Skip to content Skip to footer

“আমি সব সময় একটা কথা বলি, টাকা ভূতে জোগাড় করে।”—বিজন ইমতিয়াজ

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা: ইশতিয়াক আহমেদ

গুপী বাঘা প্রোডাকশন নির্মিত মাটির প্রজার দেশে (২০১৮) একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির পরিচালক বিজন ইমতিয়াজ এবং প্রযোজক আরিফুর রহমান। ২০১৬ সালে ফিল্মটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় সিয়াটল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ২০১৬ সালেই মাটির প্রজার দেশে  শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা ছবি’ হিসেবে পুরস্কার জয়লাভ করে। স্বাধীন ধারার এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজ সহজ ছিল না। চলচ্চিত্রটির শুটিং সম্পন্ন করতে দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় লাগে এমনকি অর্থাভাবে এক পর্যায়ে পরিচালক বিজন ইমতিয়াজ পৈত্রিক জমি বিক্রি করে দিয়ে ছবির কাজ সম্পন্ন করেন। মাটির প্রজার দেশে এখন পর্যন্ত বিশের অধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গুণী শিল্পী সাত্যকি ব্যানার্জীর লেখায় ও সুরে এবং অর্ক মুখার্জীর সংগীতায়োজনে মাটির প্রজার দেশের একমাত্র গান, ‘কবিতা’।

ফ্ল্যাশব্যাক: শুরুটা কীভাবে হলো? 

বিজন: পুরোনো স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা সেটাকে একটা গল্পে রূপ দেই। কিন্তু আমাদের জীবনে ব্যাপারগুলা সেভাবে ঘটে না। অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে ঘটতে আসে। ঘটনাকে গল্প করে ফেলার সময় আমরা মনের মাধুরী মেশাই। মাটির প্রজার দেশের নির্মাণের ইতিবৃত্ত অনেকটা এরকম, আমি আমেরিকা যাওয়ার পর মাথায় সিনেমার ভূত চাপে, তখন একটা পত্রিকায় পড়ি আরিফ ডকুমেন্টারি করছে। ও আমার স্কুলের বন্ধু, অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। এতদিন পর ঘটনাচক্রে আমরা একই কাজ করছি। তারপরেই ওর সাথে আবার যোগাযোগ হয়। এই সিনেমার গল্পটা আমার মাথায় ছিল। আরিফকে বললাম, “তুই যদি আমার সাথে থাকিস, তাহলে সিনেমাটা করব, না হলে করব না”। আরিফ চাকরি ছেড়ে দিল। এরপরেই শুরু। এটা ছিল ২০১০ এর কথা। 

ফ্ল্যাশব্যাক: মাটির প্রজার দেশের গল্প মূলত কোন কনটেক্সট থেকে এসেছে? 

বিজন: আমি সাধারণত কনটেক্সট ভেবে গল্প লিখি না। লক্ষ্মী চরিত্রটা মূলত আমার মায়ের নানু। ১৯০৭ সালে উনার সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়। উনি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে পালকি থেকে নেমে পালায়। সারাদিন গ্রামগঞ্জ খুঁজে উনাকে ফিরিয়ে আনা হয়। সেখান থেকেই গল্পটা মাথায় আসে। ক্যারেক্টার স্টাডিজ আমার খুব ইন্টারেস্টের জায়গা। ক্যারেক্টার স্টাডিজ ঠিকমত করতে গেলে তার মধ্যে রাজনীতি আসে, সমাজ আসে, এমন অনেক কিছুই চলে আসে। কিন্তু সরাসরি ‘আমি এই বিষয়ে কথা বলব’, ‘এই বিষয়ে গল্প লিখব’ এমনটা ভেবে আমার গল্প তৈরি হয় না। কোনো ক্যারেক্টার আমাকে ইন্সপায়ার করলেই আমি শুরু করি। মাটির প্রজার দেশের ক্ষেত্রে সেটা হলো ‘লক্ষ্মী’, যে বাস্তবজীবনে আমার নানুর মা।

ফ্ল্যাশব্যাক: তার মানে কি লক্ষ্মীর পালকি থেকে পালানোর দৃশ্যটা কল্পনা ছিল না?

বিজন: লক্ষ্মীর পালকি থেকে পালানোর দৃশ্যটা আমরা যেভাবে উপস্থাপন করেছি—সেটা আমার কল্পনা। কিন্তু ঘটনাটা বাস্তব। আমার বড়মার সাথে আমার দেখা হয়—তখন তার বয়স প্রায় একশ বছর। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছেন, এর বেশি ইন্টারেকশন হয়নি। আমার নানুর কাছ থেকে তার গল্প শুনেছি, উনি খুব চঞ্চল ছিলেন এবং সাত বছর বয়সে বিয়ের পালকি থেকে পালিয়েছিল। আমি বাল্যবিবাহের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আগ্রহী নই। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতের অনেক জায়গায় এটা এখনও নির্মম বাস্তবতা। প্রি-প্রোডাকশনের কাজে রাজশাহীতে আমাদের লোকেশন স্টাফ আমাকে নিয়ে ঘুরছিল। তখন এক বিয়েবাড়িতে আমি কৌতূহলবশত মেয়ের বয়স জিজ্ঞেস করি। জানতে পারি সে মেয়ের বয়স ১২।

ফ্ল্যাশব্যাক: গ্রামের ভিজ্যুয়ালাইজেশন করার জন্য কোন পদ্ধতিতে এগিয়েছেন?

বিজন: আপনি যদি মাটির প্রজার দেশে দেখে থাকেন, সেখানে কিন্ত কোনো সময়ের উল্লেখ নেই। গল্পটা ১৯৫০ এর নাকি এই মুহর্তের—সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা একজন মানুষের বন্ধুকে হারানোর গল্প। কিছু কিছু ক্রাফট দেখে আপনি সময়কাল ধারণা করতে পারেন, কিন্তু পুরো সিনেমায় নির্দিষ্ট কোনো সময় ধরে রাখা হয়নি। আমি শহরে বড় হয়েছি। তবে আমার গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর । মাসখানেক পরপরই আমরা গ্রামে যেতাম। সেই অভিজ্ঞতা কাজ করেছে। তবে মূলত ভিজ্যুয়ালাইজেশনের ক্ষেত্রে মাটির প্রজার দেশে একটা কাল্পনিক জগৎ। সিনেমা দেখে আপনি বুঝবেন না—সেটা বাংলাদেশের ঠিক কোন অঞ্চল। সেটা আপনি ভাষা দেখেও বুঝবেন না—এখানে খুবই সাধারণ বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া আমি আর আরিফ রাজশাহীতে সাত মাস প্রি-প্রোডাকশনে কাটিয়েছি। রাজশাহীর এ এলাকাটা এত সুন্দর, আপনি এখানে ক্যামেরা যেখানে ধরবেন সেখানেই শুট করতে পারবেন। দৃশ্যায়নে ঐ এলাকাটারও প্রভাব আছে। কিন্ত এই সিনেমা মোস্টলি ইন্সপায়ার্ড বাই দ্য স্পেস। আর সিনেমাটোগ্রাফির ক্ষেত্রে আমার কাছে মুখ্য—ইমোশন। আপনি খেয়াল করে দেখবেন পুরো সিনেমায় তিনটা শট ছাড়া কোনো মুভিং শট নাই। প্রত্যেকটা শটে আমার চেষ্টা ছিল, এই মুহূর্তে গল্পের ইমোশন কী এবং আমি দর্শককে কোন মুহূর্তে ধরতে চাই। দেখবেন লক্ষ্মীর একটা পয়েন্ট অব ভিউ শট বাদে ক্যামেরা প্রথমবার মুভ করে ও পালকি থেকে লাফ দেওয়ার পর। এই সিদ্ধান্তগুলো মূলত গল্প থেকে আসা। কিন্তু অনেক কিছুই আমাদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল। এর আগে প্রি-প্রোডাকশনে ঐ এলাকায় কোথায় কী আছে সেটা আমরা খুব ভালোভাবে জেনে রেখেছিলাম। তাই শুটিংয়ে আমাদের ইন্সটিংক্ট ব্যবহার করতে সমস্যা হয়নি।

ফ্ল্যাশব্যাক: সিনেমায় আমার মনে হয়েছে, লক্ষ্মী আর জামালের চোখ দিয়ে সমাজে মায়েদের অসহায়ত্ব দেখানো হয়েছে। লক্ষ্মীর বিয়েতে মায়ের সিদ্ধান্তগত আত্মসমর্পণ, জামালের মায়ের প্রতি সমাজের আচরণ কিংবা তাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়া… এক্ষেত্রে কি আপনার সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা উপস্থাপনের অভিপ্রায় ছিল?

বিজন: গল্পে পুরুষতান্ত্রিকতা যা দেখানো হয়েছে, তা আসলে ছোটবেলা থেকে দেখে আসা। রূপপুরে আমাদের একটা জমি ছিল, বাবা আমার মাকে জিজ্ঞেস না করেই বিক্রি করে ফেলে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে মায়েরা সাধারণত চাকরি করে না। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, এই কারণে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় মায়েরা ভাল-মন্দ কিছু আরোপ করতে পারে না। আমি জীবনে যা দেখেছি, সে অভিজ্ঞতাগুলো সিনেমার মধ্যে আলটিমেটলি চলে এসেছে।

ফ্ল্যাশব্যাক: বিয়ের দৃশ্যে দেখা যায়, তিন-চার জন অতিথি নিয়ে তালুকদার সাহেব লক্ষ্মীর বাড়িতে আসেন। কারণটা কি ফাইন্যান্সিয়াল না ইন্টেনশনাল?

বিজন: দেখুন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সিনেমাটা একটা সোশ্যাল রিয়েলিসিজম। বাস্তবতা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আসলে এটা সোশ্যাল রিয়েলিজম না। কারণ এটা আসলে অনেকটা স্বাপ্নিক ব্যাপার। পুরো গল্পটা হচ্ছে জামাল আর লক্ষ্মীর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে, অনেক দিন পরে ওরা হয়তো বা বড় হয়ে গেছে, ওরা ভাবছে এ সময়টা কেমন ছিল! বড়রা যেভাবে একটা ঘটনা মনে রাখে বাচ্চারা সেভাবে রাখে না। বাচ্চারা শুধু ততটুকুই মনে রাখে যতটুকু তার মনে রাখা দরকার, অথবা তার ভালো লাগে। তাই অনেক ডিটেইলস এটার মধ্যে নেই। এই ডিটেইলগুলো আমরা বাস্তবে দেখি। প্রথম দৃশ্য থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যেন সিনেমাটাকে পুরোপুরি বাস্তব না মনে করে। এ স্বাপ্নিক উপাদানগুলো যাতে অবচেতন মনে মানুষ কানেক্ট করতে পারে সে কারণে অনেক ডিটেইলস এখানে রাখা হয়নি। এইটার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে হুজুর চরিত্রটা। কিছু কিছু জিনিস আবার বেশ অবাস্তব। যেমন জামাই ডিম ছাড়া ভাত খাবে না। এইধরনের অবাস্তব ব্যাপার বেশ কিছু দৃশ্যেই আছে।

ফ্ল্যাশব্যাক: আপনাদের অর্থায়ন প্রক্রিয়া কী ছিল?

বিজন: এই সিনেমার অর্থায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় ইউসিএলএতে, আমরা কিছু অনুদান পেয়েছিলাম। এরপর আমরা কীভাবে সিনেমাটা শেষ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি নিজেরাও জানি না। আমরা জমি বিক্রি করলাম, আবার লোকেশনে গিয়ে হঠাৎ টাকা শেষ—র‍্যান্ডমলি আমার পুরোনো এক বন্ধু কিছু টাকা ধার দিল। এরকম অনেক ঘটনা। আমি সব সময় একটা কথা বলি, “টাকা ভূতে জোগাড় করে”। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঐরকম হয়েছে।

ফ্ল্যাশব্যাক: কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাছে কি যাননি?

আরিফ: এক্ষেত্রে কিছু তিক্ত  অভিজ্ঞতা হয়েছিল ঐসময়। একদম সরাসরি কারো কাছে যাইনি। কারণ আমরা যে ধরনের ছবি বানাচ্ছি বা যে ঘরানার এক্সপ্রেশন আমরা ভাবছি, সেটা প্রকাশ করার জন্য স্বাধীনতাটুকু বড় কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেবে না। নাম প্রকাশ না করে বলি, একটা বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের গল্প শুনে ছবিটা প্রডিউস করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু, সেক্ষেত্রে ঐ সমস্যা ছিল। প্রথমত, ওরা কোনো না কোনোভাবে বাণিজ্যিক পার্সপেক্টিভে গল্প বা চিত্রায়ণ ম্যানিপুলেট করতে বলে। দ্বিতীয়ত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকাররা ছবি বানানোর পর ওরা পুরো ছবিটাকে কপিরাইটের প্যাঁচে খেয়ে ফেলে। কিন্তু এখন এটার লোকাল ডিস্ট্রিবিউশন, ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন বা ফেস্টিভাল রান সবকিছুতেই আমাদের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন আছে। তবে আমরা বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে ইকুইপমেন্ট সাপোর্ট চেয়েছিলাম। একদম ফ্রি নয়, ২৫% ডিসকাউন্টে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা দেয়নি। কোনো ধরনের লাভজনক চুক্তি ছাড়া তারা ভালো গল্পের জন্য কিছু স্যাক্রিফাইস করতে ইচ্ছুক না। তাদের সাথে আমাদের সিনেমার চেতনা মেলে না। আমাদের পুরো ক্রিয়েটিভ স্বাধীনতা ছাড়া আমরা কোনো ছবি করব না।

বিজন: আমরা হয়তো একটা ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করেছি, কিন্তু এটা খুব কঠিন কারণ আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। আমাদের নব্বই ভাগ ফিল্মমেকাররা মধ্যবিত্ত, অথবা প্রতিকূল একটা জায়গা থেকে স্ট্রাগল করে আসা। তাদের পক্ষে বেশিক্ষণ কম্প্রোমাইজ না করে থাকা সম্ভব না। বাইরের ফেস্টিভালগুলোতে গিয়ে দেখলাম, বিশ্বে যারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম বানায়, তাদের ছবিগুলো একটা সার্টেইন ল্যাংগুয়েজ ক্রিয়েট করে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কম্প্রোমাইজ না করে। আমি আরেকটা ভালো উদাহরণ দিতে পারি, যেমন: রিমা দাস আসামের একটা গ্রামে কয়েকটা তরুণকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছে, ভিলেজ রকস্টার (২০১৭)। তেমন আহামরি কিছু না। এই তরুণদের টেকনোলজিক্যাল ওরিয়েন্টেশন নেই, ওদের ফ্যাসিনেশন মিউজিক, গিটার! অথচ তাদের কোনো গিটার নেই। ওরা প্রকৃতিতে পাওয়া উপাদান দিয়েই তারের যন্ত্র তৈরি করে—এক ধরনের মক ব্যান্ড বানিয়ে ফেলেছে। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং তরুণদেরও কিন্তু মিউজিকের প্রতি এক ধরনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাপ্রোচ ছিল। ওরা গান লিখছে। ওদের গিটার কেনার টাকা নেই—তারপরও ওরা গিটার বাজাচ্ছে যেটা থেকে হুবহু গিটারের আওয়াজ বেরোচ্ছে না, কেমন তালপাতার বাঁশির আওয়াজ। আবার যে ভদ্রমহিলা এই ছবিটা বানাচ্ছেন, ওনারও কোনো অ্যাকাডেমিক ওরিয়েন্টেশন নাই, কোনো টেকনিক্যাল সাপোর্ট নাই, শুধু হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে ঘুরছেন। তার মোটামুটি একটা সংকল্প ছিল যে—আমি এরকম একটা সিচুয়েশনে, আমার সামর্থ্য দিয়ে এই সিনেমাটা শেষ করতে চাই। শেষ পর্যন্ত কিন্তু ছবিটা শেষ হয়েছে এবং বিশ্ব জয় করেছে।

ফ্ল্যাশব্যাক: এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

বিজন: আমার মনে হয়, উনার ক্রিয়েটিভ সলিউশন ছিল। এই ছবিটা বানানোর পরে পরিচিতি পেয়ে যাওয়ার কারণে, হয়তো তার আর ক্রিয়েটিভ সলিউশন প্রয়োজন পড়বে না। পরের ছবিতে হয়তো বা তার ক্রেন দরকার, সাথে সাথেই ক্রেন চলে আসবে। কিন্ত যখন ছিল না, দৃশ্যের প্রয়োজনে বিকল্প খুঁজতে হয়েছে। যেমন আমাদের ছবির ক্ষেত্রেই, সালিশের দৃশ্যে একটা ক্রেন দরকার ছিল অথচ টাকা ছিল না।

শুটিং এ একটা ক্রেন যাওয়া মানে, বিশ থেকে পয়ত্রিশ হাজার টাকা, সাথে সাত থেকে দশজন ক্রু, একটা মোটর ভ্যান, সবার বকশিশ! আমরা বিকল্প হিসেবে একটা ১৫-২০ ফুট লম্বা কাঠের পাটাতন বানাই। পাটাতনের উপর থেকে ক্যামেরায় যে ইমেজটা আমরা পেলাম, সেটা নতুন একটা স্টাইলে রূপ নিল। পরে দৃশ্যটা দেখে মনে হল, ক্রেনের চেয়ে এই কম্পোজিশনটাই বেশি ভালো। 

ফ্ল্যাশব্যাক: যদি ভবিষ্যতে কোনো বড় এবং বাণিজ্যিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ স্বাধীনতা এবং পর্যাপ্ত বাজেট; দুই-ই দিয়ে সিনেমা বানানোর সুযোগ দিলে আপনারা কি বানাবেন? 

আরিফ: মাটির প্রজার দেশে বানানোর পর কেউ কেউ একসাথে কাজ করতে এগিয়ে আসলো। মিটিং হলো, গল্পের সাথে অনেক রেফারেন্স দেওয়া হলো। বলা হলো যে বাজেট নিয়ে কোনো চিন্তা না করতে। ওই মিটিং থেকে বের হয়ে আমি আর বিজন একে অন্যের দিকে তাকালাম আর এই দৃষ্টি বিনিময় থেকে দুজনেই পরিষ্কার—কাজটা করব কি করব না! বাজেট কখনোই প্রথম প্রাধান্য না। আমাদের আদর্শ আর তাদের আদর্শ না মিললে আমাদের পক্ষে সিনেমা বানানো সম্ভব না। আমাদের প্রথমে প্রয়োজন এমন প্রতিষ্ঠান, যাদের সাথে আমাদের যাত্রার সুর মিলবে। সারা বিশ্বে এমন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি অসংখ্য আছে। যেমন যিনি তারেক মাসুদের প্রডিউসার ছিলেন, তিনি কিন্তু এরপর প্রডিউস করছেন সাইমনকে। অন্য কোনো বাণিজ্যিক পরিচালককে নির্বাচন করেননি।  

বিজন: আমরা মনে করি, আমাদের সিনেমাও বানিজ্যিক। আমাদের দর্শকশ্রেণি আমাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে, সেটা বাংলাদেশে হোক বা ভারতে হোক বা রাশিয়াতেই হোক। কারণ দুনিয়ার সবাই বিরিয়ানি পছন্দ করে না। কেউ ভাত-ভর্তা পছন্দ করে, কেউ চাইনিজ পছন্দ করে আবার কেউ বার্গারও পছন্দ করে। প্রত্যেকটা কনটেন্টের নিজস্ব দর্শকশ্রেণি আছে। আমাদের সমস্যা আমরা কমার্শিয়াল সিনেমা বলতে মনে মনে ধরেই নিই “নাচগান-মারপিটপূর্ণ কন্টেন্ট”। আমরা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে শিখছি কীভাবে নিজেদের জন্য অডিয়েন্স তৈরি করা যায়। অধিকাংশ দর্শক এখন যে ঘরানার সিনেমা দেখতে চায়—আমরা যদি তেমনটাই বানানো শুরু করি, তাহলে সিনেমা বানানোর মোটিভটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এরচেয়ে বরং আরিফ কাস্টমস অফিসার হতো, আমি ইঞ্জিনিয়ার হতাম, দুই বন্ধুর দেখা হতো এয়ারপোর্টে। আমি বিদেশ থেকে মালপত্র আনা নেয়া করতাম আর আরিফ আমার থেকে ঘুষ নিত। তাই তো ভালো ছিল। আমাদের চিন্তা বা কাজের প্রশ্নে কম্প্রোমাইজ করব না, নইলে আমাদের অন্য জীবনটাতেই বেশি সুখী হতে পারতাম। 

ফ্ল্যাশব্যাক: এই সিনেমা কি শুধু নাগরিক প্রগতিশীলদের জন্য? প্রশ্নটা এসেছে গ্রামে এই সিনেমা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপার থেকে। আমরা দেখেছি, মাটির প্রজার দেশে এর পরিবেশন করা হয়েছে মূলত শহরে এবং প্রগতিশীলরাই এটা দেখেছে। কিন্তু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এ গল্পের বাস্তবতা আরও বেশি সত্য এবং বোধগম্য। এমনকি এর বক্তব্যও গ্রামের মানুষদের মানসিকতাই পরিবর্তন করতে ভূমিকা রাখতে পারত। 

বিজন: সিনেমাটা শুধু শহুরে প্রগতিশীলরা দেখছে, অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য আমাদের নেই। আর অন্যদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সিস্টেমের সাথে যে যুদ্ধটা করা প্রয়োজন, সেই পরিমাণ শক্তিও আমাদের নেই। আমি নিজে মাটির প্রজার দেশেকে খুব ভালো সিনেমা মনে করি না, কারণ এর চেয়ে অনেক ভালো সিনেমা করার ক্ষমতা আমাদের আছে। ভবিষ্যতে আস্তে আস্তে হবে। এটা আমার নিজেকে নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ। তবে মাটির প্রজার দেশে একজন পিএইচডি করা লোক আর একজন রিক্সাচালককে একই অনুভূতি তাড়িত করে—এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুবই গর্বিত। যারা বাসাবাড়িতে কাজ করেন তারা লক্ষ্মীর পালকি থেকে লাফ দেবার দৃশ্যে যেভাবে আবেগাপ্লুত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কিংবা ইন্টেলেকচুয়ালরাও একইভাবে হয়েছে। এবং আমার কাছে শ্রেণি থেকেও বড় বিষয়, মানুষের ছোট ছোট ইমোশন, ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়া। যেমন অনেক বড় কিছু না, ওরা দুজনে মিলে মেলায় যাবে—ছোট্ট একটা জিনিস। শেষ পর্যন্ত ওদের একসাথে মেলায় যাওয়া হয়নি। ডিস্ট্রিবিউশনের বিষয়টা আমার চেয়ে হয়তো আরিফ ভালো বলতে পারবে।

আরিফ: বাংলাদেশে মাটির প্রজার দেশে যদি একশ সিনেমা হল পেত, তাহলে বক্স অফিসের সংজ্ঞা অনুয়ায়ী এটা একটা সুপারহিট ফিল্ম হবার কথা। তাতে এই সিনেমা গ্রামের মানুষও দেখার সুযোগ পেত। মাটির প্রজার দেশে কোনো শ্রেণিকেন্দ্রিক ছবি না। যেকোনো মানুষ সিনেমাটার সাথে কানেক্ট হতে পারবে। আমরা নিশ্চিত কারণ আমরা সেই পরীক্ষাটা করেছি। প্রথম খসড়া তৈরি হওয়ার পর আমরা প্রায় ৬০-৭০ জন মানুষ নিয়ে ক্লোজ ডোর প্রদর্শনী করি। সেখানে সব শ্রেণির লোক ছিল, যেমন ঘরের বুয়া, ডাক্তার, উকিল কিংবা ফেরিওয়ালা। পরে আমরা প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলেছি। দেখলাম ৮৫ শতাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া একই। কোন দৃশ্যে তাদের কাছে কী মনে হয়েছে এবং কোথায় কী ঘাটতি ছিল, সবাই কিছু না কিছু পরামর্শ দিয়েছে। তাদের ফিডব্যাকগুলো এডিটিংয়ে প্রচুর সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এই অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাস থেকে আমি ট্র্যাডিশনাল ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে ধরনা দিই। হল সিন্ডিকেট আর কাকরাইলের প্রায় সব অফিসে যাই। কাকরাইলের লোকগুলো ভদ্রভাবে বলে এবং অন্যান্যরা অমার্জিত ভাবে বলে, কিন্তু দুই পক্ষের বক্তব্য একই যে, “তোমাদের ছবিটা অপূর্ব কিন্তু আমাদের জন্য কমার্শিয়ালি লাভজনক না। কারণ ডিউরেশন দেড় ঘন্টা এবং দেড় ঘন্টার সিনেমা হলে চালানো যায় না। আর সিনেমায় কোনো গান নেই, কোনো মারপিটের দৃশ্য নেই!” তখন আমি সরাসরি হল মালিকদের সাথে কথা বলি। সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার, রাজমনির হলমালিকরা সিনেমাটা চালাতে রাজি হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি নিজেই ডিস্ট্রিবিউশন করব। এরপরের ঘটনা খুব মজার, আমাদের ছবি আর জাজ মাল্টিমিডিয়ার ছবি পাষাণ (২০১৮) একই দিনে মুক্তি পায়। সে সময় আমাদের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বলল, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। পাষাণ এর সাথে প্রতিযোগিতায় এটা টিকবে না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, এক সপ্তাহ পর আমাদের ছবি টিকে গেল, কিন্তু পাষাণ সিনেপ্লেক্স থেকে সরিয়ে ফেলা হয়! আমাদের ছবির সেকেন্ড উইক শেষে আনফরচুনেট ঘটনা ঘটল। তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ স্বপ্নজাল (২০১৮) রিলিজ ডেট দিয়ে দিল। স্বপ্নজাল এর বিশাল মার্কেটিং বাজেট আছে এবং আমাদের মার্কেটিং বাজেট শূন্য। ঐ সিনেমার সাথে কমপিট করা আমাদের জন্য কঠিন। এরপর আমরা একটা খুব সাহসী একটা কাজ করলাম। আমাদের টাকাপয়সা ছিল না সত্যি, কিন্তু সিনেমাটা যেহেতু তিনটা হলে তিন সপ্তাহ চলেছে, আমরা সিনেমাটাকে বিভিন্ন শহরে নিয়ে গিয়ে প্রদর্শন করার কথা ভাবলাম। চট্টগ্রামের কথাই প্রথম ভাবলাম এবং সেখানে গিয়ে দেখলাম থিয়েটার ইন্সটিটিউটে সিনেমা হলের মতোই চমৎকার সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে। তবে ওদের টেকনিক্যাল ওরিয়েন্টেশন এবং একুইস্টিক সাউন্ড আফসোস করার মতো। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ডেকে বুঝিয়ে দিয়ে হলটা কোনোভাবে রেডি করলাম। এরপরের এক সপ্তাহে ওখানে কিছু পোস্টারিং করলাম। চট্রগ্রামে ছবিটা রিলিজের পর প্রতিদিন চারটা করে শো মোট চারদিন চললো এবং শেষের দিন আমরা টিকিট দিয়ে কুল পাচ্ছিলাম না। সেদিন ছিল শুক্রবার। একেকজন এসে বলছে আমাদের ১৫-২০ টা টিকেট লাগবে। খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি আপনারা এতগুলো টিকেট কাদের জন্য নিবেন। ওরা বললো আমরা ফ্যামিলির সবাই মিলে ছবিটা দেখব। চট্টগ্রামে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ওদের পারিবারিক বন্ধন এখনও দৃঢ়, যৌথ পরিবার এখনও টিকে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, ওই চার দিনের বেশি আমরা হলটা পাইনি। চট্ট্রগ্রাম থেকে ফেরার পর  আমার প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো, এই ছবিটা আসলে অনেকদিন পর দর্শকদের জন্য একটা অন্যরকম সঞ্চার করেছে। যেটার ছাপ চট্টগ্রামের দর্শকরা ছবিটা দেখে বের হবার পর তাদের চোখে-মুখে পেয়েছি। এরপর চুয়েটের প্রদর্শনীতেও সাকসেসফুল হয়।

বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম আমাদের ভালো পরিমাণ টাকা অফার করেছে। কিন্তু ছবিটা খুব সহজলভ্য করার পক্ষপাতি নই আমরা। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকাররা ততক্ষণ পর্যন্ত ছবি বানাচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ফিজিকাল এবং মেন্টাল এনার্জি আছে। এদের মধ্যে কেউ এখন সুন্দরবন থেকে মধু এনে বিক্রি করছে, কেউ কক্সবাজার থেকে শুটকি এনে বিক্রি করছে, কেউ খাবারের দোকান দিয়েছে, কিন্তু কেন? কারন তারা ধরেই নেয়, তারা সিনেমা বানাবে, মানুষকে দেখাবে আর বলব, “আপনারা ছবিটা দেখেন, দেখলেই আমাদের শাস্তি, কোনো টাকা পয়সা লাগবে না।” এটা খুবই ভুল চিন্তা। মানুষকে টিকেট কেটে সিনেমা দেখার অভ্যাস করাতে হবে। মাটির প্রজার দেশের আমরা যত প্রদর্শনী করেছি ছবি বানানোর টাকা না উঠলেও অন্তত প্রদর্শনীর খরচ উঠেছে। কারণ মানুষের এই ঘরানার ছবি দেখার আগ্রহ আছে। 

ফ্ল্যাশব্যাক: সিনেমার রাজ্জাক চরিত্রটি আমাদের চলচ্চিত্রকাররা মোল্লা ঘরানার মানুষের চরিত্রায়ণ যেভাবে করেন ঠিক তেমনটি নয়। এখানে আপনার ভাবনাটা কী ছিল?

বিজন: কোরান-বাইবেল-গীতার তো নিজস্ব হৃদয় নেই। আমার কাছে ধর্ম হচ্ছে মানুষেরই মনঃস্তত্ত্বের একটি বহিঃপ্রকাশ। আমরাই বইগুলো পড়ে নানারকম ব্যাখ্যা তৈরি করি। আমরা ছুরি দিয়ে পেঁয়াজও কাটতে পারি আবার মানুষও কাটতে পারি। রাজ্জাক হুজুরের চরিত্র এই ধারণা থেকেই আসা। রাজ্জাক হুজুরের চরিত্রটা মূলত শরৎচন্দ্রের জমিদার চরিত্রগুলো থেকে ধার করা। শরৎচন্দ্রের দাদাকে জমিদাররা মেরে ফেলে। কিন্তু শরচন্দ্রের গল্পে আপনি খুব কম নেতিবাচক চরিত্রে জমিদারদের পাবেন। শরৎচন্দ্র মূলত একজন ভালো জমিদার কেমন হতে পারে গল্পে তার ছবি এঁকেছেন। তিনি নিজে যেমন জমিদার দেখে এসেছেন, তার গল্প বলেননি। হুজুর রাজ্জাক হচ্ছে এমন একজন হুজুর, যে হুজুরের সাথে আমি কথা বলতে চাই, সময় কাটাতে চাই, যে হুজুরের খুতবা আমি শুনতে চাই; বাংলাদেশের  হুজুরদের আমি কীরূপে দেখতে চাই। আর গল্পে দেখাতে চেয়েছি, আপনি সমাজে যতই প্রতিষ্ঠিত-সম্মানিত মানুষ হন না কেন—যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি সিস্টেমের অংশ, ততক্ষণ পর্যন্ত সিস্টেমটা আপনাকে খাওয়াবে-পরাবে-সম্মান করবে৷ আপনি যদি সেই অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এবং সিস্টেমের যে ‘ধর্মের সংজ্ঞা’ তার অনুগামী না হয়, সিস্টেম আপনাকে আর গ্রহণ করবে না, বমি করে ফেলে দিবে। সেখান থেকেই হুজুর রাজ্জাক এবং তার পরিণতি।

ফ্ল্যাশব্যাক: মাটির প্রজার দেশে সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালকের ভূমিকায় খুব স্পষ্ট পার্থক্য ছিল। আমাদের দেশে প্রযোজকরা সাধারণত গৌরী সেনের ভূমিকা পালন করে, তত্ত্বগত প্রযোজকের ভূমিকা নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

বিজন: ইউসিএলে পড়ালেখা করার সময় আমি ২০০-৩০০ শর্টফিল্মে কাজ করেছি। ওখানকার প্রোডাকশন সিস্টেম থেকেই প্রযোজকের স্বীকৃত ভূমিকাটা শেখা। সেখানে প্রযোজক কেবলমাত্র লগ্নিকারক নয়। আরিফের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী সহজাতভাবে ছিল, সেটা প্রযোজক হিসেবে কাজ করতে অনেকাংশে কাজে লেগেছে। আর এই সিনেমার প্রোডাকশন পদ্ধতিতে পরিচালক এবং প্রযোজকের মিথস্ক্রিয়া এত ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে, আমরা দাবি করতেই পারি, সৃজনশীল প্রযোজকের ভূমিকা আমরাই বাংলাদেশে প্রথম শুরু করেছি। এখন অনেকেই বুঝতে পারছে যে এই ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। চ্যানেল আইয়ে ইমন ভাই ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার হিসেবে কাজ শুরু করেছে। একটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য চিন্তাশীল প্রযোজকের খুব দরকার। কারণ একজন পরিচালকের সৃজনশীলতা চর্চার সময়টুকু প্রোডাকশন আয়োজনের ঝক্কিঝামেলার মধ্যে খরচ করলে আদতে সিনেমার মান কমে যায়। সে চিন্তা করবে একটা পুরোনো রেডিও দরকার, সেই রেডিও কোথায় পাওয়া যাবে তার খোঁজখবর নিতে গেলে রেডিওটা সেটের কোথায় বসবে তা আর ঠিকঠাক চিন্তা করা হয় না। আমরা এখন পরের গল্প একসাথে লিখছি, সেই ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে এক্সিকিউশন-ডিস্ট্রিবিউশন পুরোটা এক সুতোয় গাঁথছি। আমরা এ প্র্যাকটিসটা আরও ভালোভাবে এরপরের সিনেমায় শুরু করেছি।

আরিফ: বিজনের অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতাটা ওর কাছ থেকে আমি খুব সহজে নিতে পেরেছি। এটার দুটো কারণ। প্রথমত, ও আমার বন্ধু। দ্বিতীয়ত, সংগঠন করার অভিজ্ঞতা; বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসংখ্য ছেলেমেয়ে আছে যারা মনেপ্রাণে সংগঠন করে এবং শেখে। আমি মনে করি, তাদের সবার মধ্যে প্রযোজনা করার সক্ষমতা তৈরি হয়। আমি যেহেতু সংগঠন করে অভ্যস্ত পরবর্তীতে যখন বিজন আমাকে প্রযোজকের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করে, তখন আমি বুঝলাম—এই কাজগুলো আসলে আমি এতদিন করে এসেছি, শুধু এই কাঠামোটা জানা ছিল না। এই কাঠামোটা জানার পর আমার আর আলাদা করে ফিল্ম স্কুলে গিয়ে প্রযোজনা শেখার প্রয়োজন পড়েনি। প্রযোজনা করার যে ধরনের ধৈর্য, ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি প্রয়োজন, সেটা আমার আছে। শুধু আমার নয়, এদেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আছে। সমস্যা হলো আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে এই চর্চাটা নেই। একদিন প্রদর্শনী শেষে তারেক মাসুদের ছোট ভাই, নাহিদ মাসুদ আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বললেন, “আরিফ আমি অনেস্টলি একটা কথা বলতে চাই, এই ছবি দেখে আমার একটা রিয়েলাইজেশন হলো। পর্দায় প্রযোজকের কাজের একটা প্রতিফলন পাওয়া সম্ভব—এটা আমি মাটির প্রজার দেশে দেখে বুঝলাম। আমি বাংলাদেশের আর কোনো সিনেমাতে এটা পাইনি। প্রযোজকের একটা সিগনেচার বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট এই সিনেমায় আছে”।

ফ্ল্যাশব্যাক: পরবর্তী পরিকল্পনা কী? 

আরিফ: এখনও আমরা পরবর্তী সিনেমার গল্প লিখছি। আমরা বিভিন্ন উৎসবগুলোতে যাচ্ছি এবং আমরা কো-প্রডাকশনের চেষ্টা করছি। আমরা ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছি সারা পৃথিবীতে আমাদের মতো অনেক মানুষ আছে। ওরা ভারতে আছে, শ্রীলংকায় আছে, নেপালে আছে, চায়নাতে আছে, জাপানে আছে, ইউরোপ আমেরিকায় সব জায়গায় আছে। আমরা আমাদের মতো ভিনদেশি ফিল্মমেকার যারা একই ধরনের স্ট্রাগল করে যাচ্ছে, তাদের সাথে একটা কোয়ালিশন ক্রিয়েট করার চেষ্টা করছি। যাতে আমরা একজন আরেকজনকে ওঠাতে পারি। একজন আরেকজনকে প্রয়োজনে পাশে পাই। তো আমাদের পরের সিনেমাটার সাথে এই যোগাযোগের ক্ষেত্রটাও তৈরি করতে চাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমাদের কিছু কিছু মানুষের সাথে সে ধরনের ভ্রাতৃত্ব বা বন্ধুত্ব, ক্রিয়েটিভ পার্টনারশিপ তৈরি হয়েছে, হচ্ছে।

বিজন: এর সাথে আরেকটা বিষয় দিয়ে শেষ করতে চাই, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মানেই হচ্ছে ‘চ্যারিটি ফিল্মমেকিং’ বা ‘আর্ট ফিল্মমেকিং’ অথবা ‘অল্টারনেটিভ ফিল্মমেকিং’—এই ধারণাটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মও একটা কমার্শিয়াল ফিল্ম জার্নি—এটা যতদিন পর্যন্ত আমরা না বুঝব ততদিন পর্যন্ত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিং এর ইতিহাসে এটা নাগরিক রূপকথা হয়ে থাকবে। অনেক তরুণ ছেলেমেয়ে আমাকে বলে, “ভাই, আমার সিনেমা মানুষ দেখলে দেখুক না দেখুক আমার কিছু আসে-যায় না। আমি তাদের সাথে আর কোনো আলাপ করতে রাজি না। যদি আমার কিছুতে তার কিছু না যায় আসে, তাহলে আমি কিংবা আপনিও কেন ওর সিনেমা দেখব, ওর সিনেমা নিয়ে চিন্তা করবেন? যদি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ নাই হয়, তুমিই যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট হও, তাহলে সিনেমা বানিয়ে নিজের ঘরে নিজেই দেখো। সারা পৃথিবী জুড়েই এই গল্পগুলোর একটা দর্শক আছে। সেই দর্শকদের আমাদের খুঁজে নিতে হবে।

(সাক্ষাৎকারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সাময়িকী ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)

Leave a comment