লেখক: অমর্ত্য গালিব চৌধুরী
“আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে
এসেছি। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ
কোনোদিন আসেনি। ওটা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে
এসেছি।”
কথাগুলি যিনি বলেছেন তার ঝুলিতে আছে পাঁচ পাঁচখানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। একটি দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ঝাড়া পাঁচটা দশক ধরে। ‘নায়করাজ’ নামে বহুল সমাদৃত মানুষটির নাম আব্দুর রাজ্জাক।
ব্রিটিশ ভারত, সালটা ১৯৪২। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাঙালির জীবনে এক বিষম যন্ত্রণা হয়ে এসেছে। বাজারে আগুন। মুনাফাখোরদের পোয়াবারো। ছয় সন্তানের সবচেয়ে ছোটটি; রাজ্জাক ওরফে রাজুর জন্ম এই সময়েই। টালিগঞ্জ বরাবর মঞ্চ নাটক আর সিনেমার জায়গা। রাজুরও অভিনয়ের হাতে খড়িটা হলো একেবারে তৃণমূল থেকে; মঞ্চনাটক। খানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক তাকে নামিয়ে দিলেন মঞ্চে। ছবি বিশ্বাসের রংগ সভা নাট্য দলের সাথে যুক্ত হয়ে শিখে নিলেনঅভিনয়ের অ, আ, ক, খ। কলকাতার সিনেমায় তখন উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতাদের জয় জয়কার। তাদের দাপটে ছোকরা মঞ্চ অভিনেতা যে বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না তা বলাই বাহুল্য। এ জন্যেই শিলালিপি দিয়ে ডেব্যু হয়ে রতন লাল বাঙালি (১৯৬০) বা প্রান্তিক-এর মতো দুই একটি চলচ্চিত্রে ছোটখাটো চরিত্র ছাড়া তেমন কিছু জুটলো না শুরুর দিকে। তবে রাজ্জাক নাছোড়বান্দা। ততদিনে মুম্বাই থেকে অভিনয়ের ওপরে একটা ডিপ্লোমা বাগিয়ে এনেছেন। লেগে থাকলে হয়তো কলকাতাতেই প্রতিষ্ঠিত হতেন তবে উপমহাদেশের ঘোরালো রাজনীতির মারপ্যাচে রাজ্জাকের জীবনে এলো এক অভাবনীয় মোড়, আর তাতেই পাল্টে গেল বাংলাদেশের সিনেমার ভবিষ্যৎ।
সুদূর কাশ্মীরের হাজরাতবাল দরগার মই-ই-মুকাদ্দাস (মহানবীর চুল) চুরি যাওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েকশত মাইল দূরে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া মনে হয় শুধু বাঙালিদের পক্ষেই সম্ভব। ৬৪ এর দাঙ্গায় হাজারে হাজারে বাঙালি হিন্দু খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে চলে গেল পশ্চিমবঙ্গে। ওপারের লোকেরাও কম সরেস না। পালটা দাঙ্গায় প্রাণ গেল শতাধিক বাঙালি মুসলিমের। দেশ ছাড়লেন অনেকে।
আব্দুর রাজ্জাক তখন বিবাহিত। ২২ বছরের যুবক রাজ্জাক দাঙ্গা ও দাঙ্গা-পরবর্তী উত্তেজনার মধ্যে পড়ে থাকতে চাইলেন না। কাজেই শরণার্থী বেশে সপরিবারে ঢাকায় চলে এলেন টালিগঞ্জের অভিনেতা। কমলাপুরের দিকে আশি টাকা মাসিক ভাড়ায় একটা কুঠরী গোছের বাসায় উঠলেন স্ত্রী রাজলক্ষী আর ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তখন উর্দু চলছে। উর্দু অভিনেতা ওয়াহিদ মুরাদের স্টাইলিশ ব্যক্তিত্বে বিভোর বাঙালিরা। ওদিকে খাস বাংলা চলচ্চিত্র তখন সবে গুটি গুটি পা ফেলছে। রাজ্জাক এই সুযোগটা নিলেন, কাজ জুটিয়ে ফেললেন মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) চলচ্চিত্রের নির্মাতা আব্দুল জব্বারের ইকবাল ফিল্মজ লিমিটেডে, তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগর লেন (১৯৬৬) দিয়ে ঢাকাই সিনেমায় ডেব্যু হলো। ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় চলছে। মাঝে মধ্যে সাদা কালো টিভি পর্দাতেও উপস্থিত হচ্ছেন। দিন কাটছে কষ্টে সৃষ্টে। এরই মধ্যে পরিচয় হলো জহির রায়হানের সাথে। রাজ্জাক জুটে গেলেন সহকারী পরিচালক হিসেবে।
জহির রায়হানের বেশ কিছু ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন রাজ্জাক। কিন্তু আসল সুযোগটা এল যখন জহির বেহুলা (১৯৬৬) বানানোর কাজ হাতে নিলেন। লখীন্দর হবে কে? কে সিনেমায় কংকাল সেজে শুয়ে থাকতে রাজি হবে? জহির কাওকেই রাজি করাতে না পেরে শেষমেষ রাজ্জাককেই নামিয়ে দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে বাজিমাত! সেই ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার মানুষ পর্দায় রাজ্জাককে লুফে নিলো। জহির রায়হানের অনেক ছবিতে রাজ্জাকের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অবদান আছে। জীবন থেকে নেওয়া (১৯৭০) চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় তো দুজনকেই পাকিস্তানিদের হাতে দেশ বিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণের অজুহাতে এফডিসি থেকে পাকড়াও করা হয়েছিল। পরে জহির রায়হানের যুক্তিতর্কের আক্রমণে মুক্তি পান। বিদ্রোহী যুবক ফারুকের চরিত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন রাজ্জাক সে সিনেমায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে দেশের বেহাল পরিস্থিতির মধ্যেও মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন। ওরা ১১ জন (১৯৭২) বা অশ্রু দিয়ে লেখাতে (১৯৭২) অভিনয় করেছেন। জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৩) এ অভিনয় করবার পর তো মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে গেল। সেই যে শুরু হলো, এর পরের আগুন নিয়ে খেলা (১৯৬৭), এতটুকু আশা (১৯৬৮), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), আলোর মিছিল (১৯৭৪), অশিক্ষিত (১৯৭৮), ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০) এবং বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২) সহ প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পরেও তার জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। চরিত্রের প্রয়োজনে বারবার নিজের ইমেজ গড়েছেন, পরে দরকারে সেটা ভেঙ্গেছেন। কখনো নীল আকাশের নিচে হাশিখুশি রোমান্টিক যুবক হয়েছেন তো কখনো লুঙ্গি পরে রূপালী পর্দায় হাজির হয়ে কাঁপন ধরিয়েছেন দর্শকদের মাঝে। নিরাপত্তা রক্ষী বা স্কুলের দপ্তরির মতো সাধারণ চরিত্রেও হাজির হয়েছেন এই অভিনেতা। যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছেন, ধার কমেনি একটুও। বাবা কেন চাকর (১৯৯৮) ছবিতে ছেলে বাপ্পার সাথে যখন অভিনয় করেন, তখন বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। সেই ছবিতেও রাজ্জাকের অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। সীমানা ছাপিয়ে কলকাতাতেও আলোড়ন তুলেছিল সিনেমাটি।
মঞ্চ নাটকে হরেক রকম অভিনয় করবার দক্ষতাটাকে দারুণ সফলতায় চলচ্চিত্র অভিনয়ে রূপান্তর করতে পেরেছিলেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালক হিসেবেও সাফল্য পেয়েছেন রাজ্জাক। ১৯৭৭ সালে নিজের পরিচালিত প্রথম সিনেমা অনন্ত প্রেম এ ববিতার সাথে তার চুম্বনের দৃশ্যটি সময় ও পরিস্থিতির বিবেচনায় ছিল এক মারাত্মক সাহসী সিদ্ধান্ত। যদিও পরে সিনেমাটি ঐ দৃশ্য বাদ দিয়েই রিলিজ হয়েছিল। রাজলক্ষী প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠা করবার পর প্রায় ২০টির মতো সিনেমা প্রযোজনা করেছেন রাজ্জাক। তার পরিচালিত সিনেমার সংখ্যা ১৬টির মতো।
হার্টথ্রব নায়ক হবেন, সুন্দরী নায়িকা থাকবে না তা কি করে হয়! রাজ্জাক-কবরী জুটি তো এখনো বাংলা সিনেমার সবথেকে জনপ্রিয় জুটিগুলির একটি। এছাড়াও রাজ্জাক অভিনয় করেছেন শাবানা, সুচন্দা, শবনম, সুজাতা, ববিতা, সুচরিতা, দোয়েক, কাজরী, চম্পার মতো পর্দা কাঁপানো সব নায়িকাদের সাথে। এদের অনেকে তার হাতে ধরেই সিনেমায় নেমেছেন। তবে হালের সিনেমাঙ্গনের মতো ব্যক্তিগত কারণে কখনোই বিতর্ক স্পর্শ করতে পারেনি এই পেশাদার মানুষটিকে পর্দা থেকে বাস্তবের জীবনটাকে খুব সতর্কতার সাথে আলাদা রেখেছেন।
আব্দুর রাজ্জাককে চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালী এর সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী উপাধি দিয়েছিলেন ‘নায়করাজ’। বাস্তবিকই পূর্ব পাকিস্তান বা স্বাধীন বাংলাদেশ, কোনো ক্ষেত্রেই এমন গুণী অভিনেতা বাংলা সিনেমায় দেখা যায়নি। বাংলা চলচ্চিত্রে অ্যান্টি-হিরো এর ঘরানার পথ প্রদর্শক তিনি। কে ভেবেছিল সেই ১৯৭৩ এর রংবাজ এ রাজা নামের প্রথাগত ঘরানা বিরোধী রাগী যুবকটি কয়েক দশকের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই বাংলা চলচ্চিত্রের রাজা হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করবে!
পেশাদারিত্ব বা অভিনয় দক্ষতা, সব দিক দিয়েই বাংলা চলচ্চিত্রকে একটা ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তর করবার পেছনে রাজ্জাকের অবদান বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। আব্দুর রাজ্জাকের সফল সিনেমাজীবন অলংকৃত করে আছে ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৮ সালে জেতা বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০১৫ সালে সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদান রাখবার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতা পদক সহ আরো অনেক স্বীকৃতি। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। শরণার্থী থেকে অঢেল খ্যাতির সমারোহ গড়লেও রাজ্জাক যাদের কল্যাণে নায়করাজ হয়েছেন, সেই দর্শকদেরকে কখনোই ভুলে যাননি। নিজের কাজের মাধ্যমে দর্শকদের বিনোদন দেওয়াটাকে তিনি যে কতটা গুরুত্বের সাথে নিতেন সেটা তার অভিনীত, পরিচালিত সিনেমাগুলির লম্বা তালিকাতে চোখ বোলালেই বোঝা যায়। একঘেয়েমী যাতে না আসে সেজন্য বরাবরই সচেতন ছিলেন তিনি।
রাজ্জাকের পরিবারের সাথেও মিশে আছে সিনেমা। তার ছেলে বাপ্পারাজ তো প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। অভিনয় করেছেন তার মেয়ে ময়নাও। পাঁচ সন্তানের জনক লক্ষী ওরফে খায়রুন্নেসার সাথে তার বিবাহিত জীবনটা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ব্যক্তি বা কর্মজীবন, সব ক্ষেত্রেই সমান তালে সাফল্য দেখিয়েছেন মানুষটি।
২০১৭ সালের আগস্টে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে পতন ঘটে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবথেকে শক্তিশালী স্তম্ভটির, বয়স হয়েছিল ৭৫। তবে পরপারেও গেলেও বাংলাদেশি সিনেমার অভিভাবক সদৃশ এই কিংবদন্তির অবদান ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
শরণার্থীর ছিন্নমূল জীবন থেকে যেভাবে সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন, তা দেখে সিনেমা তো বটেই, যেকোনো ক্ষেত্রের মানুষই নিজেদের অনুপ্রেরণার পাথেয় যোগাড় করে নিতে পারবে। টালিগঞ্জের তরুণ আক্ষরিক অর্থেই জয় করেছেন বাংলাদেশকে।
(লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজন আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২৪ এর স্মারকসংখ্যা থেকে প্রকাশিত)