সিনেমালাপ / June 17, 2021 / By অমর্ত্য গালিব চৌধুরী
লেখক: অমর্ত্য গালিব চৌধুরী
পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড। ইতিহাস তার ললাটে এঁকে দিয়েছে একের পর এক যুদ্ধের বলি হওয়ার ভাগ্য। ইতিহাসজুড়েই পোল্যান্ডকে বার বার ভাগ করা হয়েছে। পরাক্রান্ত পোলীয়-লিথুনীয় কমনওয়েলথকে চুরমার করে দিয়ে একসময় গোটা দেশটাকেই প্রতিবেশিরা হজম করে ফেলেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর চরম জাতীয়তাবাদী পোল্যান্ডের সাময়িক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায় বছর বিশেকের মধ্যে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই অস্থির ইতিহাসে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসলেও গোটা দেশটা কম্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতাপ্রিয় পোলদের মধ্যে এই নয়া আদর্শের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক অবশ্যই ছিল। কাজেই কম্যুনিস্ট পোল্যান্ডের সিনেমাতে স্বাভাবিকভাবে তার ছাপ পড়বে। জার্মানদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র যে পোলীয় চলচ্চিত্রের গন্ডিটা গড়ে উঠেছিল সেটাও মস্কোর মোচওয়ালা জনৈক শাসকের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত ছিল না। স্তালিনের মৃত্যুর পর অবশ্য পোলীয় চলচ্চিত্র শিল্প নতুন করে গড়ে উঠে। ‘লৌহ যবনিকার অন্তরাল’ এর দেশগুলির মত পোল্যান্ডেও সেসময় একদলীয় শাসন। যেকোন একদলীয় শাসনব্যবস্থাতেই প্রোপাগান্ডার একটা বাড়তি গুরুত্ব থাকে। আলোচ্য চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রে ভাইদার উত্থানটাও এসময়েই।
আন্দ্রে ভাইদা হচ্ছেন তার নিজের ভাষায়, পুরোদস্তুর রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাতা। পোল্যান্ড দেশটির ইতিহাস তেমন সুবিধের না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছিলো তার দুর্ভাগ্যের একটি পর্ব মাত্র। পাঁচ বছরব্যাপী জার্মান আর সোভিয়েত শাসনে পোলীয় প্রতিরোধযুদ্ধ হয়ে পড়েছিল বিভক্ত। বলাবাহুল্য কম্যুনিস্টরা এই প্রতিরোধের একটা বড় অংশ ছিল এবং যুদ্ধোত্তর পোল্যান্ডে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট এই দলটিই পোল্যান্ডের হত্তাকর্তা হয়ে দাড়ায়। ভাইদার যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলি এই আমলেই বানানো। স্বাভাবিকভাবেই নিজের চোখে দেখা মর্মান্তিক যুদ্ধটাই এই চলচ্চিত্রের উপজীব্য হবে। আর খাস পোলীয় সংস্কৃতির ছাপ রাখতে যেয়েই হয়তোবা তিনটি চলচ্চিত্রেই রয়েছে একাধিক রোমান্স, সন্ত আর ক্রুশের প্রতি মানুষের আস্থা এবং অবশ্যই পোলীয় জনসাধারণের দুর্ধর্ষ চরিত্রের গুণকীর্তন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে পোলীয় জনগণের দৃষ্টিতে দেখতে হলে আন্দ্রে ভাইদার যুদ্ধত্রয়ীর কোন বিকল্প নেই বলা চলে। গুণী এই চলচ্চিত্র নির্মাতা পোল্যান্ডকেই তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পোল্যান্ড
১৯৩৯ এর পয়লা সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী পোলীয় সীমান্ত অতিক্রম করে। ১৬ দিনের মাথায় সোভিয়েত সেনাদল পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল আক্রমণ করে বসে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র পোল্যান্ডের পক্ষে একই সঙ্গে দুটি প্রবলপ্রতিপক্ষের মহড়া নেওয়া সম্ভব হয়নি। সপ্তাহ চারেকের মধ্যেই রাজধানী ওয়ারশ এর পতন ঘটে। শুরু হল খুন, গণহত্যা, অত্যাচার আর ধ্বংসযজ্ঞ। পোল্যান্ডের আশেপাশের বেশিরভাগ দেশই ছিলো জার্মান নিয়ন্ত্রিত। আর জনগণের বিরাট একটা অংশ বিশেষ করে পশ্চিম পোল্যান্ডের মানুষেরা আবার সোভিয়েতদেরকে স্রেফ রুশ সাম্রাজ্যবাদের একটা মুখোশ হিসেবেই বিচার করতে অভ্যস্ত ছিলেন। বলাবাহুল্য, এহেন দলাদলি জার্মান আর সোভিয়েত দখলদারিত্বের মধ্যেও বিরাজমান ছিল। পোলীয় প্রতিরোধ যুদ্ধের দুটি অংশ ছিলো। সোভিয়েতপন্থী পোলিশ ওয়ার্কার্স পার্টি এবং তাদের সশস্ত্র সংগঠন পিপলস গার্ড। অপর অংশটি হচ্ছে ইঙ্গ-মার্কিন মদদপুষ্ট নির্বাসিত পোলীয় সরকারের প্রতিনিধি। এদের সশস্ত্র অংশটির নাম হচ্ছে হোম আর্মি। উল্লেখ্য, এই হোম আর্মি বা একই ধরণের মতাদর্শের লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধোত্তর পোল্যান্ডে ছোটখাট বিদ্রোহ-আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন। ভাইদার যুদ্ধত্রয়ী মূলত এই অস্থির সময়ের গাঁথা। বোঝবার সুবিধার জন্যেই এই সংক্ষিপ্ত পটভূমিটার কথা বলতে হলো। পরের অংশে আমরা দেখবো ভাইদার চলচ্চিত্র তিনটি কীভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পোলীয় অংশটিকে দৃশ্যায়ন করেছে।
এ জেনারেশন
তিনটি চলচ্চিত্রতে আন্দ্রে ভাইদা পোল্যান্ডের সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন। প্রথমটি, এ জেনারেশন (১৯৫৫) যখন বানানো হয় তখন স্তালিনের প্রভাব থেকে পোল্যান্ড সদ্য মুক্ত হচ্ছে। ততকালীন পোলীয় কম্যুনিস্টদের মধ্যেও অনেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা। সোভিয়েত নেতাদের কড়াকড়ির বিপরীতে যেয়ে নিজস্ব ধাঁচে চলচ্চিত্র বানানো শুরু হয়েছে দেশে। এ জেনারেশন শহরে প্রেক্ষাপটের চলচ্চিত্র। স্টাশ নামক জনৈক শ্রমিকের আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্টদের সাথে সখ্য, রোমান্স আর নৃশংস যুদ্ধের এক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে উপজীব্য করা হয়েছে ১৯৪৩ সালের ইহুদী অভ্যুত্থান নিয়ে। ওয়ারশ এর ইহুদী বস্তিতে বাস করতো প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। ইহুদীদের পাশাপাশি রোমানিসহ অন্যান্য জাতের লোকেদের খেদিয়ে এখানে এনেছিল জার্মানরা। এদেরকে গ্যাস চেম্বারে পোড়ানো হবে বা অনুরুপ মারাত্মক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমন অবস্থা দেখা দিলে ইহুদী নেতারা পোলীয় দেশপ্রেমিকদের সাথে যোগাযোগ করেন। কম্যুনিস্ট ও জাতীয়তাবাদী উভয়ের কাছ থেকে সাহায্য পেলেও জার্মানদের বিরুদ্ধে তা ছিল অপ্রতুল। ফলাফল? মাসখানেকের মাথায় গুড়িয়ে দেওয়া হল ইহুদী বসতি। মারা পড়লো বহু মানুষ। বলাবাহুল্য, প্রেক্ষাপটটি জটিল। জটিলতা বাড়াবার আরো কারণ হচ্ছে, ইহুদীদের প্রতি খোদ কম্যুনিস্টদের অনেকেই বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন না। এর মধ্যেও এ জেনারেশন চলচ্চিত্রটিতে ভাইদা দেখিয়েছেন জাতীয় বিপদের দিনে কিভাবে সাধারণ নির্ঝঞ্ঝাট লোকেরা ইচ্ছে করে বিপদের জীবন বেছে নিচ্ছে। একই সাথে দেখানো হয়েছে অকম্যুনিস্ট দলগুলির অকার্যকরতা এবং হাস্যকর এক চরিত্র যে কিনা আগের আমলের পোলীয় আভিজাত্যের প্রতিভূ। নাসি বর্বরতা, দ্বিধাবিভক্ত পোলীয় সমাজ এবং মুক্তিকামীদের মেহনত নিয়ে বানানো চমৎকার এক চলচ্চিত্র হচ্ছে এ জেনারেশন। প্রোপাগান্ডা হিসেবেও চলচ্চিত্রটি খাসা। কম্যুনিস্ট বাদে অন্যান্য জার্মান বিরোধী দলগুলিকে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে হাস্যকর ও তৃণমূল মানুষের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কিছু গোষ্ঠী হিসেবে।
কানাল
এ জেনারেশন নির্মাণের বছর খানেকের মধ্যে নির্মাণ করা হয় কানাল (১৯৫৭)। আগেরটির তুলনায় আরো নিষ্ঠুর, আরো নাটকীয়। পোলীয় গেরিলাদের মরণপ্রাণ প্রতিরোধ, শেষমেষ শহরের পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা দিয়ে পলায়ন ও সেখানের ঘোরঘোরালো পরিস্থিতি নিয়ে এক দুর্দান্ত চলচ্চিত্র। এ জেনারেশন এর তুলনায় কানাল অবশ্য কিছু দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটি আরো বেশী নির্মম, আরো বেশী পীড়নাদায়ক । উল্লেখ্য, প্রথমটির মত কিন্তু এখানে কম্যুনিস্টরা নায়কের ভূমিকায় নেই। কানাল-এর প্রধান চরিত্ররা পোলীয় জাতির ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৪৪ এর মাঝের দিকে লাল ফৌজ ওয়ারশ এর দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়। ওদিকে মিত্রবাহিনীও জার্মানদের ঠেলে সমানে আগাচ্ছে। প্রাগ ও প্যারিসে ইতোমধ্যেই কয়েক দফা জার্মান বিরোধী অভ্যুত্থান চালিয়েছে ওদেশের লোকেরা। ওয়ারশ এর বিপ্লবীরাও, বিশেষ করে পোলীয় জাতীয়তাবাদীরা এ সময় জার্মানদের বিরুদ্ধে এক জোর অভ্যুত্থান ঘটায়।
যথারীতি সীমিত অস্ত্রশস্ত্র আর লোকক্ষয়ের কারণে তাদের শক্তি ফুরিয়ে আসতে থাকে। স্তালিনের সেনাদল কিন্তু এই বিদ্রোহীদেরকে কোনরকম সাহায্য করেনি, যদিও চাইলেই তা সম্ভব ছিল। জার্মানরা একের পর এক মহল্লা দখল করতে থাকে, অথচ লাল ফৌজ ওয়ারশ এর মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে হাত গুটিয়ে বসে রইলো ঝাড়া এক মাসেরও বেশী। জার্মান আক্রমণে পোলীয় প্রতিরোধ মাস দুই এর মধ্যে গুড়িয়ে যায়। গোলাবারুণ ফুরিয়ে এসেছে, শহরে চলাচলের উপায় নেই, ত্রাতা হিসেবে যাদেরকে ভাবা হয়েছিল তাদের বিস্ময়কর ঔদাসিন্য আর এরই মধ্যে মরণপ্রাণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এইসব হতভাগ্য বীরদের বীরত্বগাথা। রক্ত, ঘাম, বারুদ আর অবিরাম পালিয়ে চলার এক দুঃসহ চলচ্চিত্র।
অ্যাশেজ এ্যান্ড ডায়মন্ড
১৯৪৫ সাল। পোল্যান্ড স্বাধীন হল। ক্ষমতায় বসেছে কম্যুনিস্টরা। দ্বিখণ্ডিত জার্মানি দুর্বল ও বিধ্বস্ত। দেশে সোভিয়েত শক্তির জয়জয়কার। নতুন সরকার যখন গুছিয়ে বসছে তখন পোলীয় জাতীয়তাবাদীদের কেউ কেউ বেঁকে বসলেন। তাদের অনেকেই সোভিয়েত কাম রুশীদেরকে জার্মান অপেক্ষা কম শত্রুজ্ঞান করতেন না। পেলীয় কম্যুনিস্টরা নানা বিচ্ছিন্ন গেরিলা দলের আক্রমণের মুখে পড়তে লাগলেন। অবশ্য কঠোর হস্তে এসব দমন করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে নির্মিত অ্যাশেজ এ্যান্ড ডায়মন্ড এক অদ্ভুত চলচ্চিত্র। নায়ক ও খলনায়কের ভিত্তিতে চরিত্রগুলিকে দেখার অবকাশ নেই। পোলীয় ‘হোম আর্মির’ দুই গুপ্তঘাতককে ঘিরে কাহিনি। আছে রোমান্স, আদর্শের প্রতি ভক্তি, ক্যারিয়ারিস্টের নির্লজ্জ তেলবাজী আর বিগত দিনের প্রতিভূদের অনর্থক অন্যায় আচরণ। মজার কথা হচ্ছে, পুরো চলচ্চিত্রটি দেখলে মনে হয় গুপ্তঘাতকেরাই বরং নির্বিঘ্নে আছে। যদিও শেষরক্ষা যে হয়নি তা ইতিহাসেই আছে। রাজনৈতিক জুয়াখেলায় ভুল সিদ্ধান্ত নিলে একটি প্রজন্ম কীভাবে অনিশ্চয়তার বাধায় এলোমেলো হয়ে পড়ে, অ্যাশেজ এ্যান্ড ডায়মন্ড তার একটি সম্যক দৃষ্টান্ত।
ভাইদার চলচ্চিত্রের উল্লেখ্য বিষয়
আন্দ্রে ভাইদার চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। বিষয়বস্তু যে রাজনৈতিক হবে তা তো আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু এর বাইরেও চলচ্চিত্রের কিছু দিক আছে যা নিছক পোলীয় চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। ভাইদার চরিত্রগুলির দিকেই এক নজর তাকানো যাক। বিচিত্র সব লোক এবং বিচিত্র সব শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিত্বকারী তারা। মাঞ্চুরিয়ায় লড়ে আসা বুড়ো সৈনিক, আন্ডারগ্রাউন্ডের রহস্যময়ী রূপসী কম্যুনিস্ট নেত্রী, বিগতযৌবনা এবং গালভরা খেতাবধারী কাউন্টেস, সুন্দরী মদ্য পরিবেশনকারী, কম্যুনিস্ট পার্টির জেলা শাখার প্রধান যার ছেলে কিনা আবার সরকার বিরোধীদের সাথে যুক্ত, ওস্তাদ সঙ্গীতজ্ঞ যে কিনা এখন পিয়ানোর চাবির বদলে গ্রেনেড হাতে ঘুরে বেড়ায়, নির্লিপ্ত ছোকরা বিপ্লবী যে শত্রুর ট্যাংকের সামনে বসে জুতার ধূলা পরিষ্কার করে কিংবা নির্লজ্জ ক্যারিয়ারিস্ট যে ক্ষমতাসীনদের পোঁ ধরে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু একরাতের মাতলামিতেই গোটা ভবিষ্যতটা খুইয়ে বসে। এই রকমারি চরিত্রদের ভিড় থেকে পোলীয় সংস্কৃতি আর চরিত্রের টুকরো-টাকরা বের করে দেখানো প্রায় অসাধ্য এক কাজ। তবে কিছু ব্যাপার দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এই যেমন কম্যুনিস্ট আর অকম্যুনিস্টদের অনেকেই দেখা যাচ্ছে খ্রীষ্টধর্মের প্রতি বেজায় তক্ত। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গলায় ঝোলানো ক্রুশে চুমু দিতে যারা ভোলেনা। আবার দেখা যাচ্ছে পরিত্যক্ত গীর্জায় স্বয়ং যীশুর ভাস্কর্য উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও শুলিবিদ্ধ শ্রমিক চার্চে যীশুর প্রতিকৃতির সামনে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। কোথাও দেখা যাচ্ছে অবশ্যম্ভাবী জার্মান আক্রমণের মুখেও দিব্যি গানবাজনা হচ্ছে। আর রোমান্স। পোলীয় চরিত্রের এই দিকটা বাদ দিলে চলচ্চিত্রগুলিই বোধহয় অসম্পূর্ণ হয়ে যেত! কি বিচিত্র পটভূমি আর কি বিচিত্র সব যৌক্তিকতা! প্রেমিক খুন হয়েছে বলে হাপুস নয়নে কাঁদছে বারবণিতা প্রেমিকা। খদ্দের এসে শুনে সহানুভূতি জানালো বটে, কিন্তু পরমূহুর্তেই মেয়েটিকে বিছানায় টানতে তার মোটেও বাধলো না। ওদিকে জার্মান গুপ্ত পুলিশ গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়া মেয়েটি বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে, কারণ দরজার আড়ালে লুকিয়ে আছেন প্রেমিকপ্রবর। নারীরা ভাইদার চলচ্চিত্রে এসেছে শক্তিশালী সব চরিত্রের রুপে। মরনপণ সংগ্রামের দিনগুলিতে পুরুষ সহযোদ্ধাদেরকে সঙ্গ দিয়েছে তারা বার্তা আদান প্রদান করে। কখনো নেতৃত্ব, কখনো সাহস আর শক্তি যুগিয়ে। কানাল-এর সেই মেয়েটির কথাই ধরা যাক। ঈর্ষাতুর প্রেমিক গুলিবিদ্ধ হলে বেচারি তাকে তার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় শেষ সীমা পর্যন্ত। নারী ও পুরুষের এমন যৌথ প্রতিরোধ আর সংগ্রামের দৃশ্যায়ন ভাইদার যুদ্ধত্রয়ীর একটা বড় বৈশিষ্ট্য।
যুদ্ধ এক মর্মান্তিক ঘটনা। সাধারণ মানুষের ওপর দিয়েই এর মূল ঝাপটাটা যায়। মদ্যপ যোদ্ধা মদের গেলাশে আগুন ধরিয়ে গোনে কয়জনকে সে চিরবিদায় জানিয়েছে। ঝানু রাজনীতিবিদ বেজায় দুঃখী কারণ ছেলে যোগ দিয়েছে সরকারবিরোধীদের দলে এবং ধরাও পড়েছে। গুড়িয়ে যাওয়া শহর, যুদ্ধ আর রক্ত, শেষ আশাটাও হারিয়ে যাওয়ার পর মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা কিংবা বেঁচে থাকবার শেষ সংগ্রাম সবই এসেছে ভাইদার ক্যামেরায়। প্রচলিত ধারার সুখি সমাপ্তির তো প্রশ্নই ওঠেনা। পোলীয় জাতিটি ভাগ্যাহত হওয়ার কারণেই কিনা, কে জানে, ভাইদার তিনটি চলচ্চিত্রই বিষাদে ভরপুর। যুদ্ধকে কোন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মার্কিন যুবকের ছুটির দিন কাটানোর শামিল হিসেবে দেখানো হয় যেসব চলচ্চিত্রে; ভাইদা তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। যুদ্ধ মানে নিখাত যুদ্ধ এবং চলচ্চিত্রকার এখনে নির্মম, নৃশংস। তিনটি চলচ্চিত্রই যুদ্ধের ভয়াবহতাকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছে। আর বার বার পোলীয় জাতীয় পতাকার আস্ফালন চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে জাতীয়তাবাদের স্পষ্ট ছাপ রেখেছে। তুলনায় কম্যুনিজম সম্পর্কিত চিনহ যেমন লাল তারা বা কাস্তে-হাতুড়ির কোন খোঁজ পাওয়া যায় না বললেই চলে।
আন্দ্রে ভাইদা ও পোলিশ ফিল্ম স্কুল
ভাইদা হচ্ছেন সেইসব চলচ্চিত্রকারদের একজন, যাদের উপর দায়ভার পড়েছিল সমাজতন্ত্র আর বিপ্লবের মোটা চাদরের আড়াল থেকে নিজের জাতির ইতিহাস অনুসন্ধানের। সুযোগটা এসেছিল অপ্রত্যাশিতভাবে।
স্তালিনের জমানায় গোটা লাল ইউরোপেই শিল্প-সাহিত্যে বিরাজ করেছে সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম। ভাল ও মন্দ, প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়া, প্রগতিশীল আর প্রাচীনপন্থী; সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম সমাজকে আটকাতে চাইতো এই বাধা ছকে। কিন্তু ১৯৫৩ তে সোভিয়েত একনায়ক মারা গেলে ক্ষমতা চলে যায় অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী খ্রুশ্চেভের হাতে। অল্পবিস্তর দাঙ্গা হাঙ্গামার পরে পোল্যান্ডে ক্ষমতায় আসেন নিকোলাস গোমুলকা। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম থেকে ছাড়া পাওয়ার এই সুযোগটা পোলীয় চলচ্চিত্রকারেরা লুফে নিলেন। পোলিশ ফিল্ম স্কুলের উদ্ভবটাও এই সুযোগে ঘটে যায়। ভাইদা এবং তাঁর সময়ের আরো অনেক চলচ্চিত্রকারই যুদ্ধটা নিয়েই কাজ করে গিয়েছেন। ভাইদা স্বয়ং স্বীকার করেন যে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ঐ দেশে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করতে হলে সর্বশেষ যুদ্ধটাকেই উপজীব্য করতে হবে। নয়া ঘরানার চলচ্চিত্রগুলিতে ভাইদা সমষ্টিগত বিদ্রোহ-বিপ্লবকে এড়িয়ে ব্যক্তিবিশেষের বীরপনার ওপরে জোর দেন। যুদ্ধত্রয়ীর মধ্যে দ্বিতীয় আর তৃতীয় চলচ্চিত্রে এই ফারাকটা বিশেষভাবে দৃশ্যমান। তুলনায় এ জেনারেশন অনেক বেশি প্রোপাগান্ডা ঘরানার। পোলিশ ফিল্ম স্কুলের অবশ্য আরেকটা ধারাও ছিল। এটার হর্তাকর্তারা ব্যক্তিগত বীরত্বের তুলনায় পোলীয় চরিত্রের অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। তবে নির্মাতা হিসেবে ভাইদা নিজেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই। যুদ্ধত্রয়ী ছাড়াও তার অবিস্মরণীয় অনেকগুলি চলচ্চিত্র আছে, সবগুলিই পোল্যান্ডকেন্দ্রিক। খ্যাতি আর যশের মোহে তিনি দেশ ছেড়ে আরো অনেকের মত হলিউডে ক্যারিয়ার গড়েননি, পোল্যান্ডেই থেকে গিয়েছেন আজীবন। ২০১৬ সালে, নব্বুই বছর বয়সে আন্দ্রে ভাইদা মারা যান।
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত সাময়িকী ফ্ল্যাশব্যাক এর ‘পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্র’ সংখ্যা থেকে সংকলিত)