Skip to content Skip to footer

১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মুক্তি পায় আর্জেন্টাইন চলচ্চিত্রকার ফারনান্দো সোলানাসের দ্য আওয়ার অব দ্য ফারনেসেস (১৯৬৮)। একই সময় আরেক খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক জ্যঁ-লুক গদার যুক্তরাষ্ট্রে সোলানাসের সঙ্গে কথোপকথনে মিলিত হন। সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।


জ্যঁ লুক গদার: তুমি তোমার দ্য আওয়ার অব দ্য ফারনেসেস (চুল্লির প্রহর) সিনেমাটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে? 

ফারনান্দো সোলানাস: একটি ভাবাদর্শমূলক ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র প্রবন্ধ হিসেবে। কেউ কেউ এটিকে গ্রন্থ হিসেবেও মূল্যায়ন করেছেন। এটা ঠিক যে, সিনেমায় আমরা তথ্য, নীতিগর্ভ বক্তব্য, শিরোনাম ইত্যাদি চলচ্চিত্রকে ফুটিয়ে তোলার বিভিন্ন উপাদান হিসেবে সরবরাহ করি…. বর্ণনার গঠনটা অনেকটা বইয়ের মতোই: প্রস্তাবনা, অধ্যায়সমূহ, উপসংহার ইত্যাদি। কিন্তু এটি এমন একটি সিনেমা যা গঠন ও ভাষার দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা প্রয়োজনীয় ও উপযোগী সবকিছুই ব্যবহার করেছি যা আমাদের শিক্ষার জন্য দরকার। সরাসরি বাস্তব দৃশ্যায়ন থেকে শুরু করে অন্যের সাক্ষাৎকার গ্রহণ পর্যন্ত সবই এখানে করেছি… যা একটি গল্প অথবা কাহিনি বা একটি গান, এমনকি ছবির মাধ্যমে চিন্তার কোনো মন্তাজকে ফুটিয়ে তোলে। সিনেমাটির সাব-টাইটেল, এর ডকুমেন্টারি চরিত্রকে প্রকাশ করে। আমরা চাই যে বাস্তবতাকে আমরা পাঠ ও গবেষণা করতে চেয়েছি তার সাক্ষ্য-প্রমাণ যেন দর্শকের সামনেও হাজির থাকে। এটি এমন একটি সিনেমা যার ভিত্তি তার ওরিয়েন্টশনের মধ্যেই। এটি একটি দিক নির্দেশ করে, একটি পথ নির্দেশ করে। সিনেমাটিকে এমন কোনো দর্শক শ্রেণির সামনে তুলে ধরা হয়নি যারা সাংস্কৃতিক সহাবস্থান-এ বিশ্বাসী। অন্যদিকে বলা যায়, এটি তুলে ধরা হয়েছে সাধারণ জনগণের সামনে যারা বাস্তবতার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। দ্য আওয়ার অব দ্য ফারনেসেস এমন একটি সিনেমা যা সমাজের অপ্রদর্শিত চিত্রকে প্রদর্শন করে। এটি সিনেমা হিসেবে নিজেকে অস্বীকার করে এবং সাধারণের সামনে নিজেকে তুলে ধরে বিতর্ক, আলোচনা ও পরবর্তী উন্নয়নের জন্য। এর প্রতিটি প্রদর্শনী একটি মুক্তির জায়গা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে; যা থেকে মানুষ তার নিজস্ব অবস্থান থেকে নতুন জ্ঞান আহরণ করে; অনুভব করে একটি গভীর আত্মোপলব্ধি; যা তাকে পরিস্থিতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বোঝায় ।


গদার: এ কাজটি কীভাবে করা হয়েছে?

সোলানাস: সিনেমার মাঝে অনেকগুলো বিরতি আছে। বিরতিগুলো এজন্য যে, সিনেমায় যে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে তা যাতে পর্দা থেকে মঞ্চে অর্থাৎ জীবনের দিকে, বাস্তবতার দিকে ছড়িয়ে যেতে পারে। পুরোনো দর্শক, যারা বিষয়টিকে ধরে রেখেছেন, সেভাবে আগে গভীরভাবে দেখেননি, ঊনবিংশ শতকের আর্টের বুর্জোয়া ধারণার ওপর নির্মিত ট্র্যাডিশনাল সিনেমার সেই নিষ্ক্রিয় দর্শক এখানে পরিণত হন সজীব সক্রিয় অংশগ্রহণকারীতে। এ সিনেমার গল্পের এক জন বাস্তব নায়ক হিসেবে দর্শক আবির্ভূত হন। এবং ইতিহাস নিজেও এখানে বাস্তব হয়ে ওঠে, কেননা সিনেমাটি আমাদের সমকালীন ইতিহাস সম্পর্কিত।

এটি মানুষের মুক্তি সম্পর্কিত একটি সিনেমা যা আমাদের ইতিহাসের অসমাপ্ত একটি স্তর। এটি এমন একটি চলচ্চিত্র যা এই মুক্তির জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিকট উন্মুক্ত। এজন্যই সিনেমাটি অবশ্যই সম্পূর্ণ হয়েছে সক্রিয় দর্শকদের দ্বারা। পাশাপাশি আমরা এখানে নতুন উপলব্ধি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংযুক্ত করার সম্ভাবনাকে বন্ধ করে দিচ্ছি না, যা ভবিষ্যতে পাওয়া যেতে পারে এবং প্রকাশিত হওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এ কাজ তখনই সম্পূর্ণ হবে যখন অংশগ্রহণকারীরা এর সমাপ্তি টানতে চাইবেন।

সিনেমাটি পুরোনো দর্শককে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীতে পরিণত করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ফানোঁ-এর (ড. ফ্রাঞ্জ ফানোঁ) মতো আমরাও বিশ্বাস করি, “যদি আমরা অবশ্যই আমাদের সবাইকে মুক্তির জন্য যুদ্ধে যুক্ত করতে পারি; তখন কোনো দর্শক থাকবে না, থাকবে না কোনো গোবেচারা মানুষ আমরা আমাদের মাটিতে পতঙ্গের দল নিয়ে নাড়াচাড়া করবো এবং আমাদের মনের শূন্যতা নিয়ে চিন্তা করবো। প্রতিটি দর্শক হয় কাপুরুষ, নয় বিশ্বাসঘাতক।” অর্থাৎ বলা যায়, আমরা এমন কোনো সিনেমার মুখোমুখি হইনি যা এক্সপ্রেশন কিংবা যোগাযোগের জন্য। বরঞ্চ একটি উদ্যোগের জন্য, মুক্তির জন্য সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। এটি একটি গবেষণালব্ধ চলচ্চিত্র যা কোনো ভাবাদর্শিক রচনার সমতুল্য।

গদার: এটি করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

সোলানাস: যেকোন বাণিজ্যিক নির্মাণের যে সাধারণ সমস্যাগুলো সবারই হয়ে থাকে সেগুলোই। তার পাশাপাশি আমি বলতে পারি, আরেকটি সমস্যা আমাদের খুব বেশি ভুগিয়েছে তা হলো বিদেশি সিনেমাটোগ্রাফিক মডেলের উপর আমাদের যে অতি নির্ভরতা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এই যে আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান সিনেমার উপর আমাদের নির্ভরতা, যা মূলত নন্দনতাত্ত্বিক, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। এটা পৃথকভাবে শুধু আর্জেন্টিনার সাংস্কৃতিক অবস্থার বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাবে না। আর্জেন্টিনার প্রথাগত যে সংস্কৃতি, সেটা নব্য ঔপনিবেশিক বুর্জোয়াদের সংস্কৃতি। এটি হচ্ছে অনুকরণের সংস্কৃতি, অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সংস্কৃতি। আজকের আর্জেন্টিনায় সিনেমা তৈরি হচ্ছে অর্থনেতিক ও নন্দনতত্ত্বগত দিক থেকে মার্কিন সিনেমার মডেল অনুসরণ করে। এখানে কোনো আবিষ্কার নেই, নেই কোনো আত্ম-অনুসন্ধান। এখানে আছে শুধু অনুবাদ, অনুসরণ আর অনুকরণ। এখানে আছে শুধুই নির্ভরতা।

ফারনান্দো সোলানাস


গদার: আমেরিকান সিনেমা মানেই হচ্ছে এতে বাণিজ্য থাকতে হবে…

সোলানাস: ঠিক তাই, শুধু অন্যকে দেখানো আর বাণিজ্য দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সিনেমা তাদের, যার প্রধান শর্তই হচ্ছে পুঁজিগত দিকটিকে নিশ্চিত করা। আজকের সিনেমার সকল জঁরা, কৌশল, ভাষা, এমনকি ব্যাপ্তিকালও সিনেমা দিয়ে আর্থিক লাভ অনুসন্ধানে অনবরত ব্যস্ত। আমাদের এ সিনেমাটি এ সমস্ত ধারণাকে ভাঙতে চেয়েছে। তাই এ সমস্ত বাণিজ্যিক শর্তগুলো আমাদের সবচেয়ে আমাদের বেশি অসুবিধার সম্মুখীন করেছে। আমাদের প্রথমে নিজেদেরকে স্বাধীন করতে হয়েছে। শিল্পকার কেবল তখনই অর্থপূর্ণ যখন আমরা এক জন লেখক হিসেবে অথবা এক জন চিত্রকর হিসেবে স্বাধীনভাবে একে সৃষ্টি করতে পারি। যদি আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের প্রয়োজনকে বের করে নিয়ে আসতে পারতাম সেটিই হতো সবচেয়ে ভালো পন্থা। করার সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ঝুঁকি নেওয়ার, চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলাম সেভেনথ আর্টের পথিকৃৎদের মতো যারা শুধু উপন্যাস, ছোট গল্প বা নাটক দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে নিজেরা অনুসন্ধান করার। আমরা নিজেদের স্বাধীন করতে শুরু করলাম। ভিসকন্তি, রেনোঁয়া, গায়াকোন্ডা, রেসনেইস, পাভেস প্রভৃতের থেকে স্বতন্ত্র একটি ফর্ম আবিষ্কারের পণ করলাম যা শুধুই আমাদের। আমাদের ভাষা, কাঠামো, নিজস্ব ফর্ম আবিষ্কার করার প্রয়োজন ছিল যা আমাদের দর্শকের প্রয়োজনকে সংরক্ষণ করবে, সংরক্ষণ করবে সমস্ত আর্জেন্টিনাবাসীর মুক্তির চাহিদাকে। চলচ্চিত্র মাধ্যমে এই অনুসন্ধানটি নন্দনগত দিক থেকে আসেনি, বরং এসেছে আমাদের জনগণ ও দেশের সামগ্রিক মুক্তির দিক থেকে। এই উপায়েই নতুন সিনেমা জন্মলাভ করেছে, আমাদের শিখিয়েছে প্রয়োজনকে ধারণ করতে নতুন নতুন ধারণা, চিন্তা, প্রসঙ্গের উপন্যাস ও সিনেমা নির্মাণের উপায় দেখিয়েছে এই অনুসন্ধান উপন্যাস বা কাহিনি হিসেবে বেছে নিয়েছি ইতিহাসকেই। ইতিহাসই আমাদের দান করেছে নতুন উপায়ে ইতিহাস বলার ধারণাকে। সিনেমার হলো দেখার ও পাঠ করার, অনুভব ও চিন্তা করার বিষয়। 

গদার: মুক্তি অর্জনের পথে এ ধরনের চলচ্চিত্র কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

সোলানাস: সর্বপ্রথমে, আমরা যে তথ্য এতদিন পাইনি সেগুলো এখন ছড়িয়ে দিতে পারি। যোগাযোগের উপায়, সংস্কৃতির কৌশল এতদিন ছিল ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণে বা করায়ত্তে। সে সমস্ত তথ্যই সুলভ ছিল যা তারা সুলভ করতে চাইত। সবকিছুর ওপরে মুক্তির সিনেমার ভূমিকা হচ্ছে আমাদের তথ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও বিস্তার ঘটানো। নতুন করে আরও একবার তথ্যকে গড়ে তোলা, যা তাদের ও আমাদের।  অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, আমাদের সিনেমার (মুক্তির সিনেমা, অংশগ্রহণের সিনেমা) লক্ষ্য একটি এবং কেবল একটি মৌলিক উদ্দেশ্যের প্রতিই দিক নির্দেশ করে, আর সেটি হলো মুক্তি পেতে সাহায্য করা, মানুষকে স্বাধীন করা। এ মানুষগুলো অত্যাচারিত, অবদমিত, নিষেধের বেড়াজালে বন্দি, হাতকড়া পরিহিত। দ্য আওয়ার অব দ্য ফারনেসেস একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধের সিনেমা। যে মানুষগুলো তাদের সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় রয়েছে তাদের সচেতনতা ও বোধের স্তরের উন্নয়ন ঘটাতেই এ সিনেমা। এটি কি শুধুই একটি সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক কিছু মানুষের কাছে পৌঁছাবে? হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাবানদের দ্বারা অনুমোদিত তথাকথিত গণমানুষের সিনেমা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছালেও তা শুধুই তথ্য গোপন এবং ছল-চাতুরীর একটি উপাদান মাত্র। অন্যদিকে, মুক্তির সিনেমা খুব ছোট গোষ্ঠীর কাছে পৌছালেও সেটি পৌঁছাচ্ছে মহত্তর গভীরতা নিয়ে, সত্যকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের ঔপনিবেশায়নে অবদান রাখার চেয়ে এক জন মানুষকে মুক্তিতে সাহায্য করে অবদান রাখাই শ্রেয়তর। 

গদার: কিউবানরা বলে প্রত্যেক বিপ্লবীর দায়িত্ব বিপ্লবকে সফল করা। বিপ্লবী চলচ্চিত্রকারদের দায়িত্ব কী? 

সোলানাস: কাজটিকে একটি বিপ্লবী কাজে পরিণত করতে চলচ্চিত্রকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করা, অথবা বন্দুকের মত । তোমার কাছে কী মনে হয়, এ দায়িত্ব বা প্রতিজ্ঞা পালনে কী করা উচিৎ? 

গদার: এক জন যোদ্ধার মত কাজ করা। চলচ্চিত্রকার হওয়ার চেয়ে যোদ্ধা বেশি হওয়া এটি বেশ কঠিন। কারণ চলচ্চিত্রকার নিজেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের রাজ্যে শিক্ষালাভ করেছেন।


সোলানাস: মে ইভেন্টস (১৯৬৮) করার অভিজ্ঞতাই তোমাকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ করেছে। আমি চাই তুমি লাতিন আমেরিকার বন্ধুদের সেগুলো জানাও।

গদার: মে ইভেন্টস আমাদের একটি কাল্পনিক মুক্তি দিয়েছে, একটি সত্য আরোপ করেছে যা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলতে এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে। মে ইভেন্টস-এর পূর্বে ফ্রান্সের সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা স্বচ্ছন্দ, আরামদায়ক জীবন যাপনে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু মে ইভেন্টস তাদের জন্য একটি সমস্যা তৈরি করেছে। তা হচ্ছে আমাদের জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং সেটা প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙে সেখানে অনেক নির্মাতা আছেন, যেমন ত্রুফো, যিনি অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে বলেন যে, তারা তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন করবেন না। অন্যরাও তাদের দ্বৈত নীতির খেলা খেলেই যাবে।

জ্যঁ-লুক গদার


সোলানাস: তাহলে বলতে চাও অঁতরদের সিনেমা হচ্ছে বুর্জোয়াদের সিনেমা? 

গদার: ঠিক তাই, অঁতর হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক টাইপের কিছু একটা।


সোলানাস: তুমি আদর্শগতভাবে এ ধরনের অঁতর সিনেমাকে কীভাবে মূল্যায়ন কর? 

গদার: সত্যিকার অর্থে আজকের অঁতর সিনেমা প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে জড়িত।

সোলানাস: উদাহরণ হিসেবে কে কে আসেন?
গদার: ফেলিনি, আন্তোনিওনি, ভিসকন্তি, ব্রেসঁ, বার্গম্যান…


সোলানাস: তরুণদের ব্যাপারে তোমার কী মত?

গদার: ফ্রান্সে মে ইভেন্টস-এর পূর্বে আমি নিজে ছাড়াও ত্রুফো, রিভেত, ডেমি, রেসনেইস…সবাই… ইংল্যান্ডে লেস্টার, ব্রুকস… ইতালিতে পাসোলিনি, বার্তোলুচ্চি এবং সর্বশেষ পোলানস্কি…সবাই!


সোলানাস: তুমি মনে কর এসব চলচ্চিত্রকাররা প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে জড়িয়ে গেছেন? 


গদার: হ্যাঁ, এরা জড়িয়ে গেছেন এবং এরা নিজেদের ছাড়াতেও চান না।


সোলানাস: এবং প্রগতিশীল সিনেমা তৈরিও কি প্রতিক্রিয়াশীলতার হাতে বন্দি? 


গদার: হ্যাঁ, এসব সিনেমাও প্রতিক্রিয়াশীলতার হাতে বন্দি । কারণ, এগুলো সম্ভাবনার তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান ‘নিউজরিল’ তোমার আমার মতই দরিদ্র, কিন্তু যদি সিবিএস তাদের সিনেমার প্রতিটি প্রজেক্টে দশ হাজার ডলার দিতে চায়, তারা নিঃসন্দেহে তা প্রত্যাখ্যান করবে। কারণ, তাহলে তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে জড়িয়ে যাবে… কারণ, আমেরিকান সম্প্রচার কাঠামো এতই জটিল যে তুমি এতে যাই দেখাও না কেন তার সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাবানদের পক্ষে যায়। হলিউডে তারা চে গুয়েভারাকে নিয়ে কোনো সিনেমা বানায় না, এমনকি মাও সে তুং সম্পর্কেও নয়… এগুলো ‘নিউজরিল’ সিনেমা।

আর যদি ফরাসি টেলিভিশন ‘নিউজরিল’ জাতীয় সিনেমা ফ্রান্সে দেখাতে চায় তবে এগুলো সেখানে টিকবে না। কারণ, এগুলো অন্য দেশ থেকে আগত… কিন্তু আমার সিনেমা লাতিন আমেরিকায় টিকে থাকতে সক্ষম, এখানে এর নিশ্চয়ই কিছু মূল্য আছে।


সোলানাস: আমি তোমার শেষ বক্তব্য সম্পর্কে একমত হতে পারলাম না। আমি বিশ্বাস করি যখন একটি জাতীয় চলচ্চিত্রে শোষিত শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়, এবং সেটা যদি হয় স্বচ্ছ ও গভীর, তখন মানুষ তা খুব সহজেই গ্রহণ করে, তবে ক্ষমতাবানদের জন্য সেটা হজমযোগ্য হয় না। বাইরের দেশগুলোর যেকোনো আন্তর্জাতিক তাৎপর্য সম্পন্ন ঘটনাই লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে দেখানো সম্ভব হয় বা সেগুলোকে দেখাতে দেওয়া হয়। কিন্তু একই সমস্যা যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হয়, তবে তার রাজনৈতিক চরিত্রের জন্যই তা গ্রহণ করা হয় না। এজন্যই ‘নিউজরিল’ ধরনের সিনেমা এখানে টিকতে পারে না। কিছু মাস পূর্বে আইজেনস্টাইনের স্ট্রাইক (১৯২৫) আর অক্টোবর (১৯২৭) সেন্সরের কবলে পড়েছিল। অন্যদিকে বেশিরভাগ অঁতর সিনেমা, যা বুর্জোয়াদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে, বুর্জোয়াদের সব ধরনের দৃষ্টিকোণ থেকে, সেগুলো রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক ঠিকই গৃহীত হয়। আমাদের দেশে সেগুলো হয়ে যায় নব্য সাম্রাজ্যবাদী ফিল্ম তৈরির নান্দনিক ও প্রাসঙ্গিক আদর্শ।


গদার: আমি একমত। ফ্রান্সে যখন রাজনৈতিক সিনেমা রাষ্ট্রযন্ত্রের কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র পূর্বের মত সেগুলো গ্রহণ করতে পারে না। একই রকম তোমার সিনেমার ক্ষেত্রেও। আমি নিশ্চিত এটিও গ্রহণ করা হবে না এবং সেন্সর করা হবে। শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যের ক্ষেত্রেই নয়, এটি নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রেও ঘটে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এমনটিই ঘটেছে আমার সর্বশেষ সিনেমা উইকেন্ড অ্যান্ড লা চিনিওজ-এর ক্ষেত্রে, যেটা আমি প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে থেকে বানিয়েছিলাম, যেখানে নান্দনিকতা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। আমরা অবশ্যই অঁতর সিনেমা বানাই না, বানাই বিজ্ঞানসম্মত সিনেমা। নন্দনতত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবেও পাঠ করা দরকার। বিজ্ঞানে প্রতিটি অনুসন্ধান, আর্টের মতই, একটি রাজনৈতিক দর্শনের সাথে মিলে যায়। তুমি অস্বীকার করলেও এটা সত্য। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও নন্দনতাত্ত্বিক আবিষ্কার একইভাবে বিদ্যমান। এজন্যই আমাদেরকে অবশ্যই সচেতনভাবে আমাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে হবে এবং নির্ধারণ করতে হবে আমরা কাদের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ উদাহরণস্বরূপ আন্তোনিওনি, একটি নির্দিষ্ট মূহুর্তে কিছু যুক্তিসিদ্ধ কাজ করেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে তা থেকে সরে এসেছেন; তিনি নিজেকে মৌলিক করেননি। তিনি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটি সিনেমা বানিয়েছেন যেখানে তিনি চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে যেন পরিবর্তন আসে । কিন্তু তিনি এমন কোনো সিনেমা বানান নি যেখানে শিক্ষার্থীরাই পরিবর্তনের সূচনা করে ।


পাসোলিনির মেধা আছে, অনেক মেধা, তিনি জানেন কীভাবে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর সিনেমা বানাতে হয় । তিনি তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে খুব সুন্দর কবিতা রচনা করতে জানেন, কিন্তু সেই কবিতাটি তৃতীয় বিশ্বের জন্য নয় আমি বিশ্বাস করি, কবিতাটি তৃতীয় বিশ্বের জন্য হলেই কেবল তৃতীয় বিশ্ব একদিন নিজেই এমন কবিতা রচনা করতে পারবে। তাই পাসোলিনি শুধুমাত্র এক জন কবিই, কারণ তার কবিতা লেখার হাত আছে, এর বেশি কিছু নন সিনেমা হতে হবে একটি অস্ত্র, একটি বন্দুক। তবে এখনো এমন মানুষ আছে যারা অন্ধকারে রয়েছে এবং তাদের আগে একটি পকেট টর্চ দরকার,যাতে তারা চারপাশ আলোকিত করতে পারে, এবং এটিই সার্থক তত্ত্বের ভূমিকা। আমাদের একটি মার্ক্সিস্ট বিশ্লেষণ দরকার, তত্ত্বগত বিশ্লেষণের দিক থেকে নয়, উৎপাদনের নিরিখে, যাতে সর্বত্র সিনেমা পৌঁছায়। শুধু আইজেনস্টাইন এবং জিগা ভের্তভই এ বিষয়টি নিজেদের অধিকারে রেখেছিলেন।


সোলানাস: তুমি এখন কীভাবে সিনেমা বানাও? তোমার কি কোনো প্রযোজক আছেন?গদার: আমার কখনোই কোনো প্রযোজক ছিল না। আমার এক-দুজন প্রযোজক বন্ধু আছেন, কিন্তু আমি সাধারণ প্রোডাকশন হাউজের সাথেই কাজ করেছি। এবং যখনই সেটা করেছি, এক কি দুইবার, আমি ভুল করেছি। এটা এখন আমার কাছে অসম্ভব । আমি জানি না অন্যরা কীভাবে করে। আমি আমার কিছু সাথীকে দেখি, যেমন কুনো বা বার্তোলুচ্চি, যাদের নিজেদের কাজ বাঁচাতে অনেক আপোস করতে হয়েছে। আমি এটা কখনো করিনি। এখন আমিই আমার প্রযোজক, আমার যা কিছু আছে তা নিয়েই। তাতে আমি এখন পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছি। একটু ভিন্নভাবে আমি চিত্রধারণ করি, ১৬ মি.মি-এ বা আমার ছোটখাটো টিভি সরঞ্জাম দিয়ে। এই ভিন্নতার একটি অন্য তাৎপর্যও আছে। এখানে আমি ভিয়েতনামিদের সাইকেল ব্যবহারের প্রসঙ্গটা আনব, যদিও তা কিছুটা বেমানান; ভিয়েতনামিরা সাইকেলকে যুদ্ধে বা আত্মরক্ষায় ব্যবহার করে। কিন্তু এখানে সাইকেল চালানোতে চ্যাম্পিয়ন এক জনও ভিয়েতনামিদের মতো সাইকেলের ব্যবহার করতে পারবে না। আমি ভিয়েতনামিদের সাইকেল ব্যবহারের মতো করেই ক্যামেরার ব্যবহার করতে চাই। আমার করার অনেক কিছু রয়েছে । সামনে অনেক কাজ, আমাকে তা করতেই হবে, এবং আমি অবশ্যই করব। সেজন্যই আমি এখন অনেক বেশি কাজ করি। এ বছর আমি চারটি সিনেমা বানিয়েছি। 


সোলানাস: তুমি আগে যা করতে এবং এখন যে ধরনের সিনেমা করছো—এ দুটোর মধ্যে তফাত কী? 

গদার: এখন আমি তাই বানাতে চেষ্টা করি যা রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিতে সচেতনভাবে চেষ্টা করে আগেও এ ধরনের সিনেমা করেছি তবে তা অবচেতনভাবে, আমার আবেগের জায়গা থেকে। আমি ছিলাম বামপন্থী যদি তুমি অনুমতি দাও তবে বলি, আমি কিন্তু শুরু করেছিলাম একটি ডানপন্থী অবস্থান থেকে, কারণ আমি ছিলাম এক জন বুর্জোয়া ব্যক্তি। পরে আমি মানসিকভাবে বামপন্থী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। সময়ের সাথে সাথে আমি সংসদীয় বামপন্থী থেকে বিপ্লবী বামপন্থীর অবস্থানে পৌঁছেছি, সমস্ত পূর্বানুমানকৃত অসঙ্গতিসহ মৌলিক হয়েছি।


সোলানাস: এবং সিনেমাটোগ্রাফির দিক থেকে? 


গদার: সিনেমাটোগ্রাফির দিক থেকে আমি সবসময় তাই করতে চেয়েছি যা আগে কখনোই করা হয়নি, এমনকি সেটা করেছি যখন প্রচলিত ধারার মধ্যে থেকে সিনেমা করেছি তখনও। এখন আমি এমন কাজ করার চেষ্টা করি, যা বিপ্লবী সংগ্রাম নিয়ে আগে কখনো করা হয়নি। পূর্বে আমার অনুসন্ধান ছিল ব্যক্তিগত। এখন আমি জানতে চাই, যদি আমি ভুল হই তবে কেন ভুল, এবং যদি আমি ঠিক হই তবে কেন ঠিক। যেটা হয়নি আমি তা করার চেষ্টা করি, কারণ যা হয়েছে তার প্রায় পুরোটাই সাম্রাজ্যবাদী সিনেমা। এমনকি কিউবান সিনেমা, সান্তিয়াগো আলভারেজ এবং আরো দু-এক জন ব্যতিক্রমী ডকুমেন্টারি পরিচালক বাদে প্রায় সবাই সাম্রাজ্যবাদী মডেলই অনুসরণ করেছে। সমস্ত রুশ সিনেমা দ্রুতই সাম্রাজ্যবাদী সিনেমায় পরিণত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকও হয়েছে। তবে আইজেনস্টাইন, জিগা ভের্তভ এবং মিতারকিন—যিনি একদমই অপরিচিত, এদের মতো দুই-তিন জন ব্যতিক্রমও রয়েছেন। এখন আমি শ্রমিকদের সাথে সিনেমা বানাই। আমি তাই করি যা তারা আদর্শগতভাবে চায়। নতুন সিনেমা বানাতে এটা প্রয়োজনীয়। নতুন সিনেমা প্রচলিত ধারার আবর্জনা সিনেমার মতো রবিবারের প্রদর্শনীতে পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা আবার একই সাথে নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগ্রামের পথে অনুপ্রেরণাদায়ীও। সংক্ষেপে, আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সিনেমার ভাষা অনেক বেশি এলোমেলো ও জটিল হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা বানানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যারা সিনেমার খুঁটিনাটি বোঝে না, বরং পর্দায় যা দেখে সেই ব্যাপারেই আগ্রহী। এতে করে তাদের সঙ্গে সিনেমার একটা সম্পর্কও গড়ে। 


সোলানাস: কেন তুমি এমন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা বানাও, যারা আদতে সিনেমা বানানোর সাথে জড়িত নয়?
গদার: কারণ, সিনেমা নির্মাণের ভাষার উপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এটি কিছু লোকের হাতের মুঠোয়, সেটা হলিউডে বল অথবা মাস-ফিল্মে। এর ভাষা, বক্তব্য সবই সাধারণ মানুষের উপর আরোপিত। আমি মনে করি, এটুকুই যথেষ্ট নয় যে এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী থেকে বের হওয়া আর বলা, ‘আমি ভিন্ন সিনেমা বানাই’। সেক্ষেত্রেও চলচ্চিত্র তৈরির একই আদর্শগুলো বিদ্যমান থাকে। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্যই তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা বানাতে হবে, যারা এ সুযোগ কখনো পায়নি। এটা সিনেমাটোগ্রাফির মাধ্যমে গণমানুষের নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশের একটি সুযোগ। প্যারিসে গত মে-তে ঠিক এ রকমই একটি অত্যন্ত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যখন সাধারণ মানুষ দেয়ালে লিখতে শুরু করে! এর আগে দেয়ালে শুধু বিজ্ঞাপনদাতারাই লেখার অধিকার রাখতেন। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল দেয়ালে লেখা নোংরা ও কুৎসিত কাজ। আমারও দেয়ালে লেখার আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং মে’র পূর্বে আমি তা রুদ্ধ করে রেখেছিলাম। এটা কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ধারণা নয় বরং একটি গভীর আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও নতুনভাবে শুরু করা দরকার। আমি একটা সিনেমা বানিয়েছিলাম যেখানে শিক্ষার্থীরা শ্রমিকদের সাথে কথা বলে। সাধারণত, শিক্ষার্থীরা সব সময়ই কথা বলার সুযোগ পায়, শ্রমিকরা কখনোই নয়। তাদের কথা কোথায়? সংবাদপত্রে নেই, সিনেমাতেও নেই। ৮০ শতাংশ মানুষের কথা কোথাও নেই? আমাদের অবশ্যই সংখ্যাগুরু মানুষের কথা প্রকাশ করতে হবে। সেজন্যই আমি সংখ্যালঘুদের দলে নেই, যারা পুরো সময় কথা আর কথা বলেন, অথবা সংখ্যালঘু-—যারা সিনেমা বানায়। আমি চেয়েছি আমার ভাষা ৮০ শতাংশের কথা বলুক। এ কারণেই আমি সিনেমার সাথে জড়িতদের নিয়ে সিনেমা বানাতে চাইনি। চেয়েছি যারা অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের নিয়ে সিনেমা বানাতে।

(লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র সমাচার’ সংখ্যা থেকে নেয়া হয়েছে)

Leave a comment