চলচ্চিত্র নির্মাতা ওং কার-ওয়াই এর এই সাক্ষাৎকারটি ২০০১ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘লেসোন দে সিনেমা’ অংশ থেকে নেওয়া। সাক্ষাৎকারটিতে বিশ্বনন্দিত এই নির্মাতা তার গল্পের ভাঁজে দর্শক-শ্রোতাদের নিয়ে গেছেন সিনেমার সাথে তার সম্পর্কের একেবারে গোড়ায়। নিজের সিনেমার গল্পগুলো কীভাবে বেড়ে ওঠে, কী করে একেকটা গল্প রূপান্তরিত হয় সিনেমায়, সেই রূপান্তরে সংগীতের ভূমিকাই বা কতটুকু থাকে, নির্মাণের পেছনকার নানান খুঁটিনাটি উঠে এসেছে এই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়। সাক্ষাৎকারটির ঠিক আগে, ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০) নামে একটি শর্টফিল্ম প্রদর্শিত হয়, যা কিনা ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০) ছবির গল্পের ধারাকেই অনুসরণ করে তৈরি, কিন্তু ষাটের দশকের হংকং থেকে সরে এসে এবারের গল্প বেড়ে ওঠে এক স্থানীয় কনভেনিয়েন্স স্টোরে। এই শর্টফিল্মের প্রসঙ্গ ধরেই আলোচনা এগুতে থাকে। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছে সুমন্ত সরকার অর্পণ।
এটা যেহেতু একটা সিক্যুয়াল ছিল না, আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে আপনার এই শর্ট ফিল্মটির জন্ম ব্যাখ্যা করা দরকার, অর্থাৎ ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০) এর সাথে এটার সংযোগটা কোথায়?
ওয়াং কার-ওয়াই: আসলে, প্রজেক্টটা শুরু করি তখন আমি স্থানীয় খাদ্যদ্রব্যকে কেন্দ্র করে একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছিলাম, এটার নাম ঠিক করেছিলাম থ্রি স্টোরিজ অ্যাবাউট ফুড, যা কিনা ইন দ্য মুড ফর লাভ ছবিটার আঞ্চলিক শিরোনাম। আইডিয়াটা ছিল এমন তিনটি গল্প নিয়ে যেখানে খাবার কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে তা দেখানো হবে। গল্পটা মুলত চাইনিজ কমিউনিটিকে ঘিরে। আমার মনে হয় সত্তরের দশক থেকে দুটো আবিষ্কার চীন ও এশিয়ার মানুষের জীবন অনেকটা পালটে দিয়েছে। যার একটি হলো রাইস কুকার; দ্বিতীয়টি ইনস্ট্যান্ট নুডলস। আগে পরিবারের মহিলাদের রান্নাবান্নার পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হতো। রাইস কুকারের আগের দিনগুলোয় নারীদের রান্নাঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হতো। রাইস কুকার আসার পর, তারা নিজেদের জন্য আরো বেশি সময় পায়।
আর তারপর, ইন দ্য মুড ফর লাভ সিনেমার মতোই সবাই নুডলসের জন্য বাইরে যাওয়া শুরু করে। পরিবারের সবাই মিলে বাইরে থেকে ঘুরে আসার মতো ছিল বিষয়টা, যেহেতু তারা খুব ছোট জায়গায় বসবাস করত। তাই রাতে কাপ নুডুলসের জন্য তাদের একটা অজুহাত দরকার ছিল। আসলে, এটা ছিল নুডলসের বাহানায় একটু খোলা বাতাসে বেড়িয়ে আসা। কিন্তু ইন্সট্যান্ট নুডলস চলে আসার পর থেকে কেউ আর নুডলসের জন্য বাইরে যায় না। আর তাই শেষ গল্পটি ফাস্টফুডের দোকান নিয়ে। আর এখন অনেকেই, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা রান্নাবান্নায় খুব একটা আগ্রহী না, তারা বরং বাইরে যেতেই পছন্দ করে।
গল্প তিনটি হংকং এর ভিন্ন ভিন্ন সময়কে ঘিরে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে মানুষের খাদ্যাভ্যাস সমাজে পুরুষ এবং নারীর ভূমিকায় অনেক পরিবর্তন এনেছে। এই প্রজেক্টটিতে আসলে তিনটি ছোট ছোট গল্প রয়েছে এবং আমরা মাত্র যে শর্ট ফিল্মটি দেখলাম সেটি শেষ গল্প হওয়ার কথা ছিল। এটা অনেকটা শেষপাতের মিষ্টান্নের মতো। আমরা প্রোডাকশন শুরুর প্রথম দুই দিনেই শর্ট ফিল্মটি শুট করে ফেলি। এটা শেষ করতে মাত্র দুই রাত লেগেছিল, এবং তারপরে আমরা মূল পর্বের কাজে হাত দেই, সেটাই হলো ইন দ্য মুড ফর লাভ।
কিন্তু কীভাবে যেন ইন দ্য মুড ফর লাভ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, গল্পটিতে নুডলস রয়েছে, এতে একটি রাইস কুকারও রয়েছে, শেষমেষ এটা নিজেই একটা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে। আসলে, যখন কান উৎসব থেকে আমাকে বলা হলো যে, সেখানে ছবিটার গল্প নিয়ে কিছু বলতে হবে, তখন আসলে আমার বলার মতো তেমন কিছু ছিল না। আমার কাছে অন্যদের শেখানোর মতো তেমন কিছু নেই আর আমি নিজেকে ভালো উদাহরণও মনে করি না। আমরা অনেক ভুল করেছি। আমি আপনার সাথে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই, সেই সাথে আমি মনে করি আমরা যেভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করি এবং আমাদের যেসমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেটাও আপনার জেনে নেয়া ভালো। ঠিক এজন্যেই আমরা ফেস্টিভালে শর্ট ফিল্মটা দেখালাম।
এটি তাহলে চলচ্চিত্র নির্মাণে আপনার একটি কৌশল। তিনটি গল্প বা দুই-তিনটি অংশের একটি প্লট নিয়ে আগানো, আপনার ক্যারিয়ারে এটা এক ধরনের অভ্যাস। প্রথম ব্যাপারটা হলো আপনি সত্যিকার অর্থে চিত্রনাট্য ছাড়াই শুটিং শুরু করে দেন এবং আপনি শুটিং চলাকালীন সময়ে লিখতে থাকেন।
ওং: সবার প্রথমে আমরা সাধারণত একটি স্ক্রিপ্ট ছাড়াই শুটিং করি, সেই অর্থে একটি আসল স্ক্রিপ্ট ছাড়াই, এমনকি একটি নকল স্ক্রিপ্ট ছাড়াই, কিন্তু আমাদের একটি ধারণা থাকে। আমার কাজের সবসময় ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে, কারণ আমি মনে করি নব্বই মিনিটের একটি ফিল্ম বানাতে হলে তাতে অনেককিছুর মিশেল থাকতে হবে। আমার সবসময় শর্ট ফিল্মের একটা আইডিয়া থাকে, ঠিক কেন জানি না, দেখা যায় আমরা দুই বা তিনটি গল্প দিয়ে কাজ শুরু করি। কখনও কখনও শুধুমাত্র একটিই।
চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪) এর মতো।
ওং: ঠিক তাই।
আর কখনও কখনও আপনি দ্বিতীয় গল্পটার কথা ভুলে যান।
ওং: আমি এটা ভুলে যাই না আসলে। কীভাবে যেন এটা আরেকটি চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে, যেমন ধরুন চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪) এবং ফলেন অ্যাঞ্জেলস (১৯৯৫) মধ্যকার সম্পর্কের মতো। চাংকিং এক্সপ্রেস এ প্রথমে তিনটি গল্প ছিল, কিন্তু আমরা কেবল দুটোর কাজ শেষ করতেই যেটা একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা হয়ে গেল। তাই আমরা তৃতীয় গল্পটা বাদ দেই আর ওটা দিয়ে শেষমেষ ফলেন অ্যাঞ্জেলস (১৯৯৫) নামে আরেকটি সিনেমা বানিয়ে ফেলি, যা কিনা চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪) এর মূল প্লটের তৃতীয় গল্প।
আচ্ছা, এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো আপনি প্রথমে গ্রাফিক আর্ট শিখেছেন, তারপর একজন স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর এখন যখন আপনি একজন পরিচালক, আপনি আর স্ক্রিপ্ট লেখেন না। এই পরিবর্তনটা একটু ব্যাখ্যা করুন।
ওং: আসলে, এই ধারনায় কিছু ভুল আছে। হংকং পলিটেকনিকে আমার গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনার কারণ ছিল আমি ভেবেছিলাম যে একজন গ্রাফিক্সের ছাত্র হতে হলে লেখালেখি করতে হবে না, আবার অনেক বেশি হোমওয়ার্ক নেই। আমার এক বন্ধু গ্রাফিক্সের ছাত্র ছিল, ওর শেখার প্রক্রিয়াটা আমার বেশ ভালো লেগেছিল। কারণ সে সময় ওরা শুধু ছবিই তুলতে যেতো। ব্যাপারটা বেশ সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু আদতে তা নয়, আর আমি গ্রাফিক্সেও ভালো নই। আমার আঁকার ধৈর্য নেই। তাই আমি লেখক বনে যাই কারণ হংকং-এ সেই দিনগুলোতে লেখক ও পরিচালকদের জন্য টেলিভিশনে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু ছিল। তাই আমি সেই প্রশিক্ষণটা নেই আর স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করে দেই। কিন্তু আমি দেখলাম যে আমি লেখালেখিও অপছন্দ করি। তাই আমি পরিচালক হওয়ার চেষ্টা করি, আমি ভেবেছিলাম, “আচ্ছা, কেউ তো আমাকে স্ক্রিপ্ট লিখেই দিবে।”, কিন্তু তা হয়নি। আপনাকে আপনার স্ক্রিপ্ট নিজেই লিখতে হবে। এমনকি যখন আমরা কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়া শুটিং করছি—তখনও আসলে দিনশেষে আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট কিন্তু আছে। সিনেমাটা যখন শেষ হয়, তখন দেখা যায় যে স্ক্রিপ্টটি আসলে খুব বিস্তারিত ছিল।
অন্য একজন পরিচালকের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখা আর আপনার নিজের ছবির জন্য একটি স্ক্রিপ্ট লেখার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
ওং: একজন লেখক হিসেবে আপনি জানেন যে যখন স্ক্রিপ্টটি শেষ হবে, তখন পরিচালককে সেটা ভিজ্যুয়ালে রূপান্তর করতে হবে। তখন আপনি চাইবেন যে লেখার সময় যেমনটা কল্পনা করেছিলেন, সিনেমাটা দেখতে যাতে কমবেশি সেরকমই হয়। আপনি কিছু জায়গায় পরিচালককে আটকে দিতে পারেন। আপনার লেখায় এমন অনেক সংলাপ থাকে যেগুলো আপনি চান ছবিতে যতটা সম্ভব নিখুঁত করার।
কিন্তু স্ক্রিপ্ট লেখা এবং পরিচালনা করা, দুটো ভিন্ন জিনিস। যখন আমি পরিচালনা শুরু করি, তখন আমি নিজেকে সবসময় হিচককের মতো একজন পরিচালক হিসেবে কল্পনা করতাম, যিনি খুব গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতেন এবং তার সিনেমা সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। খুবই টেকনিক্যাল। কিন্তু প্রথম দিনই আমি আবিষ্কার করি যে এটা একটা ভুল ধারণা ছিল। কারণ আমার পক্ষে কখনই হিচকক হওয়া সম্ভব না, যেহেতু আমি সব সময় সিনেমায় কিছু না কিছু পরিবর্তন করতে থাকি। নিজে একজন লেখক হওয়ার জন্যই, আমি জানতাম কীভাবে সেটে তাৎক্ষণিক পরিবর্তনগুলো করতে হয়। তাই শেষমেষ আমি ভাবলাম, “চিন্তার কি আছে?” তাছাড়াও, আমি মনে করি আপনি কাগজে আপনার কল্পনার সবটুকু লিখে ফেলতে পারবেন না। অনেক কিছু আছে , যেমন: শব্দ, সঙ্গীত, পরিবেশ, এবং অভিনেতারাও। স্ক্রিপ্টে আপনি এই সবকিছু বিশদভাবে লিখছেন বটে কিন্তু স্ক্রিপ্টের কোনো গতি নেই, এটা পাঠযোগ্য নয়। বরং খুবই বিরক্তিকর। তাই আমি ভাবলাম, আগেভাগেই পুরো স্ক্রিপ্টটা লিখে ফেলা খুব একটা ভালো আইডিয়া নয়, তাই আমি শুধু সিনগুলো লিখতাম, আর সাথে কিছু প্রয়োজনীয় ডিটেইল আর ডায়লগগুলো। আমি আমার অভিনেতাদের একটা সিনের অন্তর্নিহিত ছন্দটা শুধু ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করি, আর টেকনিক্যাল ডিটেইলস এড়িয়ে যাই।
অন্যদের জন্য যে স্ক্রিপ্টগুলি লিখতেন, সেগুলি কি আপনার চলচ্চিত্রের মতোই খানিকটা জটিল ছিল? সেগুলি কি লিনিয়ার স্ক্রিপ্ট ছিল? নাকি এখন নিজের ছবির জন্য যে ধরনের স্ক্রিপ্ট লিখছেন সেরকম?
ওং: আমি আট বছর ধরে একজন চিত্রনাট্যকার ছিলাম, তাই আমাকে অনেক লিখতে হয়েছে। কমেডি, হরর, মার্শাল আর্ট, অ্যাকশন, প্রায় সব ধরনের লেখাই সেখানে ছিল। পরিচালক প্যাট্রিক ট্যামের সাথে আমার কাজ করার ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি আসলে হংকং নিউ ওয়েভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের একজন। তিনি আমাকে পরিচালনা সম্পর্কে এবং শব্দকে কি করে ছবিতে রূপান্তর করতে হয় সে বিষয়ে অনেক কিছু শিখিয়েছেন।
আমি তার সাথে ফাইনাল ভিক্টরি (১৯৮৭) নামে একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম, আর তখন আমি বুঝতে পারি যে স্ক্রিপ্ট এক হলেও, পরিচালকভেদে সিনেমাগুলো দেখতে একেবারেই আলাদা হতে পারে।
আপনার প্রথম চলচ্চিত্রটি কিন্তু বেশ সাধারণ ছিল, সোজাসাপ্টা একটা স্ক্রিপ্ট। এর পরে আপনি গল্পের সরলগতি ভেঙে একটি নতুন স্টাইল তৈরি করেছেন। গল্প বলার ধরনে এই পরিবর্তন আনার পেছনে কারণ কী?
ওং: আমার প্রথম চলচ্চিত্র (অ্যাজ টিয়ার্স গো বাই, ১৯৮৮) সালে নির্মিত হয়েছিল, সেটা ছিল হংকং সিনেমার ইতিহাসের সুবর্ণ সময়। সেই বছরে ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক নতুন নতুন নির্মাতা এসেছিলেন, কারণ তখন হংকংয়ে বছরে প্রায় তিনশ সিনেমা প্রোডিউস হচ্ছিল। তখনকার দিনে, হংকংয়ের ছবিগুলিকে অর্থায়নের জন্য ট্র্যাডিশনাল মার্কেটের ওপর, অর্থাৎ এশিয়ার বাজারে বিক্রির ওপর নির্ভর করতে হতো।
প্রযোজকের প্রয়োজন ছিল শুধু একটি গল্পের, একটি জঁরার আর অভিনেতাদের নাম। একটি চলচ্চিত্রের জন্য গ্যাংস্টার ফিল্মের একটি আইডিয়া আমার মাথায় ছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক, ছবিটা বানানোর সময় আমার মনে হলো, “আমি বেশকিছু জিনিস পরিবর্তন করতে চাই।” যেহেতু এটা আমার প্রথম ছবি, তাই হঠাৎ পরিবর্তনগুলো আনা একটু কঠিন ছিল। যখন আমি দ্বিতীয় ছবিটা বানাই, ততদিনে এসব পরিবর্তন নিয়ে বেশ ধারণা হয়ে গেছে। আমি তখন জানি কি করে আমার স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন আনতে হয়।
তাহলে একটা পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্টের বদলে এর জায়গায় আপনি কী নিয়ে কাজ করেন? সংগীত? সংগীত কি এক্ষেত্রে আপনাকে কাহিনি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে?
ওং: না তা নয়, আমি কোনো ভুল ধারণা দিতে চাই না। আসলে, আমাদের একটি স্ক্রিপ্ট থাকেই। কিন্তু ঠিক লিখিত আকারে থাকে না এই আর কি। সিনেমার কাজ শুরু করার আগে আপনার গল্পটি নিয়ে ধারণা থাকা উচিত। একজন লেখক হিসেবে আমি বেশ অভিজ্ঞ, তাই আমি মোটামুটি জানি গল্পটার কোন দিকে যাওয়া উচিত। এটা সিন ওয়ান, সিন টু, সিন থ্রি এভাবে লেখা নেই কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমার মাথায় আছে। যদি গল্প সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট একটি ধারণা না থাকে তবে সিনেমার কাজে হাত দেওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, এতে শুধু সময় এবং শ্রমের অপচয়।
আচ্ছা, তাহলে লিখিত একটি স্ক্রিপ্ট ছাড়া সেটে সিনেমাটোগ্রাফার বা অভিনেতাদের সাথে আপনি সমন্বয় করেন কীভাবে?
ওং: প্রথমত, আমি মনে করি এক্ষেত্রে আমরা খুবই ভাগ্যবান। আমার প্রথম চলচ্চিত্র থেকে আমরা কমবেশি একই কলাকুশলীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এই একটা দলই মোটামুটি পনেরো বছর ধরে একসাথে কাজ করে চলেছে। আবার বেশিরভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একে অপরকে খুব ভালোভাবে চেনে, তাই শুটিং শুরুর আগে আমি শুধু তাদের গল্প আর চরিত্রগুলোর ব্যাপারে ধারণা দিয়ে দেই। আর তারপরে আমরা সিচুয়েশনগুলো তৈরি করি। আমি যখন স্ক্রিপ্ট লিখতাম, তখন হংকংয়ের চলচ্চিত্রগুলো এইভাবেই বানানো হতো, কারণ সিনেমাগুলো নামাতে হাতে কেবল এক মাসের মতো সময় পাওয়া যেত।
বেশিরভাগ সময়ই একটি গল্প হাতে পেলে আমরা সাথে সাথে সিনেমার কাজ শুরু করে দিতাম। কিন্তু যেহেতু আমাদের একটা নির্দিষ্ট লোকেশনে শুটিং করতে হতো, তাই আমাদের ফিল্মগুলো একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে সাজাতে হয়েছিল যাতে আমরা মুহুর্তেই বের করতে পারি, “আমাদের এই জায়গায় একুশটি সিন, এখানে চারটি সিন, আর ওখানে ছিয়াত্তরটি সিন রয়েছে।” কীভাবে গল্প সাজাতে হবে তা মনে রাখাটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
কিন্তু শুটিং চলাকালে পরিবর্তন আনলে তো সেটা খুব একটা সহজ হওয়ার কথা না।
ওং: তো আপনার হাতে যখন অনেক বেশি সিন রয়েছে তখন মাঝে মাঝে আপনাকে আরেকটা নতুন লোকেশন খুঁজতে হতে পারে, মিসিং লিংকটা ধরার জন্য।
আপনি কি আপনার অভিনেতাদের সাথে নিয়ে রিহার্সাল করেন?
ওং: না।
আর কতগুলো টেইক নিতে হয়?
ওং: এটা কিছু জিনিসের ওপর নির্ভর করে। শুটিং শুরুর পর থেকে আমরা আসলে একটা ছন্দ খুঁজতে থাকি, যে কারণে কাজ খুব ধীরগতিতে এগোয়। প্রতিদিন দশ থেকে বারোটা সেট-আপ থাকতে পারে। কিন্তু যখন সবাই একই ছন্দে আগায়, তখন শুটিং আসলে খুব দ্রুত চলে।
শুটিং এবং এডিটিং প্রক্রিয়ায় সংগীতের ভূমিকা কী?
ওং: আমার কাছে, সংগীত হলো যা ছন্দ তৈরি করে। তাই আমি যখন ক্রিস ডয়েলকে (সিনেমাটোগ্রাফার) পুরো ছবির ছন্দটা বোঝাতে চাই, তখন আমি ওকে দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়ানোর পরিবর্তে সিডি বাজিয়ে শোনাই, কারণ সে এমনিতেও স্ক্রিপ্ট পড়বে না। এক দিক থেকে এটা খুব কার্যকর, আর এটা আমাকেও সাহায্য করে। কারণ আমি মনে করি সিনেমার রিদম খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি একবার যখন ছবির রিদমটা ধরতে পারবেন, তারপর ধীরে ধীরে আর সবকিছুই বেড়িয়ে আসবে।
তো আপনি শুটিং চলার সময় লেখালেখি করছেন, আবার আপনি সম্পাদনাও করছেন। আপনি কি তাহলে ছবি বানানোর প্রচলিত ধাপগুলো অনুসরণ করেন না?
ওং: আমার অতো ধৈর্য নেই, তাই আমি সবকিছুই একসাথে করে ফেলতে চাই। আপনি খুব দ্রুতই বুঝে যাবেন কাজের ছন্দ ঠিক আছে কিনা। তাই যখনই সিনেমার ছন্দ খুঁজে পাই, আর দেখি যে আমরা শুধু শুটিং করছি আর প্রোডাকশন শেষ হওয়া অব্দি অপেক্ষা করছি, ঠিক তখনই সম্পাদনার কাজটা শুরু করি।
এবং শেষতক আপনি আরেকটি ছবির কাজ শুরু করেন।
ওং: অবশ্যই। আসলে ব্যাপারটা কি, ছবি বানানোর বিষয়টা সবসময়ই আমার মাথায় ঘোরে। কখনও বাস্তবধর্মী কিছু, কখনও পুরনো দিনের সার্কাসের মতো। তো শুরুতে আমরা একটা দল গঠনের কাজ সেরে ফেলি, আর তারপর একনাগাড়ে শুটিং করতে থাকি।
আমি সবসময় স্বপ্ন দেখি যে আমি আঠারো মাসে দশটি ছবি বানিয়ে ফেলেছি। আমার আশেপাশের লোকজন জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি আদৌ কখনও ছুটি নেন?” আমার জন্য একটি ছবি বানানো, এর পেছনে পুরো কাজটা, এটা একটা ছুটি। আমি এটা অসম্ভব রকম উপভোগ করি।
এজন্যেই কি শুটিং এতদিন চলে?
ওং: হ্যাঁ, কখনও কখনও এর কারণ হয় যে ছবিটার প্রেমে পড়ে যাওয়া। আপনি এটা ছাড়তে চান না, আমরা যেমন ইন দ্য মুড ফর লাভ ছবিটাকে ইচ্ছে মতো বাড়তে দিয়েছি। আমরা মূলত সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটেই ছবিটি শেষ করতে চেয়েছিলাম। তাই আমরা দ্রুত কাজ করতে থাকি, কিন্তু দিনশেষে আমরা বুঝতে পারি যে, পুরোটা আসলে এফোর্ড করা সম্ভব না, যেকারণে সেবার আমাদের ওই পর্যন্তই থামতে হয়েছিল। তারমানে এই নয় যে গল্পগুলো আমার মনেও থেমে গেছে, গল্পগুলো অনন্তকাল আমার মনে চলতে পারে। হয়তো ভবিষ্যতে আপনারা সেটা দেখতেও পারেন।
সেজন্যে কি আপনার ক্যারিয়ারে দুইবার আপনি একটা ছবির শুটিং চলাকালে দ্বিতীয় আরেকটি ছবির কাজ শুরু করেছেন? অ্যাশেজ অব টাইম (১৯৯৪) চলাকালীন চাংকিং এক্সপ্রেস (১৯৯৪) আর ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০) এর সময় টু জিরো ফোর সিক্স (২০০৪) শুরু করেছিলেন। আপনি কীভাবে একই সময়ে দুটি আলাদা সিনেমার কাজে হাত দেন?
ওং: দুটোর অভিজ্ঞতা আলাদা ছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ আমাদের অ্যাশেজ অব টাইম বানাতে দুই বছরের মতো লেগে গেছিলো। শুটিং ও পোস্ট প্রোডাকশন এর কাজ যখন শেষ হলো, এর মাস ছয়েক পর আমরা জানতে পারি যে ছবিটা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে যাচ্ছে। মাঝখানের সময়টায় আমাদের করার তেমন কিছুই নেই, তাই আমি খুব দ্রুত আরেকটা ছবি বানাতে চাই। আমার আসলে একটা রিফ্রেশমেন্টের দরকার ছিল। কারণ আমি জানতাম যদি আমি অ্যাশেজ অব টাইম-এ থেমে যাই, তবে আরেকটি ছবি বানাতে দুই বছর লেগে যাবে, আর সেটা আমার জন্য বেশ ভীতিকর একটা ব্যাপার। আমি স্টুডেন্ট ফিল্মের মতো খুব সাধারণ একটা কিছু বানাতে চেয়েছিলাম, আর তাই আমরা এক মাসের মধ্যে চাংকিং এক্সপ্রেস বানিয়েছিলাম
ইন দ্য মুড ফর লাভ এবং টু জিরো ফোর সিক্স এর সময় আমরা যে এশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে পড়ে যাব সেটা বুঝতে পারিনি। তাই এসময় ইন দ্য মুড ফর লাভ এর প্রোডাকশন বন্ধ রাখতে হয়েছিল, কারণ তখন এশিয়ায় আমাদের প্রযোজকরা অসুবিধায় ছিল। তাই আমাদের অর্থ জোগাড়ের জন্য তখন ইউরোপে যেতে হয়েছিল আর তারপরে আমরা আবার সিনেমার কাজ শুরু করি। কিন্তু যেহেতু আমরা টু জিরো ফোর সিক্স এর ব্যাপারেও একইরকম সিরিয়াস ছিলাম, একটা সময়ে দেখা গেল আমাদের একসাথে দুটো প্রোডাকশনে কাজ করতে হচ্ছে। এ এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা, অনেকটা একই সাথে দুটি নারীর প্রেমে পড়ার মতো।
আর একজন আরেকজনের প্রতি ঈর্ষান্বিত?
ওং: ঠিক তা নয়। কারণ আমি যখনই ইন দ্য মুড ফর লাভ এর শুটিং করছেন, আপনি আসলে ভাবছেন টু জিরো ফোর সিক্স এর কথা। কিছু লোকেশন আছে—প্রথমে আমরা টু জিরো ফোর সিক্স এর জন্য ব্যাংকক যাই, কিন্তু লোকেশন খোঁজার পুরো জার্নিতে আমরা এমন সব জায়গা খুঁজে পেয়েছি যেগুলো তখন মনে হচ্ছিল ইন দ্য মুড ফর লাভ এর জন্য ভালো হবে। তাই শেষ পর্যন্ত, আমাদের প্রোডাকশন ব্যাংককে সরাতে হয়েছিল। আবার যখন টু জিরো ফোর সিক্স এর শুটিং চলছে, তখন আমাদের মাথায় ঘুরছে ইন দ্য মুড ফর লাভ। পুরো ব্যাপারটাই এতো এলোমেলো!
নিজেই নিজের ছবি প্রযোজনা করার ব্যাপারটা আসলে কেমন? এটার সুবিধা কিছু আছে অবশ্যই, কিন্তু ছবি বানানোর প্রক্রিয়াটাতে এটা কি একটা সমস্যাও বটে?
ওং: আমি মনে করি প্রযোজনা একটি ফুল-টাইম কাজ। তো যখন আমাকে তিনটা ফুল-টাইম কাজ করতে হচ্ছে—লেখক, পরিচালক এবং প্রযোজক, তখন কিন্তু কাজের গতি খুব ধীর হয়ে আসছে। আমি আর খুব বেশি ছবি বানাতে পারছি না। এছাড়াও, এটা আমায় কাজের ক্ষেত্রে অনেকটা স্বাধীনতা যেমন দেয়, তেমনি দায়িত্বও বাড়িয়ে দেয়। আমার প্রথম দুটো সিনেমার সময় অনেকেই বলেছিল, “আচ্ছা, আপনি তাহলে নিজের ইচ্ছেমতোই সিনেমাগুলো নির্মাণ করেন কিন্তু প্রযোজকদের তেমন একটা আমলে নেন না।” জবাবে আমি বলেছিলাম, “আমি নিজেই একজন প্রযোজক হতে চলেছি, আর আমি এখানে টিকেও যাবো।”
আজ সকালে, আমরা আন্দ্রে দ্যুভালুর ‘দ্য লেসন’ দেখলাম। চলচ্চিত্রে মিউজিক নিয়ে তিনি অনেক কথা বললেন। তিনি মিউজিক নিয়ে অনেক কাজ করেন, এবং আপনিও মিউজিক নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। মিউজিক আর আপনার নিজের চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বলুন।
ওং: সিনেমা হলো শব্দ এবং ছবির মিশ্রণ। মিউজিক শব্দের অংশ। মিউজিক একটা নির্দিষ্ট সময় বা যুগের আবহ তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কখনও কখনও মিউজিক খুবই রঙিন হয়ে উঠতে পারে। আপনি যদি এই সময়ের ওপর একটি ছবি বানাতে যান, সেক্ষেত্রেও সিনেমায় বর্ণিল একটা ভাব আনতে অনায়াসে ভিন্ন কোনো সময়ের মিউজিক ব্যবহার করতে পারেন। দৃশ্যের সাথে মিউজিক একেবারে মিলে যেতে হবে, এ ব্যাপারে আমি অতো সিরিয়াস নই। আপনার তো জানাই আছে যে, খুব দুঃখের কিছু সিন যদি থেকে থাকে তার জন্যে দুঃখের মিউজিক আছে, অথবা আনন্দের কোনো সিনের জন্য সে অনুপাতেও মিউজিক পেয়েই যাবেন। আমি মনে করি মিউজিক এবং ছবির মধ্যে আসলে এক ধরনের রসায়ন আছে, যেটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে খুব আগ্রহ বোধ করি।
ফিল্ম স্কুল সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
ওং: আমি আসলে ফিল্ম স্কুলে যাইনি। তবে আমি মনে করি ফিল্ম স্কুলে কিছু সময় কাটানো ভালো। আপনি সেখানে অনেক সিনেমা, অনেক দেখার সুযোগ পাবেন। সেখানে আপনি কিছু বন্ধুও পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি মনে করি ফিল্ম স্কুলে আপনি ছবি বানানো শিখতে পারবেন না। সেটা আপনাকে রোজকার জীবন থেকেই ফিল্ম শিখে নিতে হবে।
আপনি কীভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিখলেন? ছেলেবেলায় আপনি কী ধরনের সিনেমা দেখেছেন আর এগুলো কোথায়ই বা দেখতেন?
ওং: আমার ছবি বানানোর রসদ আমি আমার জীবন থেকেই নিই। আমার জন্ম সাংহাইতে, পাঁচ বছর বয়সে চলে আসি হংকং-এ। ইন দ্য মুড ফর লাভ এর চরিত্রগুলোর মতোই, আমরা সাংহাইয়ের স্থানীয় ছিলাম, এমনকি আমরা এখানকার ভাষাতেও কথা বলতাম না। আমার মা সিনেমা খুব পছন্দ করতেন, তাই আমরা প্রায় প্রতিদিনই নানা ধরনের ছবি দেখে সময় কাটাতাম। হংকং-এ আমরা হলিউড, মান্দারিন, এখানকার স্থানীয় আর ইউরোপীয় ছবি দেখতে পারতাম। তাই আসলে, ফিল্ম স্টুডেন্টদের জন্য আমার পরামর্শ হল, যদি সুযোগ পান, যত বেশি সম্ভব সিনেমা দেখুন, ভালো খারাপ দুটোই। ভালো ছবি থেকে আপনি কিছু শিখতে পারবেন, আবার খারাপগুলো থেকেও আপনি অন্যকিছু শিখতে পারবেন।
এবার আমার মনে হচ্ছে আমরা এই সাক্ষাৎকারটি শেষ করার মতো একটি চমৎকার জায়গায় পৌঁছে গেছি।
ওং: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
[সাক্ষাৎকারটির প্রতিলিপি করেন ম্যাট কন্ডন এবং সম্পাদনা করেন পিটার ব্রুনেট।]