Skip to content Skip to footer

উত্তরা: রূপকের আধারে আমাদের সময়

উত্তরাকে (২০০০) আমি রূপক বা রূপকাভাস হিসেবে বিবেচনা করতে চাই। প্রকৃতপক্ষে চলচ্চিত্রে রূপক ব্যবহার করা হয় জটিল ও দীর্ঘ গল্প বর্ণনার ছলে একটি অন্তর্নিহিত ভাবের প্রকাশ করার জন্য; এই নিহিতার্থের সাথে চলচ্চিত্রের মূল গল্পের কোনো আপাত সম্বন্ধ থাকে না। তবে উত্তরা এই নিহিতার্থের আড়ম্বরে দর্শককে সিনেমা উপভোগ থেকে বঞ্চিত করে না। কারণ এর দৃশ্যমান গল্প খুব সাদামাটা, দৈনন্দিন ঘটনার আবরণে ঢাকা; ব্যক্তিভেদে গল্পের ব্যাখ্যা ভিন্নতর হতে পারে। প্রথমে আমি এর রূপক আলোচনা করে পরবর্তীতে দৃশ্যমান গল্পের ব্যাখ্যায় যাব।

“এই চলচ্চিত্র আমার দেশের, আমার সময়ের। সিনেমা জুড়ে আমি দেখাতে চেয়েছি—আমাদের পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, সুন্দর আর কার্যের মধ্যকার নিয়ত দ্বন্দ্ব আর একটি শাশ্বত স্বপ্ন। উত্তরা যতটা না নৃশংসতার রূপ দেখায়, তার থেকে বেশি শুদ্ধতা, শিষ্টতা আর সরলতাকে ধ্বংস করার অশুভ শক্তির মিলিত হওয়ার গল্প বলে। আমাদের মনে করিয়ে দেয়া হয়, উন্নয়নশীল বিশ্বে এমন হাজার হাজার মানুষ আছে, যাদের নিজ বলয়ের বাইরের অবস্থা, এমনকি আধুনিক সমাজ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। তারা অশিক্ষিত, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীন এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারপরেও, তথাকথিত আধুনিক মানুষ না হতে পারা এই জনগোষ্ঠীই পরস্পরকে ভালোবাসবার আর নির্লিপ্তভাবে সকল ঝঞ্ঝা সহ্য করার অসাধারণ মানবিক গুণ ধারণ করে। প্রাচ্যের মৌলবাদের ধ্বজাধারীরা মূলত পশ্চিমে যারা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে জাতিগত নিধনে ইন্ধন যোগায়, তাদেরই আরেক রূপ। এ সকল বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমার বেদনামথিত প্রতিক্রিয়া উত্তরা।”—বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত 

।।১।।

কেউ যদি আমাদের সমাজের অশুভ দিকগুলোর একটি সারমর্ম দৃশ্যায়ন করতে চায়, তবে তাতে অবধারিতভাবে যুক্ত হবে, নারী ধর্ষণ ও হত্যা, নিপীড়িত দুর্বল জনগোষ্ঠী ও জাতিসত্ত্বা নির্বিশেষে জনমানুষের হিতকারীদের হত্যা ইত্যাদি। বুদ্ধদেব ঠিক এমনই এক দৃশ্যায়ন করেছেন, যার পাত্রপাত্রীদের মধ্যে একজন নারী, একজন বামন আর একজন পাদরি খুন হয়। বুদ্ধদেবের মাধ্যমেই ভারতের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলীর দিকে আঙুল তুলেছেন; যা গোটা বিশ্বকে বিমূঢ় করেছিল। তবে তিনি এই চলচ্চিত্রে গোয়েন্দা বিভাগের বেতনভুক্ত কর্মচারী সেজে, রহস্য উদঘাটন করে, তদন্ত রিপোর্টে করণীয় লিপিবদ্ধ করতে বসেননি। তার প্রকাশভঙ্গি কাব্যিক। ফলে তিনি সেই সত্য ঘটনাগুলোর ঘনঘটার ঊর্ধ্বে গিয়ে গভীর মানবিক সংবেদনশীলতার সাথে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পেরেছেন। এমন চলচ্চিত্রের জন্য অনুসন্ধান আবশ্যিক, কিন্তু নির্মাণে কাব্যিক উপস্থাপনই বাঞ্চনীয়। কেননা, কাব্যময়তার ছোঁয়া ছাড়া, এসব ঘটনাবলি সমাজের দেহমনে ছড়িয়ে থাকা দগদগে ঘা-গুলোকে কেবলই উসকে দেয়।

আমাদের এ সাম্প্রতিক সময়কালের প্রতিরূপ হিসেবে উত্তরা দর্শকের মাথায় কিছু দৃশ্য গেঁথে দেয়, যা দর্শকের মানসে অবিরাম বিশ্লেষিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে দর্শককে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ঘটনা বিচার করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি করে। মানুষের স্মৃতির অদ্ভুত একটা আচরণ হলো, কোনো ঘটনা স্মৃতিতে সংরক্ষণ করতে গেলে, এটি নির্দিষ্ট বাস্তবতার নিরিখে কেবল মাত্র একটি অংশ সামনে নিয়ে আসে; তখন পুরো ঘটনাটা একটি মাত্র সত্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, “ভাবের সাথে ভাবুকের সম্পূর্ণ ব্যবধান ঘটিলেও যেমন চলে না তেমনি একেবারে অব্যবধান ঘটিলেও কাব্যরচনার পক্ষে তাহা অনুকূল হয় না।… রচনার বিষয়টাই যদি তাহাকে ছাপাইয়া কর্তৃত্ব করিতে যায়, তবে তাহা প্রতিবিম্ব হয়, প্রতিমূর্তি হয় না।” প্রতিমূর্তি তখনি হয়, যখন বিষয়কে মূর্তিমান করে তোলা হয় নতুন আঙ্গিকে।

যাহোক, রূপকার্থ বা অন্তর্নিহিত ভাব টিকিয়ে রাখার জন্য গল্পকে প্রথমত প্রাসঙ্গিক ও বাস্তব হতে হবে। উত্তরা সিনেমাটি বাস্তবিক বটে, তবে দর্শকের কাব্যরস আস্বাদনের মালমসলাও জুড়ে দেয়া হয়েছে। একদিকে এর চিত্রায়ণ বাস্তবতায় ঠাসা, অন্যদিকে গল্পটি এক নির্মল ছান্দিক স্থানে নির্মিত যা কখনো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষায় রূপালি পর্দায় চলচ্চিত্রিক ইমেজের বিচারে প্রথম দশটি চলচ্চিত্রের মাঝে সন্দেহাতীতভাবে উত্তরার নাম থাকবে। লোকেশন নির্বাচন ও তাতে যথার্থ চিত্রায়ণ এ চলচ্চিত্রের কাব্যিক ভঙ্গিমাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। এর মাঝে জনা দশেক নৃত্যশিল্পীর একটি দল জীবজন্তুর মুখোশ পরে পাঁচ-ছয়বার পর্দায় আবির্ভূত হয়। এই নৃত্য পরিবেশনার মর্মার্থ নিয়ে এই রচনার পরবর্তী অংশে আলোচনা করছি।

এক অরণ্যানীর মধ্য থেকে মোটামুটি একটা স্থিতদৃশ্য দিয়ে উত্তরা শুরু হয়। আপনি বনানীর মধ্যে জীবন্ত, মূর্তমান, প্রাণরসপূর্ণ ইন্দ্রানুভূতি পাচ্ছেন। সব স্থির, স্বাভাবিক। শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। কিন্তু এই স্থিতি কেবলই বাহ্যিক। এই বনানী প্রতিনিয়ত রাজার মতো শেকড় বিস্তার করছে, বাড়ছে। সাথে পাখির কূজন। আবহ সংগীত নির্মলতার আবাহন দেয়। চিত্রপটের সঙ্গে এই সুর, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক মন্তাজ সৃষ্টি করে, যে আখ্যান সমগ্র চলচ্চিত্রে আবর্তিত হয়। উপক্রমণিকার এ দৃশ্য গল্পের এক সন্ধিক্ষণে পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং উপপরিক্রমাও টানে। একই সাথে শান্ত ও উচ্ছ্বসিত অন্তর্জগতের প্রতিচ্ছবি পুরো চলচ্চিত্রের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে, এর মেজাজ আর ছন্দের সাথে মিল রেখেই। এ ধরনের চলচ্চিত্রে চিত্রপটে জোর দেয়া জরুরি, নইলে সেটা দর্শককে বিরক্ত আর বিষণ্ণ করে তোলে; এই সিনেমা এতে ভালোভাবেই উৎরে গিয়েছে। এর চিত্রপটে গল্পের সাথে সত্য ও সুন্দরের সহনশীলতার উপর অগাধ বিশ্বাসের দর্শনও সমান তালে এঁকে চলে। মনে হয় যেন, বুদ্ধদেব বলতে চাইছেন, এ বিশ্ব এক ধরনের কুরুক্ষেত্র। সবাই যুদ্ধ করে চলছে। দুর্বৃত্তের নিগ্রহে শিষ্টের আর্তচিৎকারে কম্পিত চারদিক। তবু জীবন চলছে, ভালো মানুষ বেঁচে আছে—এটাই উত্তরার মূল দর্শন।

জঙ্গল, রেলস্টেশন, বলীখেলার মাঠ, খোলা প্রান্তর আর একটা গির্জা নিয়ে উত্তরার মঞ্চ সাজানো হয়েছে। পাত্রপাত্রীর মধ্যে আছে—দুই মল্লযোদ্ধা, নিমাই আর বলরাম; ক্রিশ্চান পাদরি আর তার দত্তক সন্তান; তিন দুর্বৃত্ত; সময় পরিক্রমায় বলরামের বধূ হওয়া উত্তরা; অপর এক নারী, যে দুর্বৃত্তদের লালসার শিকার; জনা বিশেক বামন, যাদের একজন আবার রেলের দারোয়ান; জনা দশেক নৃত্যশিল্পীর দল; চারজন উজ্জ্বল আগামীর প্রত্যাশী ধর্মান্তরিত ক্রিশ্চান এবং একটা ট্রেন, যার ভূমিকা এই গ্রামের সাথে বাইরের জগতের সন্ধি করে দেয়া।

উত্তরা বেশ কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের অমর সৃষ্টির সাথে প্রতীকধর্মী যোগসূত্র স্থাপন করে নির্মিত। দুই মল্লযোদ্ধা অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রেমচাঁদের গল্পাবলম্বনে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের শতরঞ্জ কি খিলাড়ির (১৯৭৭) দুই দাবাড়ুর কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও উত্তরা এবং শতরঞ্জ কি খিলাড়ির এই দুই খেলোয়াড় ছাড়া আর কোনো সংস্রব নেই। এর বাইরেও বুনুয়েলের ভিরিদিয়ানার (চার বয়স্কলোকের ধর্মান্তরিত হওয়া), তারকাভস্কির (খোলা প্রান্তরে নিঃসঙ্গ বৃক্ষ) আর সত্যজিতের পথের পাঁচালীর (১৯৫৫) (উত্তরার ডাকবাক্সে কান পেতে শোনা) প্রতীকী উল্লেখ আছে।

Film- Uttara

আমি ইতিমধ্যে এই সিনেমার চিহ্নপ্রতীকের ব্যবহার নিয়ে লিখেছি। এর চিত্রনাট্যও প্রশংসার দাবিদার। এর গল্পের প্রেক্ষাপট চলচ্চিত্রের মুক্তির সমসাময়িক নয়। তবুও দর্শকের মনোযোগ কখনো মূলগল্প থেকে সরে যায় না। নির্মাতা টুকরো টুকরো ঘটনা দৃশ্যায়ন করেছেন; সেখান থেকেই দর্শক সচেতনভাবে পুরো গল্পকে নিজের মতো সাজিয়ে নিতে পারেন। এই টুকরো ঘটনাগুলোর উপস্থাপন, সময় ক্ষেপণ এবং বৈশিষ্ট্য (ক্যামেরার কোণ, দূরত্ব) নির্মাতার স্বকীয়তার পরিচয় দেয়। উত্তরায় দৃশ্যচয়ন ও উপস্থাপন চলচ্চিত্র মাধ্যমে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর অসাধারণ পরিপক্কতা প্রকাশ করে, যদিও এ যাবত কালে তার নির্মিত চলচ্চিত্র সংখ্যা মাত্র বারো। তবু বলতেই হয়, সমরেশ বসুর ‘উত্তরা’ গল্প বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর হাতে নতুন আঙ্গিক ও অর্থ পেয়েছে।

।।২।।

গ্রামের ছোট্ট রেলস্টেশনটিই বলরাম ও নিমাই এর আবাস, এখানেই তারা সর্বস্ব নিয়ে বাস করে। দুজনেরই কুস্তি খেলার নেশা। তারা একসাথে কাজ করে, রাধে, খায়, নারীসঙ্গের স্বপ্ন দেখে আর কুস্তি খেলে। বলরামের বৃদ্ধ আত্মীয়া উত্তরার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। নিমাই বলরামকে হিংসা করে আর উত্তরার উপস্থিতিতে বিরক্ত হয়; কিন্তু পরিশেষে উত্তরাকেই কামনা করে। দুই বন্ধুর কুস্তি এক পর্যায়ে খুনের নেশায় পরিণত হয়। এরই মধ্যে গ্রাম তিন আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটে, তারা কোথা থেকে এসেছে যা কোথায় যাবে তা কেউ জানে না এবং মনে হয় মদ আর নারীর আসক্তি ছাড়া তাদের জীবনে আর কিছু নেই। এক পর্যায়ে স্পষ্ট হয়, তাদের পাঠানো হয়েছে স্থানীয় পাদরিকে হত্যার উদ্দেশ্যে। পাদরি গ্রামের এক অনাথ ছেলেকে দত্তক নেয়। ছেলেটি ছিল হিন্দু পরিবারের, তাই স্থানীয় হর্তাকর্তারা দাবি করে, পাদরি তাকে খ্রিষ্টীয় বানিয়েছে আর তার নামও দিয়েছে খ্রিষ্টীয়, ‘ম্যাথু’। গ্রামের কাছেই এক গোষ্ঠী বামনের বাস। তাদের একজন রেলস্টেশনে কাজ করে, যার সাথে উত্তরার পরিচয় হয়। সেই বামন উত্তরাকে ভালো মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর অন্যদিকে পাদরির পক্ষে আছে খাদ্যাভাবে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত চার বুড়ো, যাদের স্বপ্ন আমেরিকা যাওয়ার।

তিন ভিনদেশি গ্রামেরই এক ব্যক্তির সাথে আঁতাত করে পাদরিকে আগুনে পুড়িয়ে মারে। চার্চের স্তম্ভের সাথে বেঁধে গায়ে পেট্রোল ঢালার সময় উত্তরা তাদের দেখে ফেলে। সে তার স্বামীর কাছে ছুটে যায় জানানোর জন্য। কিন্তু বলরাম আর নিমাই তাদের মরণপণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। উত্তরা পাদরিকে বাঁচানোর জন্য তাদের কাছে মিনতি জানায়। কিন্তু তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। চার্চে অগ্নিশিখা দাউদাউ করে ওঠে এবং পাদরির মৃত্যু হলে উত্তরা ফিরে যায়। তার অমানুষ স্বামীর কাছে আর কোনোদিন ফিরে না আসার পণ করে। রেলের বামন দারোয়ান তাকে তার বউ হয়ে বামনদের গ্রামে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ঠিক সেই সময় তিন ভিনদেশি হত্যার একমাত্র সাক্ষীর খোঁজে আসে। কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করার পর বামন আর উত্তরা উভয়ই তাদের হাতে প্রাণ দেয়।

পাদরিকে জীবন্ত পোড়ানোর দৃশ্যে আমাদের নিকটাতীতের এক বাস্তব ঘটনার সাদৃশ্য দেখা যায়। এতটাই সদৃশ যে বুদ্ধদেবের সংবেদনশীল নির্মিতি ব্যতীত এই দৃশ্য হজম করা সম্ভব ছিল না। সব ধরনের ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকে পাশ কাটিয়ে এটি বরং দর্শকের মনে ভাবনার উদ্রেক করে। আবার পাদরিকে জীবন্ত পোড়ানো গল্পের মূল উপাদান নয়। এর শিরোনাম উত্তরাও বেশ গুরুত্ববহ, ইংরেজিতে দ্য রেসলার। বলরাম আর নিমাই উভয়েই উত্তরার জন্য কুস্তি করে, সেখান থেকে এক অর্থ বহন করে উত্তরার নামকরণ। আবার বলরাম আর নিতাইয়ের ভাষ্যমতে দুনিয়াটাই এক মল্লযুদ্ধ মঞ্চ, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো লড়াইয়ে লিপ্ত, তাই দ্য রেসলার

বলরাম আর নিমাইয়ের সম্পর্কের এই টানাপোড়েন যা বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতার পরিণত হয়, এটি শিক্ষামূলক। একই সাথে তাদের বন্ধুত্ব আত্মনিমগ্ন ও নিষ্ফলা (তারা পাদরিকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি) এবং দিনশেষে তা ধ্বংসাত্মক কেননা একই সাথে তারা পরস্পরকে ও তাদের ঈপ্সিত অর্জন হারায়।

।।৩।।

তর্কসাপেক্ষে এ কথা বলা যায় যে, গল্পের মূল দ্বন্দ্ব হলো খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতির সাথে আবহমান ভারতের সাংস্কৃতিক বিভেদ। এখানে বিভিন্ন বিপরীত যুক্তি দেখানো যায়। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত চার বৃদ্ধ আমাদের মনোযোগ টানে না। কেননা, যিশু নিজেই তার রুটি ভিক্ষা দেওয়ার দৃশ্য দেখে অনুসারী হতে আসা ব্যক্তিদের ভর্ৎসনা করেছেন। যা হোক, নশ্বর মানুষ তার অবিনশ্বর ঈশ্বরকে শুধু তার প্রয়োজনে স্মরণ করতে পারে, এটা অপমানজনক। ম্যাথু ওরফে রাখালের বিষয়টি আবার ভিন্ন যা সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। অনেকটা পরাবাস্তব ঘরানায়, নৃত্যশিল্পীরা পুরো গল্পে সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নিয়ে আসে। নৃত্যশিল্পী আর তাদের গানে শাব্দিক বার্তার খোঁজ করলে আপনাকে গ্রিক ট্র্যাজেডির মতোই হতাশ হতে হবে। এই নৃত্য, গান বা মুখোশে আপনি কোনো নির্দিষ্ট আঞ্চলিক সত্ত্বা খুঁজে পাবেন না। প্রকৃতপক্ষে এ গান ও নাচ এখানে সংস্কৃতির প্রতীক মাত্র, যা পুরো গল্পের পটভূমি হয়ে বর্তমান ছিল।

Film- Uttara

যখন পাদরি মারা যায়, এক খুনী ম্যাথুকে ধাওয়া করে। ম্যাথু পালিয়ে একটা গাছের ডালে চড়ে বসে। এরপর নৃত্যশিল্পীরা সেখানে উপস্থিত হয়, তাদের কেউ খুনিকে বাধা দেয়, বাকিরা ম্যাথুকে ঘিরে ধরে এবং তাকে মুখোশ পরিয়ে দেয়, যা তাদের সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে। ম্যাথু স্বীয় আদি সত্ত্বাকে পুনর্বার আবিষ্কার করে এবং ‘রাখাল’ (তার পিতৃপ্রদত্ত নাম) হয়ে উঠে। কিন্তু সে কি রাখাল হিসেবে পুনরায় হিন্দু হয়ে যায় নাকি খ্রিষ্টান থাকে? এর ভার তার নিজের উপরেই থাকে, তবু সে শেষ পর্যন্ত নিজেকে খুঁজে পেয়ে স্বাধীন হয়।

উত্তরা চলচ্চিত্রটি স্মৃতিশক্তির ভালো পরীক্ষা নেয়। বুদ্ধদেব সম্ভবত বলতে চেয়েছেন কেবল সংস্কৃতিই কারো নিগূঢ় স্বকীয় পরিচয় বহন করে না, বরং এটি প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া। প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষ কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না, কোনো না কোনো সংস্কৃতির অংশ তাকে হতেই হয়। সংস্কৃতি ব্যক্তিভেদে সকলের অস্তিত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়। কিন্তু সংস্কৃতির নিজেরই পরম অস্তিত্ব নেই। ক্রিশ্চান দর্শন কিংবা হিন্দু দর্শন উভয়ক্ষেত্রেই স্বকীয়তা অর্জনের জন্য স্বীয় সত্তাকে মেরে ফেলতে হয়। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতির অস্তিত্বও বিলীন হয়। উত্তরায় যেভাবে দেখানো হয়েছে, এ প্রক্রিয়া ততটা সহজ নয়।

সহায়:

ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কোয়াটারলি, বর্ষ ২৭, সংখ্যা ৩ (বর্ষা, ২০০০) এ প্রকাশিত গ্যাস্টন রবার্জের ‘Uttara: An allegory for our time: Uttara (The Wrestlers), a film by Buddhadeb Dasgupta’ শীর্ষক প্রবন্ধ হতে অনূদিত।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)

Leave a comment