংশ সময়ে পূর্ব পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় এবং পরিবেশের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রে পরিবেশকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ফলাফলে খুঁত থাকতে পারে এবং এগুলো সংশোধন করতে নির্মাতাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। এই সংশোধন প্রক্রিয়া নির্মাতার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ কিন্তু অনেক সময়ে তা অপ্রত্যাশিত এবং বিস্ময়কর ফলাফল এনে দিতে পারে। এই বিস্ময়কর উপাদানই সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে।

আমি বিশ্বাস করি যে, ছবি নির্মাণে বেশি ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে প্রাকৃতিক আলোতে, হাতে ধরা ক্যামেরা, নূন্যতম ট্রাইপড ব্যবহার করে কাজ করা যায় বোঝা ছাড়া হালকা ভ্রমণের মতো। নির্মাতাকে যেকোনো সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তৈরি থাকতে হবে। ভালো শব্দ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি, চোখ হয়তো কিছুটা কম্পমান, ত্রুটিপূর্ণ ইমেজের সাথে সামঞ্জস্য করতে পারে, কিন্তু কান এতটা সহনশীল নয়।

পরবাসী মন আমার (২০০০) প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্য।

আপনার চরিত্রগুলো ক্যামেরার সামনে খুবই সাবলীল। চরিত্রের সাথে এই বোঝাপড়াটা কীভাবে করেন?

ইয়াসমিন: যন্ত্রপাতিতে ঘাবড়ে না দিয়ে দু-এক জন সহযোগী নিয়ে যাই। এতে করে যার সাথে কথা বলবো তিনি স্বাভাবিক হয়ে যান এবং কথা বলতে ইতস্তত বোধ করেন না এবং কীভাবে, কী প্রশ্ন করা হবে তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে যারা আমাদের তাদের জীবনে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখে কথা বলা। আমি বিশ্বাস করি সহানুভূতি সবচেয়ে জরুরি উপাদান। আমার জন্য সাধারণ, সরাসরি পন্থাই সবচেয়ে ভালো কাজ করে।

আপনার প্রামাণ্যচিত্রে শব্দ, দৃশ্য, ইমেজ সব মিলিয়ে যেন এক প্রকারের ঐকতান সৃষ্টি হয়। এটা কীভাবে সম্ভব করে তোলেন?

ইয়াসমিন: আমার কাছে ছবি নির্মাণে ইনট্যুইশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি কোনো বিশেষ স্টাইল গ্রহণ করি না, ঘটনা কিংবা স্থান সম্পর্কে আমার ধারণাই স্থির করে কীভাবে ছবিটি বানাব। উদাহরণস্বরূপ আমি যখন শেষকৃত্য (২০০৮) বানাতে চট্টগ্রামের জাহাজভাঙার কারখানা দেখতে যাই, তখন তার মাত্রা ও বিশালত্ব দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। গ্রিক পুরাণের এক মহাকাব্যিক বিয়োগান্ত ঘটনা যেন ঘটে যাচ্ছে। আমি এমন এক জগতের সম্মুখীন হই যাতে শ্রমিকরা অবিরত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ভাগ্যের এক অদ্ভুত মোচড়ে কৃষক ও শ্রমিক যেন শিল্পযুগের শব বহনকারী হয়ে গিয়েছে। তখনই আমি অনুভব করলাম যে এই ছবিটি আমি নির্বাক বা সাইলেন্ট বানাতে চাই।

একইভাবে আমার স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি রশিতে (২০১৭) ধ্যানমূলক শব্দ কাজ করবে মনে করি, যা দর্শককে ভাবিয়ে তুলবে। এই ছবি দুটো নির্মাণের প্রক্রিয়ায় আমার জন্য সাউন্ড ডিজাইন সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার ছিল। অন্যদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে, পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে ছিল না। সুরকারদের সঙ্গে অনেকবার আদান-প্রদান করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে তর্কও হয়েছে। সৃজনশীল কাজে এটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু শেষে আমরা সবাই ফলাফলে সন্তুষ্ট হই।

শেষকৃত্য (২০০৮) ছবির একটি দৃশ্য।

মানুষের আবেগ-অনুভূতি সর্বোপরি এই জীবনকে আপনি ফুটিয়ে তোলেন কাব্যিক ঢঙে। সাথে সাথে আপনার ছবিগুলো খুব মিনিমাল। অনেক বড় বড় বিষয় উঠে আসে খুবই মিনিমালভাবে। এর পেছনে কোনো অনুপ্রেরণা আছে কি?

ইয়াসমিন: আমার ছবিগুলো প্রধানত সাধারণ জীবন, যা অসাধারণ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তার উপর তৈরি করা। সহজ ও সাধারণভাবে বানানো মানে সহজে বোঝানো। মানুষের জীবনের একটি বিশেষ কোণে কিছুটা আলোকপাত করে হয়তো আরও বড় বিষয়গুলো সবার দৃষ্টিগোচর করা সম্ভবপর। নয়তো এই বিষয়গুলোর বিশালত্ব এবং ভার বহন করা খুবই কঠিন। শেষমেষ আমি অনুভব করলাম একমাত্র উপায় যা কাজ করতে পারে তা হলো আবেদন।

আপনার প্রিয় নির্মাতাদের সম্পর্কে জানতে চাই। কাদের দ্বারা আপনি অনুপ্রাণিত?

ইয়াসমিন: প্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। এতজন, আর তাদের প্রায় সবাই চলে গেছেন। কিন্তু তাঁরা মহাকাশে নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল থাকবেন। মিজোগুচির ছবির ঝলমলে সৌন্দর্য, স্বল্প কথা ও শব্দ ব্যবহারে ওজুর ছবির ধ্যানমূলক পরিবেশ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। সত্যজিৎ রায়ের ছবি আমাকে প্রথমে অনুপ্রাণিত করে কারণ আমি তার ছবিগুলোর কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।

তৃতীয় বিশ্বের ছবি উসমান সেমবেন এর ব্ল্যাক গার্ল (১৯৬৬), লাতিন আমেরিকার প্রামাণ্যচিত্রের আবেগ যেমন প্যাট্রিসিয়ো গুজম্যান এর ব্যাটল অব চিলি (১৯৭৫-৭৯), মিগুয়েল লিতিন আর ফারনান্দো সোলানাস এর ছবি আমার মনে শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পন্টিকার্বোর দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স (১৯৬৬) যা ফিকশন হলেও প্রামাণ্যচিত্রের ধারায় নির্মাণ করা হয়েছে। রাউল পেক এর প্যাট্রিস লুমুম্বাকে নিয়ে করা প্রামাণ্যচিত্র অত্যন্ত প্রশংসনীয় আর তার সম্প্রতি করা ডকুমেন্টারি আই অ্যাম নট ইয়োর নিগ্রো (২০১৬) উল্লেখযোগ্য।

পাশ্চাত্যে, জার্মান এক্সপ্রেশনিজম এর গুরু মুর্নাউ ও ফ্রিৎজ ল্যাং, ডেনমার্কের কার্ল ড্রেয়ার আমার অত্যন্ত প্রিয়। ইংমার বার্গম্যান এর ছবি দেখা ভালো সাহিত্য পড়ার মতো এবং তারকোভস্কি আর ব্রেসোঁ এর আধ্যাত্মিক ছবিগুলো কাব্যিক এবং মহিমান্বিত, সর্বশেষে আমাদের নিজস্ব ঋত্বিক কুমার ঘটক-সিনেমার উম্মাদ গুরু।

আই অ্যাম নট ইয়োর নিগ্রো (২০১৬) প্রামাণ্যচিত্রের পোস্টার।

এদেশে সেন্সরশিপ স্বাধীনভাবে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। এছাড়া আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি ছবির জন্য খুব নাজুক। আপনি কখনো ছবি তৈরির ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়েছেন? কিংবা কোনো কারণে ছবিতে যেভাবে যা করতে চেয়েছেন তা পারেননি?

ইয়াসমিন: আমি এর ব্যতিক্রম নই। সব নির্মাতাকেই কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়—অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক। স্বৈরতন্ত্রের অধীনেও লাতিন আমেরিকার ক্লানডেস্টাইন ফিল্ম বা গোপন প্রতিরোধী ছবি হয়েছে এবং ইরানের নির্মাতাগণ রাজনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অনেক উল্লেখযোগ্য ছবি তৈরি করেছেন। মাঝে মাঝে সেন্সরশিপ না থাকলেও নির্মাতারা স্ব-আরোপিত সীমাবদ্ধতা পালন করে। কিন্তু যখন সৃজনশীলতার জোয়ার বাঁধ ভেঙ্গে আসে, তখন তাকে আটকে রাখা অসম্ভব। সবচেয়ে ভালো নির্মাতা তারাই যারা উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে কঠিন পরিবেশ অতিক্রম করতে পারেন।

লাতিন আমেরিকার প্রামাণ্যচিত্র আবেগময়, তেজে ভরপুর। সেখানে সিনেমা মাধ্যমের সৃজনশীল ব্যবহার হাতে ধরা ক্যামেরা, স্বল্প আলো, ঝাপসা ইমেজ সবই চলচ্চিত্র নির্মাণে সম্পদের মিতব্যয়ের দিকে ইশারা করে। পরে বিজ্ঞাপনের জগৎও এটাকে স্টাইল হিসেবে গ্রহণ করে।

যতদূর জানি, চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে আপনি খুব একটা গুরুত্ব দেন না। বাংলাদেশে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকেই চলচ্চিত্রবিষয় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবকে প্রধান বাধা হিসেবে গণ্য করে থাকে। আপনার মূল্যায়ন কী?

ইয়াসমিন: অতিরিক্ত নিয়মাবলি অনেক সময়ে সৃজনশীলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে । অন্য অনেকের মতো আমিও মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি এবং সাহস হয়নি, বিশ্বাস করেছি যে ফিল্ম স্কুলে না গেলে ফিল্ম বানাতে পারবনা। যখন ফিল্ম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হলো এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলাম, আমি অনুভব করলাম যে, আমার আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন একসময় বিশ্বাস করেছি যে ঘরানার নির্মাণের ধারাকে বিভিন্ন বাক্সে ঢুকাতে দিয়ে আমার সৃজনশীলতার দম আটকে আসছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি ফিল্ম স্কুলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবোনা। অবশ্য নিয়মাবলি জানা ভালো, যাতে ভাঙা যায়।

ফিল্ম স্কুলের ভালো দিক হচ্ছে যে, আমি কিছু নির্মাতার কাজের সাথে পরিচিত হই যা দর্শকের অভাবে বাইরে দেখার সুযোগ হতো না। যেমন ক্রিস মার্কার এর অপরূপ ছবি লা জেতি (১৯৬২) ও স্যানস সলিয়েল (১৯৮৩) আর আলা রেনে এর বিস্ময়কর প্রামাণ্যচিত্র নাইট অ্যান্ড ফগ (১৯৫৬)। আমাকে বিশেষ অনুপ্রেরণা দিয়েছে কিদলাত তাহিমিক এর পারফিউমড নাইটমেয়ার (১৯৭৭), যাতে ফিল্ম স্টকের পুনঃব্যবহার করা হয়েছে, আমাকে শিখিয়েছে যে নিখুঁত না হলেও চলে।

চলচ্চিত্র নির্মাণে স্বশিক্ষিত হওয়া সম্ভব। ক্লাসিকাল ফিল্ম ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে। লেখক হওয়ার জন্য কি কাউকে ডিগ্রি নিতে হয়? প্রধান উপাদান হচ্ছে আবেগ, আর সৃজনশীলতা কাউকে শেখানো যায় না।

(সাক্ষাৎকারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত প্রকাশনা ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)

Leave a comment